মানব সভ্যতার ইতিহাসে ভাঙা-গড়া চলছেই । বিপ্লবী তরঙ্গের ঢেউ মানুষকে বারংবার আন্দোলিত করেছে, সভ্যতার গতিপথ পাল্টে দিয়ে মানব সভ্যতা আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে । মানব জাতির ইতিহাসে স্মরণাতীত কাল থেকেই অগণিত বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে । এ সকল বিপ্লবের ইতিহাস মানব সভ্যতার গতিপথকে নির্ধারণ করলেও তার সামগ্রিক ইতিহাস মানুষের কাছে সংরক্ষিত নেই । বিগত কয়েকশো বছরে উল্লেখযোগ্য কিছু বিপ্লব হলো আমেরিকান বিপ্লব (১৭৬৫-১৭৮৩), ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯), হাইতিয়ান বিপ্লব (১৭৯১-১৮০৪), ল্যাটিন আমেরিকার স্বাধীনতা বিপ্লব (১৮০৮-১৮৩৩), ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৮৫৭-১৮৫৮), রুশ বিপ্লব (১৯১৭), চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লব (1945–1949), ইরানী ইসলামি বিপ্লব (1979), কিউবান বিপ্লব (1953–1959) । এ সকল বিপ্লব ব্যাপক রক্তপাত, প্রাণহানি , সংঘাত ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে । ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আরব বিশ্ব ও পূর্ব ইউরোপের বিপ্লব পর্যালোচনা করলেও এমনটাই দেখা যায়।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে যে বিপ্লব হয়েছে, সেখানে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনকে হটিয়ে বিপ্লবের ১ম ধাপ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে । তবে বিপ্লবকে চূড়ান্তধাপে উত্তীর্ণ করে একটি বৈষম্যমুক্ত সার্বভৌম, উন্নত বাংলাদেশে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলমান আছে । বিপ্লবের ক্ষেত্রে মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে আকাশচূম্বি । কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হতে দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার । এজন্য বাংলাদেশও একটি গঠন, পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে । প্রশ্ন হতে পারে, এই বিপ্লবের সময়কাল কত বছর ধরে অব্যাহত থাকবে । এখানেই প্রশ্ন আসে বর্তমান অন্তর্বতী সরকার, পরর্বতী নির্বাচিত সরকার, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আপামর ছাত্রজনতা, বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর ভূমিকার কথা । এই সকল কিছুর উপরই নির্ভর করবে বিপ্লবের চূড়ান্ত সার্থকতা । বিপ্লব চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে, এই জনপদ আবারও ব্যাপক রক্তপাতের মুখোমুখি হতে পারে এবং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব চূড়ান্তভাবে ব্যাহত হতে পারে । বস্তুত, ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করবে না বরং প্রত্যেকের ভূমিকার কথা ইতিহাসে যথার্থভাবে স্থান পাবে। কিন্তু আমরা এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি যে, এই বিপ্লবকে কোনক্রমেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না । বরং কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা পক্ষ যদি বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তবে বাংলাদেশের আপামর ছাত্রজনতা তাকেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিপ্লবকে চূড়ান্ত সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে । এ সফল বিপ্লবকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টার অনেক প্রমাণ ইতোমধ্যেই ছাত্রজনতা দিয়েছে। বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আপামর ছাত্রজনতা কয়েকটি ফ্যাসিবাদী চক্রান্ত নস্যাৎ করেছে। আপামর জনসাধারণকে ধারাবাহিকভাবে জাগ্রত ও সচেতন থাকতে হবে । প্রয়োজনে বিপ্লবের ভ্যানগার্ড হিসেবে জাগ্রত থেকে বিপ্লবকে সফলতার মনজিলে মকসুদে পৌঁছে দিতে হবে ।
৩৬ জুলাইয়ের (৫ আগস্ট) বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবালবৃদ্ধবনিতা তথা সর্বস্তরের মানুষ স্মরণকালের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা উপলব্ধি ও উপভোগ করছে । কিন্তু এখন রাজনৈতিক দল, দলীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবী নামের কিছু অসৎ চরিত্রহীনরা রক্তের মাধ্যমে অর্জিত মহান জুলাই বিপ্লবকে অস্বীকার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে । ৫ই আগস্ট ফ্যাসিবাদ পতনের পর পরই বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে বাংলাদেশের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়ে ১টি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়েছিলেন যেখানে তিনি মোট ৮বার বিপ্লব শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু একটি বারের জন্যও তিনি অভ্যত্থান বা গণঅভ্যুত্থান শব্দটি ব্যবহার করেন নি । জনাব তারেক রহমান কি তখন না বুঝেই বক্তব্য দিয়েছিলেন? নিশ্চিয়ই নয় বরং বিপ্লবকে স্বীকৃতি দিয়ে শহীদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মতো উদারতা তারেক রহমান দেখিয়েছিলেন । কিন্তু এখন বিভিন্ন ব্যক্তি বিংবা গোষ্ঠীর মধ্যে যেভাবে বিপ্লবকে অস্বীকার করার তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রবণতা শুরু হয়েছে তাতে বিপ্লবের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে এবং এক সময় বিপ্লব চূড়ান্তভাবে সফল হয়ে বাংলাদেশ উন্নত, সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে স্থিতিশীলতার পথেই এগিয়ে যাবে । কিন্তু যারা বিপ্লবকে অস্বীকার ও অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে উদ্যত হয়েছেন তারা মূলধারা থেকে ছিটকে যাবেন এবং ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন । এমনকি পরবর্তী নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোই সেই সব রাষ্ট্র বিরোধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবে বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমরা শুধু জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের রক্তের হিস্যা চাচ্ছি না বরং ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত হওয়া সকল হত্যাকান্ড, গণহত্যা, অন্যায়-দুর্নীতি, গুম, দুঃশাসন ও রক্তপাতের হিস্যা চাচ্ছি । ২০২৪ সালে বৈষম্যের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন, সরকার পতনের ১ দফা দাবি ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের চূড়ান্ত লক্ষ্যে একটি সফল বিপ্লবের মাধ্যমে ১ম ধাপ সম্পন্ন হয় ।
