বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই সম্প্রীতির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। প্রতিবেশী ভারতে যখন ধর্ম পালনের অজুহাতে, গরুর গোশত খাওয়ার অজুহাতে সমানে মুসলিম নির্যাতন করা হয় সেখানে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা থাকে নিরাপদ। আবার যখন আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলিমকে পুড়িয়ে ও জবাই করে খুন করা হয়, লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয় তখন বাংলাদেশে বৌদ্ধরা থাকে সম্মানের সাথে, নিরাপদে। বাংলাদেশের সাথে মাত্র দু’টি রাষ্ট্রের সীমান্ত। আর সেই রাষ্ট্র দুটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন যখন চরমে তখন বাংলাদেশ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে সকল ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠীর মানুষকে।
বাংলাদেশেও যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে না সেটা বলা যাবে না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র দু’টির তুলনায় অনেক কম হলেও ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রামু, নাসিরনগর আর চলমান রংপুরের ঘটনা উল্লেখ করার মত। ‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন’? আমরা চাই বাংলাদেশে এমন একটা ঘটনাও ঘটবে না। বাংলাদেশ উত্তম হবে অবশ্যই। আর সে লক্ষ্যেই আমাদের সবার কাজ করতে হবে। এই কাজের দায় প্রথমত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের। এরপর সরকারের। সরকার কোন দলের না, কোন গোষ্ঠীর না। সবার অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সম্প্রীতি নিশ্চিত করা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের।
বাংলাদেশের সমস্যাগুলো কিন্তু আমাদের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মত নয়। এখানে কোন সংখ্যালঘু তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করার জন্য অথবা শুধুমাত্র সে সংখ্যালঘু ধর্মের এই কারণে কেউ নির্যাতনের শিকার হয়নি। ইদানিংকালের প্রতিটি ঘটনায় দেখা যায় সংখ্যালঘু সমাজের সদস্যরা ইসলাম ধর্ম, আল্লাহ, মহানবী সঃ কে নিয়ে কটূক্তি করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার কোন ঘটনারই বিচার হচ্ছে না। আমাদের প্রথমত দেখা উচিত কেন ঘটনাগুলো হচ্ছে? আমাদের দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য আইন রয়েছে। যারা এই অপরাধগুলো বার বার করছে তাদের সুষ্ঠু বিচার হলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হত না।
এবার আসি রংপুরের ঘটনায়। এখানে দেখা যায় শ্রী টিটু চন্দ্র ফেসবুকে ২৮ অক্টোবর আল্লাহর রাসূল সঃ কে অবমাননা করে পোস্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। এলাকাবাসী প্রায় এক সপ্তাহ আন্দোলন করেছে। কারো নজরে আসেনি বিষয়টা। কোন মিডিয়া কাভারেজ পায়নি। প্রথমে এলাকার জনসাধারণ স্থানীয় থানায় মামলা দায়ের করতে গিয়েছিল। পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। পরের দিন মামলা নিয়েছে। তবে দৃশ্যত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। স্থানীয় এলাকাবাসী বিচারের দাবীতে পথে পথে ঘুরেছে, মানববন্ধন করেছে, মিছিল করেছে। কোন কিছুই টনক নড়াতে পারেনি প্রশাসনের। অবশেষে রাস্তা অবরোধ করেছে জনতা। পুলিশের ওসি এলেন। আশ্বাস দিলেন দোষী টিটুকে গ্রেপ্তার করার। সেখানে অনেকে বক্তব্য রেখেছেন। সবাই দোষীর বিচার চেয়েছেন। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও ছিলেন। সেই ভিডিও ফুটেজ আমাদের কাছে পৌঁছেছে। সেখানে দেখা যায় জনগণ নেতাদের বক্তব্যে আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গিয়েছেন। অবরোধ তুলে নিয়েছেন। এটা হচ্ছে ছয় তারিখের ঘটনা।
পরবর্তী তিন দিনেও পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। নয় তারিখ আবার সমাবেশের আয়োজন করে স্থানীয় জনতা। পরদিন শুক্রবার মুসল্লিরা সমাবেশের ঘোষনা দেয়। ইতিমধ্যে পুরো সদর উপজেলায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন দোষী টিটুকে গ্রেপ্তার না করে পাগলাপীর এলাকায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করে। সমাবেশ করতে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে রাস্তা অবরোধ করে ক্ষুব্দ জনতা। পুলিশ বেপরোয়া হয়ে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে একজনসহ মোট তিনজন মুসল্লি মৃত্যুবরণ করেন। ইতিমধ্যে কিছু উত্তেজিত মানুষ হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ করে। এতে কয়েকটি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এসব ঘটনাকে আমরা কাকতালীয় মনে করিনা। এর সাথে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সেক্যুলার দল হিসেবে সংখ্যালঘুদের কাছে জনপ্রিয়। তাই আওয়ামীলীগ সবসময় সংখ্যালঘুদের একটা ভয়ের মধ্যে রাখতে চায়। এদেশে যদি সংখ্যালঘুরা ভালো থাকতে চায় তবে যেন তারা অবশ্যই তাদের ভোট আওয়ামীলীগকে দেয়। আবার এসব ঘটনা দ্বারা বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকেও শায়েস্তা করা যায়। রামু, নাসির নগরের ঘটনাতে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নেপথ্যে রয়েছে আওয়ামীলীগ। