রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং সংবিধান রক্ষায় গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনাবাহিনী অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। এদের অস্তিত্ব একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাঠামোর মৌলিক উপাদান। কিন্তু যখন এই প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের বিপরীতে অবস্থান নেয়, রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, কিংবা ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে— তখন প্রশ্ন জাগে: তারা কি সত্যিই রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ, না-কি দলীয় পেটোয়া বাহিনী? তারা কি গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, না-কি গণতন্ত্রের অন্তরায়?
গোয়েন্দা সংস্থার প্রকৃত ভূমিকা
গোয়েন্দা সংস্থার কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করা। তাদের দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করা এবং সংবিধান সমুন্নত রাখা। কিন্তু আমাদের দেশে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম বহুবার এই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
গত দেড় যুগে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী দলকে দমন করতে, রাজনৈতিক কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে, এমনকি নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করতেও। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গণমাধ্যমে চাপ প্রয়োগ, সম্পাদককে হুমকি দেওয়া— এসব কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কল্পনাতীত। অথচ বাংলাদেশে এসব ঘটনা ঘটেছে বারবার, এবং প্রায়শই ক্ষমতাসীনদের স্বার্থেই এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই (FBI) এবং সিআইএ (CIA) গোয়েন্দা সংস্থার আদর্শ উদাহরণ। এফবিআই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করে, আর সিআইএ বৈদেশিক গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের মিশন স্পষ্ট: জনগণকে রক্ষা করা এবং সংবিধানকে সমুন্নত রাখা। তারা কখনোই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না, এমনকি বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়েও এমনটি হয়নি এবং হচ্ছেও না। শক্তি ও অস্ত্রের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও তারা সংবিধান ও আইনের সীমারেখা মেনে চলে।
যুক্তরাজ্যের MI5 ও MI6 একইভাবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কাজ করে। ব্রেক্সিট-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, এক বছরে তিনজন প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন—এসব সত্ত্বেও তারা কখনোই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করেনি। নাগরিক নিখোঁজ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গণমাধ্যমে চাপ— এসব তাদের অভিধানে নেই।
অন্যদিকে, পাকিস্তানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অতিরিক্ত ক্ষমতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সেখানে “রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র” বা Deep State-এর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে গণতন্ত্র সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। বাংলাদেশে গোয়েন্দা সংস্থার রাজনৈতিক অপব্যবহারও দেশকে অনেকটা সেই দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।
সেনাবাহিনীর ভূমিকা:
আস্থার সংকট গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ভূমিকাও সমালোচনার দাবি রাখে। জনগণের করের অর্থে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক সময় জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে: রাজনৈতিক আন্দোলনে মানুষ হত্যা, টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি, ক্ষমতাসীনদের চাপিয়ে দেওয়া স্বার্থ রক্ষা, অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতা না করা, প্রয়োজনীয় সংস্কার এড়িয়ে যেনতেন নির্বাচন আয়োজন, একটি ব্যর্থ দলকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা; এসব কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীকে জনগণের আস্থা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, সরকার নয়। সংবিধান অনুযায়ী (অনুচ্ছেদ ৭), রাষ্ট্রের মালিক ১৮ কোটি নাগরিক। সরকার একটি ক্ষণস্থায়ী কাঠামো, যা পরিবর্তনশীল। কিন্তু যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে রাষ্ট্রের সমার্থক মনে করে, তখন গণতন্ত্র বিপন্ন হয়।

রাষ্ট্র ও সরকারের পার্থক্য
বাংলাদেশে সরকার ও রাষ্ট্রের পার্থক্য অনেকেই বুঝতে চান না। রাষ্ট্র ১৮ কোটি মানুষের, সরকার একটি দল বা জোটের। সরকারের বিরোধিতা করা সাংবিধানিক অধিকার, রাষ্ট্রের বিরোধিতা রাষ্ট্রদ্রোহ। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা প্রায়ই নিজেদের রাষ্ট্রের সমার্থক ভাবেন, যা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।
কোনো সরকার রাষ্ট্রের শেষ সরকার নয়, কোনো ব্যক্তি বা দল রাষ্ট্রের বিকল্প নয়। রাষ্ট্র স্থায়ী, সরকার ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় যায়, তারা মনে করে তারাই রাষ্ট্র, তারাই অপরিহার্য। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই যেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! এই বিভ্রান্তি থেকে বের না হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠে না।
সংস্কার কেন জরুরি
গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনাবাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং সংবিধাননিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের কাজ হবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জনগণের সুরক্ষা দেওয়া এবং সংবিধান রক্ষা করা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দলীয় স্বার্থ রক্ষা, বা ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ হয়ে ওঠা— এসব থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে।
এর জন্য আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে স্পষ্ট সংস্কার দরকার। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা গঠন করা যেতে পারে, যেখানে নাগরিক সমাজ, বিচার বিভাগ এবং সংসদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সেনাবাহিনীর জন্যও একটি স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক তদারকি কাঠামো প্রয়োজন, যাতে তারা রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়।

গণতন্ত্রের টেকসই ভবিষ্যৎ
রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও গণতন্ত্রের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে সংবিধাননিষ্ঠ, জবাবদিহিমূলক এবং জনবান্ধব করে গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করাই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত।
গত ৫৪ বছরে, বিশেষ করে গত ১৬ বছরে এই রাষ্ট্রে যা ঘটেছে, তা আর চলতে পারে না। রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ যেন আর কখনো রাজনীতির হাতিয়ার না হয়— এই প্রত্যাশাই সবার। এবং এটি নিশ্চিত করাই আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে জরুরি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা থাকার কথা নয়। তারা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান, কোনো বিশেষ সরকারের বাহিনী নয়। তাদের পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা যতদিন নিশ্চিত না হবে, ততদিন গণতন্ত্রের শেকড় মজবুত হবে না।
আজ প্রয়োজন স্পষ্ট সংস্কার। গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনাবাহিনীকে সংবিধানভিত্তিক কাঠামোয় বাঁধতে হবে। তাদের কাজ হবে রাষ্ট্রকে রক্ষা, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সংবিধান সমুন্নত রাখা— কোনো দলের স্বার্থ রক্ষা করা নয়।
সংবিধান বলছে, বাংলাদেশের মালিক জনগণ। তাই জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তার বাইরে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান টিকতে পারে না। সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা যদি সত্যিই জাতির আস্থা ফিরে পেতে চায়, তবে তাদের মূলমন্ত্র হতে হবে—“রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, সংবিধানের প্রতি অটল শ্রদ্ধা।”
লেখক: গবেষক ও হিউম্যান রাইটস একটিভিস্ট , লন্ডন।
Discussion about this post