নিচে ৫ই আগস্ট প্রদত্ত তারেক রহমানের জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো যেখানে তিনি সচেতনভাবেই প্রত্যেকবার ‘বিপ্লব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন: “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম । আসসালামু আলাইকুম । গৌরবজনক এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে বাংলাদেশের সাহসী ছাত্রজনতাকে বীরোচিত অভিনন্দন । হাজারো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে জনতার ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণহত্যাকারী খুনি হাসিনার পতন হয়েছে । রাহুমু্ক্ত হয়েছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ । জনতার বিপ্লবের প্রথম ধাপ চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছে । লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ কখনো পরাজয় মানতে পারেনা । এই ঐতিহাসিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে দল মত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকলে এই বাংলাদেশকে কেউ কখনো পরাজিত করতে পারেনা, পারবে না । প্রিয় দেশবাসী, বিজয়ের এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে আমি আজ সেই সব মায়েদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই গণবিপ্লবে যারা তাদের প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছেন । এভাবে গত ১৫ বছরে ফাসিবাদী শাসনকালে অনেক সন্তান তার প্রিয়তম পিতাকে হারিয়েছেন, অনেক স্ত্রী প্রিয়তম স্বামী হারিয়েছেন । গুম, খুন, অপহরণ করে অসংখ্য মায়ের বুক খালি করে দেওয়া হয়েছে । আপনাদের সন্তানদের শহীদী মৃত্যু, স্বজনদের ত্যাগ, তিতীক্ষায় ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট প্রিয় বাংলাদেশ আরেকটি বিজয় দেখেছে । জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব সফল করতে গিয়ে অসংখ্য ছাত্রজনতা আহত হয়েছে । বাসায় হাসপাতালে কিংবা ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন যন্ত্রণাবিদ্ধ সময়ে সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে আপনাদের পাশে আজ সারা বাংলাদেশ । খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ মিথ্যে মামলা কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত মামলায় গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন, কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন । আমি অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার এবং তাদের কারামুক্তির দাবি জানাচ্ছি । একই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা যাতে আবার স্বাভাবিকভাবে হলে, হোস্টেলে, ক্লাসে ফিরতে পারেন, পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন আশা করি সেই পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করা হবে। প্রিয় দেশবাসী, দেশের ১৮কোটি মানুষকে জিম্মি করে, সাড়ে ১২ কোটি ভোটারের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল । হত্যাকারী, গণহত্যাকারী খুনী হাসিনার পতনের মধ্যে দিয়ে জনগণ তাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, লুন্ঠিত ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছে । এর মধ্যে দিয়ে জনগণের বিপ্লবের ১ম ধাপ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এরপর একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেদিন দেশের ১২ কোটি ভোটার নিরাপদে নিশ্চিন্তে ভোট দিয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, রাষ্ট্র, সরকার শাসন প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, সর্বোপরি একটি গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে পারবে তখনই জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের চূড়ান্ত সফলতা আসবে ।
প্রিয় দেশবাসী, জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাই যথা সম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অবশ্যই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে । একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য বিএনপিসহ বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল সব রকমের সহযোগিতা করবে ।
প্রিয় দেশবাসী, এবার আমি আপনাদের কাছে একটি বিনীত আহ্বান রাখতে চাই । বিজয়ীর কাছে পরাজিতরা নিরাপদ থাকলে বিজয়ের আনন্দ মহিমান্বিত হয় । সুতরাং, বিজয়ের এই আনন্দঘন সময়ে, রাহুমুক্তির এই ঐতিহাসিক মুহুর্ত শান্তভাবে উদযাপন করুন । অনুগ্রহ করে কেউ প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসা পরায়ণ হবেন না, কেউ নিজের হাতে দয়া করে আইন তুলে নিবেন না । অর্জিত বিজয় যাতে লক্ষ্যচ্যুত না হয় সে ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে । ৫২, ৭১ কিংবা ৯০ এর মতো ছাত্রজনতা আবারও একটি বিজয়ের ইতিহাস রচনা করেছে। প্রিয় দেশবাসী, আবারও আপনাদের সকলকে বীরোচিত অভিনন্দন । আল্লাহ হাফেজ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, বাংলাাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জিন্দাবাদ।”
এখন জনাব তারেক রহমানও যদি বিপ্লবকে অস্বীকার করেন, তবে জনগণের মধ্যে তো এই সন্দেহ দানা বাঁধবে যে তারেক রহমান নিজেও ফ্যাসিবাদী শক্তি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিরোধী বিদেশী শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন কিংবা ক্ষমতার মোহে লালায়িত হয়ে জুলাই বিপ্লবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন । অথচ, দীর্ঘ সংগ্রাম এবং জুলাই বিপ্লবে তারেক রহমান ও তার দলের ভূমিকা অত্যন্ত সুদূর প্রসারী ও অপরিহার্য । তারেক রহমান ও তার দলকে এ সকল বিষয় ভেবে দেখার সময় এসেছে । অন্যথায়, ক্ষমতার রাজনীতিতে বিএনপি যে কোণঠাসা হতে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই যা ইতোমধ্যে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও অকপটে স্বীকার করেছেন। উন্মুক্ত জনপরিসর ও ডিজিটাল জনপরিসরে এখন শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীই নয় বরং সকল নাগরিক অবাধে অংশগ্রহণ ও বিচরণ করছে । একই সাথে এখানে আছেন নানা স্বার্থ চরিতার্থকারী গোষ্ঠী বা উপগোষ্ঠী । এসব বিষয়ে যেমন সচেতনতা অপরিহার্য, একই সাথে প্রকৃত তথ্যপ্রাপ্তির জন্য বিশ্বস্ত ফ্যাক্ট চ্যাকিং ব্যবস্থাও অনস্বীকার্য। সবকিছু মিলে সকলের জন্যই বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে যা শুধুমাত্র দোষারোপ করে নিবৃত্ত করা যাবে না । আবার, জনগণ অবাধ মত প্রকাশের যে স্বধীনতা পেয়েছে তা কেউ হারাতে চাইবে না । যদিও কোন স্বাধীনতাই অসীম নয়, তবুও তা নতুন বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে । ইতিহাসের ধারাবাহিকতিায় ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৯০ কে যেমন অস্বীকার করার সুযোগ নেই, তেমনি ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকেও অস্বীকার করার সুযোগ নেই । বরং জুলাই বিপ্লবকে অস্বীকার করলে ইতিহাসও বিপ্লবকে অস্বীকারকারী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে । এটাই ইতিহাসের শিক্ষা !