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের। রংপুরের ঘটনায়ও দেখা যায় পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান কোন তদন্ত ছাড়াই জামায়াত-শিবিরের নামে দোষ চাপিয়েছেন। জামায়াতের নেতাকর্মীসহ গ্রেপ্তার করেছেন শতাধিক। অথচ আন্দোলনকারীদের ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা যায় সেখানে কোন জামায়াতের বা বিএনপির লোক ছিল না বরং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আজ সেখানে প্রায় বিশটি গ্রাম পুরুষ শূন্য। পুলিশ দোষী টিটুর গ্রেপ্তার তো দূরের কথা উল্টো প্রতিবাদকারীদের গ্রেপ্তার করছে।
এখানে প্রথমত পুরো দায় প্রশাসনের। তারা টিটু চন্দ্রকে গ্রেপ্তার করলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। হিন্দু পাড়ায় আক্রমণের ঘটনা ঘটতো না। তিনজন নিরীহ মানুষের প্রাণ যেত না। সরকারের তৎপরতা দেখে বুঝা যায় সরকার বিষয়টা নিয়ে খেলতে চায়। হিন্দু জনগোষ্ঠীকে বুঝাতে চায় সামনে নির্বাচন, আমাদের ভোট না দিলে তোমরা বাংলাদেশে নিরাপদ না। অন্যদিকে মিথ্যা অভিযোগে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
আমরা চাই এসবের অবসান হোক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক সব ধরণের সম্প্রীতি বজায় থাকুক। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সমস্যা কোনকালে ছিল না, আমরা চাই এই সমস্যা কোনভাবে সৃষ্টি না হোক। এর জন্য সুশীল সমাজসহ সকল নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় নেতাদের মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশে নির্বাচন এগিয়ে আসছে। আমাদের চাওয়া একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে আরো তৎপর হতে হবে। ইতিমধ্যে বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে বিএনপি। সরকার বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিয়েছে এজন্য সাধুবাদ জানাই। একইসাথে সরকারের বাধার কথাও না বললে নয়। সারাদেশের গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে কার্যত ঢাকা অবরোধ করেছে সরকার। বিএনপির অনেকে নানান কৌশল অবলম্বন করে ঢাকায় এসেছে। একদল বিএনপি নেতাকর্মী তাদের একজনকে বর সাজিয়ে ঢাকায় এসেছে বরযাত্রী হিসেবে। এই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলোর সাথে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ ছিল। এরপরও কি জনস্রোত থামানো গিয়েছে? এভাবে জনস্রোত থামানো যায় না। এগুলো সরকারের ভুল পদক্ষেপ। সমাবেশ চলাকালীন পল্টন থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ রাখা হয়েছে। লাইভ সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এগুলো কোন কিছুই সরকারের পক্ষে যায় নি। সুশাসনের পক্ষে যায়নি।
গনতন্ত্রের চর্চা সকল দলে অব্যাহত থাকা দরকার। এই গণতন্ত্র চর্চা রাষ্ট্রের মধ্যে যেভাবে থাকা দরকার ঠিক সেভাবে দলের ভেতরেও থাকা দরকার। টাকা কিংবা পেশীশক্তি যতদিন রাজনীতির নিয়ামক হবে ততদিন এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বড় দুটি দলেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কেবল একজনের। দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হলে রাষ্ট্রে কীভাবে তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবেন?
আগামীর বাংলাদেশকে আমরা দেখতে চাই সুন্দর ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ। সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠিত হবে সুশাসন। নোংরামী, হানাহানি, সন্ত্রাসীর রাজনীতি বন্ধ হবে। গণতন্ত্রের বিকাশ হবে। দেশের স্বার্থে ও দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে সবার মাঝে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের সমস্যাগুলো সমাধানে সব ধর্মীয় গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল একত্র হয়ে কাজ করবে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানেরা রাজনীতিতে এগিয়ে আসবে। আমাদের দেশে বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। সমাজের মেধাবীদের কে রাজনীতি নোংরা বলে রাজনীতিতে আসতে দেয়া হয় না বা বারণ করা হয়। আর মেধাবীরা আসছে না বলেই সন্ত্রাসীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা চাই আমাদের আগামী নেতৃত্ব হবে মেধাবীদের।
Discussion about this post