মুসলিম লীগ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে তা খন্ড বিখন্ড হয়ে নাম সর্বস্ব রাজনৈতিক দল হিসেবেই টিকে আছে । বর্তমানের এই প্রযুক্তি বিপ্লবের যুগে এই পতন হওয়ার সম্ভাবনা আর দ্রুততর হবে এবং কোন দল সহজেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারবে না । স্বৈরাচারী হতে গেলেই প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে । রাজনীতি এবং ক্ষমতা কোন তাৎক্ষণিক ও অগভীর বিষয় নয় বরং এটি দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্র । যত পুরাতন কিংবা জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলই হোক, ক্ষমতায় গিয়ে গণআকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে কাজ করলে দ্রুতই পতন ঘনিয়ে আসবে যার সুযোগ নিবে সম্ভাবনাময়ী রাজনৈতিক বয়ান ও আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠা নতুন রাজনৈতিক দলগুলো । বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও জামায়াত এ বিয়ষগুলো বিবেচনায় নিয়েই আগামী দিনের রাজনৈতিক বয়ান ও কৌশল গ্রহণ করবে নিশ্চয়ই !
নেতা ও পদ সর্বস্ব প্রথাগত রাজনীতি চর্চা যে এখন আর আগের মত কাজ করবে না তা নিশ্চয়ই জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে নতুন নজির উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে । আগামী দিনের রাজনৈতিক গবেষণা্, একাডেমিক রাজনৈতিক ডিসকোর্সে তা যে দৃষ্টান্ত হিসেবে আলোচিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
যদি জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন না হতো তবে ফ্যাসিস্ট, খুনি, গণহত্যাকারী, ধর্ষক, দখলবাজ, মতলববাজ, সন্ত্রাসী, ভোটচুর ও দুর্নীতিবাজরা বুক ফুলিয়ে এখনো জনজীবনের সর্বস্তরে আগ্রাসীভাবেই বিচরণ করতে পারতো ! কিন্তু বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের অভিশপ্ত পতনের কারণেই তা আর সম্ভব হচ্ছে না । এতে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি এসেছে বিএনপি ও জামায়াতসহ সকল রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যেই । কিন্তু ক্ষমতার প্রতি লালায়িত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের উপর অর্পিত ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দায় ও কর্তব্য থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে বাংলাদেশকে এক নতুন রক্তাক্ত সংঘর্ষের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে । প্রশ্ন উঠেছে, জনগণকেই কি তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুল ও গাদ্দারি বারংবার রক্তের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে? এদেশের মানুষ কি একটি শান্তিপূর্ণ সুখী সমৃদ্ধ জীবন আশা করতে পারবে না? উপদেষ্টা পরিষদের কতজন জুলাইয়ে রক্ত দিয়েছেন? কতজন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি কিংবা তাদের সন্তান জুলাই বিপ্লবে রক্ত দিয়েছেন? আপনাদের রক্তই শুধু রক্ত? সংগ্রামী আর মেহনতি ছাত্রজনতার শরীরে কি শুধুই দূষিত পানি যে তা শরীর থেকে বের হয়ে গেলে আনন্দ হয়?
১৯৭৫ এর ৭ই নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল তা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ড এবং সামগ্রিকভাবে বিপ্লবকে ধারণ করতে না পারার জন্যই ব্যর্থ হয়েছিল । ৩৬ জুলাইয়ের বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের ফলে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ নিঃসন্দেহে স্মরণকালের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা উপলব্ধি ও উপভোগ করছে । এখন এই বিপ্লবের সুমহান সুযোগকে পূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে তেমনটাই আকাঙ্ক্ষা করে এদেশের আপামর শোষিত, বঞ্চিত, অসহায় ও নিপীড়িত মানুষ । আর এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকেই । সকল গণহত্যার বিচার ও ক্ষতিপূরণ, আওয়ামী লীগের ভূমিকার মূল্যায়ন, গণপরিষদ নির্বাচন ও সাংবিধানিক পুনর্গঠন, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, রাষ্ট্রের অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণ, স্থিতিশীল ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সুশাসন, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি গ্রহণ—এই প্রশ্নগুলির সমাধান না হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে পারবে না।
মূলত, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীভাবে দাঁড়াতে না পারলে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের জন্যই তা কল্যাণ বয়ে আনবে না ! বরং তা একটি ফল্ট লাইন হিসেবে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করবে যাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে আধিপত্যবাদী ভারত ও বাংলাদেশের শত্রুরা! তারা তো এটাই চায় যে, বাংলাদেশ যেন স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়াতে না পারে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ যেন চলতেই থাকে বিগত ৫৪ বছরের বাস্তবতা এটাই প্রমাণ করেছে ।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, আমরা কোন সুস্থ প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাইনি যারা পরমাণু শক্তিধর, নিজেদেরকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী দাবি করলেও তারা অব্যাহতভাবে বাংলাদেশকে পদানত রাখতে হেন কোন প্রচেষ্টা নাই যা করে নাই বা ভবিষতে করবে না । এটা বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্যই একটা রেড লাইন, এই লাইন কেউ অতিক্রম করলে সেই দলের আর কোন রাজনৈতিক বয়ান অবশিষ্ট থাকবে না । অবশ্যই আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে পারষ্পরিক স্বার্থ ও সম্মানের ভিত্তিতে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবো । বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে আধিপত্যবাদী ভারতের হাতে তুলে দেওয়ায়, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের রাজনীতি ব্যর্থ হয়ে গেছে, একই সাথে পরাজিত হয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদ । এখন কেউ যদি আবার ভারতকে সেই সুযোগ করে দিতে চায় সেই ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের কোন রাজনীতিই আর বাংলাদেশে অবশিষ্ট থাকবে না ।
আমরা এখন একটু বিপ্লবের দিকে লক্ষ্য করি, ‘বিপ্লব’ হচ্ছে এমন একটি রূপান্তরের প্রক্রিয়া যা পুরাতন বুনিয়াদকে নতুন করে গঠন করে। ফ্যাসিবাদ আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোকে এমনভাবে ধ্বংস ও কলুষিত করেছে যে, আমরা তা অপরিবর্তিত রাখবো? বরং বিপ্লবরে এই সুমহান সুযোগকে কাজ লাগিয়ে আমাদের রাষ্ট্রকে গড়ে তুলাই এখন সকলের ঐতিহাসিক দায় ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । বস্তুত গণতন্ত্র ও বৈপ্লবিক পদ্ধতির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। বরং উভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। বস্তুত বিপ্লব থেকে এই গণতন্ত্রের ধারণাটির উদ্ভব হয়েছে।
হার্বার্ট আপ্থেকার (Herbert Aptheker) বলেছেন: “গণতন্ত্র বলতে যদি জনসাধারণের ব্যাপক ভূমিকাকে বোঝায় তাহলে বিপ্লবের মধ্যে এই গণতন্ত্রের নির্যাস নিহিত আছে। বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া এবং তার পরিণতি গণতন্ত্র বিরোধী তো নয়ই বরং গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শের পরিপোষক। বিপ্লবের প্রকৃতি যত মৌলিক হবে, গণতন্ত্রও তত গভীর ও ব্যাপক হবে। সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের ধারণাও প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হবে।” আপ্থেকার আরো বলেছেন: “মৌলিক বিপ্লব সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষের নিবিড়তম সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের ফলে বিস্তৃত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কারণে বিপ্লব হল স্বদেশজাত এবং সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রসম্মত।” হার্বার্ট আপ্থেকারের মতানুসারে, “অতীতের সকল ঐতিহাসিক বিকাশের মধ্যে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াই হল সর্বাধিক গণতন্ত্রসম্মত।”
নিঃসন্দেহে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে বাংলাদেশে একটি মহান বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে । এখন কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল তা অস্বীকার করলে নিশ্চয়ই তিনি বা সেই দল জনগণ থেকে ছিটকে পড়বেই । কেননা, জুলাই বিপ্লবের রূপান্তর প্রক্রিয়া এখনও ক্রিয়াশীল আছে । যতদিন না বিপ্লব চূড়ান্তভাবে সফল হয়ে এই ভূখন্ডের মানুষদের মুক্তির প্রকৃত স্বাদ দিবে ততদিন বিপ্লবের ধারাবাহিকতা বহমান থাকবেই । যারাই বিপ্লবের মৌলিক দাবিকে অস্বীকার করবেন তারাই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন । অনিবার্য বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল, তাই ক্ষমতাই চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া অনুচিত বরং জুলাই বিপ্লবের সুমহান সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর হলেই কেবল সকলের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় আরোহন ও ক্ষমতা হস্থান্তর প্রক্রিয়া নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর হবে ।
১৭৫৭ সালে পলাশীর মর্মান্তিক পরিণতির পর ১৯০ বছরের পরাধীনতা, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র হলে পূর্ব পাকিস্তান নামে ভূখন্ড পেলেও তদানীন্তন শাসকশ্রেণীর দুঃশাসন, সামরিক শাসন ও ১৯৭১ সালের গণহত্যার নির্মম পরিণতি, মু্ক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও গণমানুষের মুক্তি আসেনি আজও । বাকশালকে আজও ফ্যাসিবাদীরা দ্বিতীয় বিপ্লব বললেও ৩৬ জুলাইকে বিপ্লব বলতে জ্ঞানপাপীদের মধ্যে যে হীনমন্মতা তার জন্য অনিবার্যভাবে দায়ী সকলকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হবে।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় জার নিকোলাসের পতনের পর রুশ উদারপন্থী এবং সমাজতন্ত্রী দলগুলো মিলে সরকার গঠন করেছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল রাশিয়াকে একটি আধুনিক পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পথে নিয়ে যাওয়া। তাদের কথায়, তাদের নীতির মূল আদর্শ ছিল ফরাসী বিপ্লব। ১৯১৭ সালের ৩রা এপ্রিল ১০ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে সেন্ট পিটার্সবার্গ তথা পেত্রোগ্রাদে আসেন ভ্লাদিমির লেনিন। শুরু থেকেই লেনিন অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত করার ডাক দিতে থাকেন। কারণ তার ভাষায় ঐ সরকার ছিল একটি বুর্জোয়া পুঁজিবাদী সরকার। অক্টোবরের শুরুর দিকে অন্তর্বতী সরকার প্রধান ক্রেনেস্কির কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ে। অন্যদিকে, লেনিনের চাপে বিপ্লবী বলশেভিকরা একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য এক গোপন প্রস্তাব পাস করে। লেনিন জোর দিয়ে বললেন, ‘যা করার দ্রত করতে হবে।’ তিনি ঠিক করলেন রাশিয়ার পুরোনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অক্টোবরের ২৫ তারিখ অভ্যুত্থান হবে। যা ইউরোপিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৭ই নভেম্বর। পেত্রোগ্রাদে মোতায়েন সামরিক বাহিনীর লোকদের মধ্যে যে বলশেভিক সমর্থকরা ছিল – তাদের দিয়ে রাজধানীতে সশস্ত্র পাহারা বসানো হলো। এর পর বলশেভিকরা শীত প্রাসাদ আক্রমণ করলো, ক্রেনেস্কির অবশিষ্ট কয়েকজন মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হলো। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা সোভিয়েত শাসনকে একদলীয় একনায়কতন্ত্রে পরিণত করলো। ক্রেনেস্কি তখনো মনে করতেন, ‘বলশেভিক শাসন বেশি দিন টিকবে না।’ তাই অভ্যুত্থানের পর তিনি গ্রামে চলে গেলেন এবং সৈন্য সংগ্রহ করে লেনিনের অনুগত বিদ্রোহীদের আক্রমণের চেষ্টা করলেন। যখন সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো, ক্রেনেস্কি রাশিয়া ছেড়ে পালালেন। বাকি জীবন নির্বাসনেই কাটাতে হয় ক্রেনেস্কিকে। তিনি মারা যান নিউইয়র্কে ১৯৭০ সালে। (সূত্র: বিবিসি অনলাইন)।
জারের পতনের পর অন্তর্বতী সরকার প্রধান ক্রেনেস্কির জনপ্রিয়তা লেনিনের চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে তার পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল। ফলে অনিবার্যভাবে সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র নতুন করে সুবিন্যস্ত না করে বসে থাকার আর কোন বিকল্প নেই!
ইতিহাসে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এটাও যে, ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার নায়ক, যাকে কিনা সর্ব সাধারণ জাতির পিতার আসনে বসিয়েছিল, যিনি সকল ক্ষমতা কেন্দ্রে বসে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন, সেই সুকর্নই শেষকালে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবনের শেষ অধ্যায়ে গিয়ে মানুষের মনে খলনায়কের আসন পেয়েছেন, অথচ তিনি ইন্দোনেশিয়ানদের মহানায়ক হয়েই ইতিহাসে অমর হতে পারতেন!” (সূত্রঃ নিউজজি২৪)
“ক্ষমতা গ্রহণের পর সুকর্ন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই প্রতিবিপ্লবীদের রাজনীতি করার মাঠ খুলে দেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি তাদের নিজের প্রশাসনে স্থান দেন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি জায়গায় বসিয়ে রাখেন। তিনি নিজ দলের ভিত্তি দুর্বল করে একটি সর্বদলীয় মোর্চা গঠন করেন, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল শত্রু ও প্রতিবিপ্লবীরা। যাদের নিশ্চিহ্ন করা দরকার ছিল, কিংবা অন্তত কারাগারে পাঠানো প্রয়োজন ছিল, তাদের তিনি বরং ক্ষমতার অংশীদার বানিয়ে প্রতিপালন করেন। সকল পক্ষকে খুশি রাখতে গিয়ে সুকর্ন নিজেই একঘরে হয়ে পড়েন। ফলে ১৯৬৫ সালে প্রথম আঘাত যখন আসে—অর্থাৎ প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়—তখন তাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি; উল্টো সবাই একত্র হয়ে তার বিরুদ্ধেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে প্রাণ হারায় ১৯ লাখ নিরীহ ইন্দোনেশিয়ান মানুষ।” (সূত্রঃ ইটিভি অনলাইন)
সর্বস্তরের ছাত্রজনতা ড. ইউনূসের নেতৃত্বকে মেনে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে সমর্থন দিলেও সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেই জুলাই বিপ্লবকে সুসংহত করতে হবে। অন্যথায়, ক্ষমতার পালাবদল হলে অন্তর্বতী সরকারকেও বিচারের মুখোমুখি করার বীর্য থেকেই যাবে । একটি সফল প্রতিবিপ্লব হলে আবারও রক্তপাত হবে, আর যদি বিপ্লবের পক্ষেই বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার জন্য আরও একটা বিপ্লব হয় তখনও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না ! সেই বিপ্লবে কোটি কোটি মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে, বিষয়টি মোটেও তেমন না । ১৯৫৯ সালে কোটি কোটি মানুষ মিলে কিউবার সফল বিপ্লব ঘটাননি ।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মিলনস্থলের রাষ্ট্র হওয়ায় দেশি বিদেশি শত্রুরা বাংলাদেশের ভিতরেই আছে । এখানকার একটি সুবিধাবাদী অংশ তাদেরই দলভুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে! বাংলাদেশে পুরাতন এবং অনেক সুবিধাবাদী আমলারাই প্রশাসন যন্ত্রে আছে । অনেক আমলা, অফিসার, রাজনীতিবিদও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ না করে হানি ট্র্যাপে মারাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়েছেন । এখন তাদের উচিত জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া নয়তো রাজনীতি কিংরা রাষ্ট্রীয় পদ স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়া । বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত আসতে পারে এমন কোন কিছুতে তাদের কোনক্রমেই জড়িত হওয়া হবে খুবই ধ্বংসাত্মক । বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের শত্রুরা দেশের ভেতরে ও বাইরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে । এখন যদি প্রশ্ন তুলি, ড. ইউনূসের জীবন কি নিরাপদ? জনাব তারেক রহমান দেশে আসলে তার জীবন কি নিরাপদ থাকবে? অন্তর্বতী সরকারের ভেতরেই কি রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবিপ্লবী অপতৎপরতা নাই তো আবার? জুলাই বিপ্লবের আগে উপদেষ্টা, বিভিন্ন কমিশন ও সরকারে থাকা ব্যক্তিরা ফ্যাসিবাদী আমলেও কি সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে জীবনযাপন করেননি? তা না হলে সরকার বিপ্লবের উপযুক্ত রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক সংস্কার ঘটাচ্ছেন না কেন? ড. ইউনূস কোন কোন বাঁধার মুখে মৌলিক কাজ করতে মারাত্মক অসুবিধা হওয়ায় পদত্যাগের মতো সিদ্ধান্তের কথা চিন্তা করেছিলেন? পরবর্তী কোন সরকার ক্ষমতায় এসে বিপ্লবের বিরুদ্ধে গেলে, ফ্যাসিবাদী হওয়ার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধেও ছাত্রজনতাই রুখে দাঁড়াবে নিশ্চয়ই । ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে হটিয়ে যে রাজনৈতিক গণসচেতনতা তৈরি হয়েছে, জনগণ কি কাউকে এতোটা ফ্যাসিস্ট হওয়ার আর কোন সুযোগ দিবে? অন্তবর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কারে কে কোন বিষয়ে একমত কিংবা দ্বিমত সে বিষয়ে জাতির সামনে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে । তাহলে বিপ্লবের মৌলিক পরিবর্তন ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে কোন কোন উপদেষ্টা দ্বিমত তা কেন জনগণের সামনে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে প্রকাশ করা হবে না? রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের পরীক্ষা হবে আর উপদেষ্টারা পরীক্ষা না দিয়েই বিপ্লবের বিরুদ্ধে নেপথ্যের অপশক্তি হিসেবে কাজ করবে তা কি আমরা আদৌ মেনে নিবো? সর্বস্তরে সুশাসন, ইনসাফ এবং ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা না করেই সরকারের পরিবর্তন হলে অন্তর্বতী সরকারের কোন উপদেষ্টা কিংবা সরকারে থাকা অন্য কোন ষড়যন্ত্রকারী দেশ ছেড়ে পালানোর সুযোগ পাবে কি?
হাজারো শহীদ, এতা রক্ত, কান্না, পঙ্গুত্ব, আহতাবস্থায় থাকা পরিবার ও তাদের স্বজনদের মানসিক ট্রমা, ভয়, অচলাবস্থা কাটানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কী কী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এখন পর্যন্ত? তাহলে এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা, এতো মনরোগ বিশেষজ্ঞ, সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে আমাদের জাতির মহান কী অর্জন হবে?
জুলাই বিপ্লব নিয়ে ষড়যন্ত্রের একমাত্র লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে বিপ্লব, শহীদের রক্ত, আহতদের ত্যাগ, স্বজনদের আহাজারি, আপামর ছাত্রজনতার আকাঙ্ক্ষিত উন্নত সমৃদ্ধ, স্বাাধীন সার্বভৌম স্বনির্ভর বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বাদ ধ্বংস করে দিয়ে পুরাতন ধারার নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র কাঠামো বহাল রেখে ভয়ের সংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দুর্বল করে শোষণ ও লোটপাটতন্ত্র অক্ষুণ্ন রাখা । এতে আসলে কার লাভ বা কার ক্ষতি, কে নায়ক বা কে খলনায়ক ইতিহাসই তা নির্মোহভাবে বিচার করবে! তবে এটা সুনিশ্চিত যে বাংলাদেশের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়ীত আপামর মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক তথা সামগ্রিক মুক্তি আসবে না । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষের জাতীয় জীবনে এক সচেতন, জাগ্রত ও সংগঠিত রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার যে অবধারিত বাস্তবতা ও অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা ব্যর্থ করে দিতে দেশ-বিদেশের যারাই অপতৎপরতা চালাবে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে এবং জাগ্রত বাংলাদেশের ছাত্রজনতা নিশ্চয়ই তা কোনক্রমেই হতে দিবে না । এখনই সময় নিজেদের আত্মরক্ষা ও প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করা, এদেশের তরুণ জনশক্তিকে সামরিক প্রশিক্ষণসহ সার্বিক কৌশলপত্র প্রণয়ণ করে তাদেরকে বৈশ্বিকভাবে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করে শক্তিশালী বাংলাদেশ বাষ্ট্র গঠন করা । আগামীর আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে বা যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসুক, বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বার্থে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিরল বিশ্ব নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতাকে বাংলাদেশের পক্ষে কাজে লাগানের ঐতিহাসিক সুযোগকে কার্যকরভাবে সাদরে গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাই।
ড. ইউনূসের সরকারকে তথা বাংলাদেশকে ব্যর্থ করে দিতে একদিকে যেমন অপতৎপরতা চালাচ্ছে সরকার ও প্রশাসনের ভিতরেরই একটি চক্র তেমনি অপতৎপরতা চালাচ্ছে আর্ন্তাতিক চক্রও। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কোন একক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা একক রাজনৈতিক দলের সরকার নন বরং বহু সংগ্রামের পথ পেরিয়ে রক্তের মাধ্যমে অর্জিত জুলাই বিপ্লবের ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত আপামর জনগণের সরকার । তবে উপদেষ্টা পরিষদের ভিতরেও যে ড. ইউনূস সরকার বিরোধী অপতৎপরতা নেই তা বলা যাচ্ছে না! বরং সরকার ও কমিশনের নানা কার্যক্রমে সেই ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে জনমনে। সরকারে মধ্যে যদি এমন কোন অনুগত অনুচর প্রবেশ করে থাকে তবে ড. ইউনূস যেন অতিসত্তর সেই বিশ্বাসঘাতককে সরকার বা উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বের করে দেন সেটাই আপামর ছাত্রজনতার প্রাণের দাবি ।
দেশে আমলাদের বিশাল একটি অংশ শুধু ভারতীয় মনোভাবাপন্নই নয়, তারা ভারতীয় মনমানসিকতা ও সফট সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছে, ভারতীয় ভাবাপন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করে সেই ধারার কাঠামোতে কাজ করতে অভ্যস্ত রয়েছে, ভারতীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের সফট বয়ান তাদের মন মগজে মিশে আছে । ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি আমলাদের একটা বড় অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি চাকুরি পেয়ে ফ্যাসিবাদের পক্ষেই কাজ করেছে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে, অত্যন্ত আনন্দ ও আত্মবিশ্বাসের সাথে যে, তাদের প্রিয় ফ্যাসিবাদী নেত্রীই আমৃত্যু প্রবল প্রতাবের সাথে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবেই থাকবে!
ছাত্রজনতার প্রাণের দাবি ছিল যে, রক্ত ও বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত এবং প্রতিষ্ঠিত সরকার আপামর শিক্ষার্থী, বেকার তরুণ-তরুণীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা, চাকুরির বাজার উন্মুক্তকরণ ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাবেন নিশ্চয়ই । সাহসী দেশপ্রেমিক ও মেধাবী তরুণদের নিয়ে নতুন প্রশাসন গড়ে তুলবেন। একটি শক্তিশালী সুশৃঙ্খল বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই তাঁরা বাহু উন্মুক্ত করে, দুই হাত দুপাশে মেলে সাহসী বুকের উদার জমিন বুলেটের সম্মুখে পেতে দিয়েছিল । তাঁদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, সরকার দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে স্থিতিশীল সমাজ ও সুশাসিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতার পথে নিয়ে যাবেন । সকলের দ্বিধা, ভয়, সংশয় দূর করে মানুষকে চিন্তা, মুক্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও স্বাধীনতার প্রকৃত নির্যাস উপলব্ধি করাবেন । কিন্তু সরকার যেমন তা করতে সফল হচ্ছে না, এমনকি সদিচ্ছারও যে ঘাটতি আছে তা উপদেষ্টাসহ কিছু সরকারি দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তিদের গতিবিধি থেকে সহজেই স্পষ্ট হয় । অন্যদিকে, সরকারের কার্যক্রমকে বাঁধা সৃষ্টি করতে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও কি দায়ী নয়? রাজনৈতিক দলগুলো এটা কতটুকু উপলব্ধি করছে যে, সুশাসনের জন্য রাষ্ট্রের কার্যকর রূপান্তর ঘটাতে না পারলে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি, জামায়াত বা যেই দল কিংবা জোটই ক্ষমতায় আসুক তারা স্থিতিশীলতার সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে সক্ষম হবে না । কেননা, বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোতে কোন রাষ্ট্রই সুশাসন ও টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত হতে পারবে না ।
আমরা যদি বিএনপি’র আপত্তিনামা দিকে তাকাই তবে দেখতে পাই যে, মৌলিক সংস্কারে আপত্তি, আগে স্থানীয় নির্বাচনে আপত্তি, ৭২ এর সংবিধান বাতিল ও গণপরিষদ নির্বচনে আপত্তি, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে আপত্তি, রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর অপসারণে আপত্তি, ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে আপত্তি, জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে আপত্তি, জুলাই বিপ্লবীদের স্বীকৃতি দিতে আপত্তি, আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আপত্তি, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনেও আপত্তি, ইসলামী দল প্রধান বিরোধী দল হলে আপত্তি, বিএনপির লোক ছাড়া সরকারী পদে আপত্তি, এক কথায় বলতে গেলে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও বিপ্লবের সকল প্রত্যাশা পূরণেই যেন আপত্তি দলটির। ক্ষমতায় গেলে এমন একগোয়েমি আচরণ এই দলটিকে স্বৈরাচারে পরিণত করতে পারে কেননা এগুলোই স্বৈরাচার হওয়ার আলামত! ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশে যেই পরিমাণ লুটপাট, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও মারামারির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তার অধিকাংশই হয়েছে দলটির নেতা-কর্মীদের দ্বারা! ওনারা সব বাদ দিয়ে শুধু দ্রুত নির্বাচনের জিকির তুলে অন্তর্বর্তী সরকারকে এক মুহূর্তও স্থির হয়ে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন না, অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, কোন সংস্কার ছাড়াই যেনতেন উপায়ে একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের সকল দখলদারিত্বের বৈধতা অর্জন করতে অস্থির হয়ে পড়েছেন তারা! যেখানে ড. ইউনূসকে সংস্কারে সহযোগিতা করলে নির্বাচনও দ্রুত হয়ে যেতে পারে, তা না করে বিএনপি শুধু নির্বাচন আদায়কেই তাদের একমাত্র দলীয় এজেন্ডায় পরিণত করেছে!
বিএনপি যে ৩১ দফা দিয়েছে অনেক আগে, জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি দিয়ে সেই ৩১ দফা আরও পরিশীলিত করে জুলাইয়ের গণহত্যা ও জুলাই বিপ্লবের বিষয়টি উল্লেখ করেনি সেখানে । বিএনপি’র নেতাদের লাগামহীন নানা অসংলগ্ন বক্তব্য ও সরকারকে অসহযোগিতা করার প্রবণতা স্পষ্ট । শুধু তাই নয় কয়েক মাস না যেতেই জুলাই বিপ্লবকে নিছক সরকার পতনের আন্দোলন ছাড়া অন্য কিছু বলতেই নারাজ বিএনপি! ভবিষ্যতে কোন সরকার ক্ষমতায় এসে জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে বিচার করবে না তার কোন নিশ্চয়তা কিন্তু এখনো নেই! এজন্যই দরকার রাষ্ট্রের কার্যকর রূপান্তর, জুলাই বিপ্লবের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, জুলাই সনদ, সুশাসন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য মৌলিক সংস্কার । অথচ বিএনপি এক্ষেত্রে নিজেদের দোষ খোঁজেই পাচ্ছে না!
এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, সমাজে বিদ্যমান কোন বিপ্লবী সংগঠন না থাকলেই যে বিপ্লব সংগঠিত হবে না বিষয়টা মোটেও এমন নয়। বরং বিপ্লবের বীজমন্ত্র সমাজের ভিতরে অর্ন্তনিহিত থাকে এবং কালের পরিক্রমায় তা ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির জলন্ত লাভার ন্যায় বেরিয়ে আসে । আর কোন সরকার যদি অজনপ্রিয় হয়ে পড়ে বা জনভিত্তি হারিয়ে ফেলে তবে সেই সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে । দমন পীড়ন করে সুদীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা যায় না, যদি না তা এক ব্যক্তির সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হয় বা ওয়ান পার্টি স্টেট হয় । বিশ্বব্যাপী বর্তমানে চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), সিটিজেন জার্নালিজম, বহু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে সরকারের সামগ্রিক স্বচ্ছতা, আইনের শাসন, টেকসই উন্নয়নের জন্য সুশাসনের কোন বিকল্প নেই- তা বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে বা বিভিন্ন দেশে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন । এমনকি যে কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শের ভিতরেই সততা ও ন্যায্যতার শক্তি প্রোথিত না থাকলে ও ধারাবাহিক চর্চা না থাকলে সেই রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে রাষ্ট্রকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে না । পৃথিবীর কোন দেশেই তা সম্ভব হয়নি বরং রাজনৈতিক আদর্শের ভিতরেই সততা ও ন্যায্যতার শক্তি প্রোথিত থাকলে কোন জাতি বা রাষ্ট্র অন্যন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায় এমন নজির শত শত বছর ধরেই পৃথিবীতে ছিল এবং আছে এমনকি ভবিষ্যতেও থাকবে ।
রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের রাষ্ট্র বিরোধী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও তা থাকবে । এজন্য ক্ষমতা জনগণের দিকে বিকেন্দ্রীকরণ হতে হবে । জনগণই প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাবান এবং তাঁদের সম্মিলিত ইচ্ছাতেই রাষ্ট্র ন্যায্যতার পথে পরিচালিত হয় যা সকলের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে সেই উপলব্ধি ও স্বাদ পাওয়ার সুযোগ দেশের মানুষকে করে দিতে হবে । সমাজ ও রাষ্ট্রের ধনী, আধিপত্যবাদী, উচ্চব্ত্তি ও মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষকে স্তিমিত করে আপামর জনগণকে বিশেষ করে প্রান্তিক জনগণকে ক্ষমতা ও সুশাসনের স্বাদ পাওয়ার সুযোগ করতে হবে স্থায়ীভাবে। এমনকি জাতীয় সংসদেও এই মনোপলি ভেঙে জনগণের মাধ্যমেই সকলের বৈধতা নিশ্চিত করতে হবে । এজন্য সচেতন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী তৈরি হওয়া অপরিহার্য । যার জন্য সবাইকে সরাসরি রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করা জরুরি নয় বরং জরুরি হলো আপামর জনগণের মধ্যে সচেতন রাজনৈতিক জাগরণ ।
জুলাই বিপ্লব শুধু সরকার পরিবর্তনের দাবিতে সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি রাষ্ট্রের আমূল রূপান্তরের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছে যেন রাষ্ট্র কোনক্রমেই ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে । সর্বোপরি, সকল বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে রূপান্তর করা যায়।
জুলাই বিপ্লব কি ‘বিপ্লব নাকি নিছক ক্ষমতার পালাবদল’ তা স্পষ্ট করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সফল বিপ্লব বহু বছর স্থায়ী হয়েছে এবং দীর্ঘ সময়ের বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে যেতে হয়েছে । বিএনপি, জামায়াত বা রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যই জুলাই বিপ্লবকে পূর্ণ সফলতার স্তরে উত্তীর্ণ না করেই শুধু ক্ষমতা গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকে তবে জুলাই বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় সেই ক্ষমতালোভী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিপ্লবকে চূড়ান্তভাবে সফল করা হবে । এমনকি বিএনপি বা জামায়াত কিংবা অন্যকোন দল বা জোটের সরকার যদি ক্ষমতায় এসে বিপ্লবের বিরুদ্ধে কাজ করে তবে সেই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে জুলাই বিপ্লবকে সফলতার চূড়ান্ত ধাপে উন্নীত করতেই হবে । জুলাই বিপ্লবের বিপ্লবীরা কোনক্রমেই থেমে থাকবে না ।
ঐতিহাসিকভাবে ‘বিপ্লব’ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কাঠামোয় আমূল ও দ্রুত পরিবর্তন, যা সাধারণত গণঅংশগ্রহণ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। জুলাই ২০২৪ এ কোটি কোটি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছে এবং তারা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন এবং ফ্যাসিবাদের বিলোপের জন্যই আত্মবিসর্জনের ঝুঁকি নিয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক ব্যবস্থা (যেমন: শাসনব্যবস্থা, আইন, অর্থনীতি, রাজনীতি, অপসংস্কৃতি ইত্যাদি) পরিবর্তনের সুমহান অভিপ্রায়েই রাজপথে নেমে এসে আপামর ছাত্রজনতার জাগরণের মাধ্যমে ‘জুলাই বিপ্লব’ সংঘটিত করেছে এবং বর্তমানে জুলাই বিপ্লবের গঠনকাজ চলছে । ফলে এ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই বরং রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তন ও সুশৃঙ্খল রূপান্তরের জন্য কোটি কোটি মানুষের এই সচেতন জাগরণকে অবশ্যই ”জুলাই বিপ্লব” হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এখন এটাকে কেউ ‘জুলাই বিপ্লব’ ‘জুলাই জাগরণ’ ‘জলাই গণবিপ্লব’ ‘জুলাই বিপ্লব’ ‘বর্ষা বিপ্লব’ বলতেই পারে এবং মূলধারার গণমাধ্যম ও ডিসকোর্সে সেগুলো ব্যবহারও হচ্ছে । কিন্তু আমরা সুনির্দিষ্টভাবে ইতিহাসের কাছে দায়মুক্ত থাকার জন্যই সচেতনভাবে এটাকে ‘জুলাই বিপ্লব’ হিসেবেই অভিহিত করছি ।
৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের আগেই বিএনপি ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল কিন্তু বিএনপি-জামায়াতসহ সকল বিরোধী শক্তি মিলেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অবৈধ নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি । ফলে, আপামর ছাত্রজনতার বিপ্লবের মাধ্যমেই ফ্যসিবাদের পতন নিশ্চিত হয় যেখানে বিএনপি-জামায়াতসহ সকল ফ্যসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলেরই অপরিহার্য ভূমিকা ছিল । কিন্তু এমন একটি সফল বিপ্লরের পর সেই বিপ্লবের স্বীকৃতি দিয়ে বিএনপি’র ঘোষিত ৩১ দফাকে পুনর্বিন্যাস ও নবতর রূপে উত্থাপনের প্রয়োজনীতা অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে । বিএনপি ৩১ দফায় সাংবিধানিক ধারাবাহিকা রক্ষার কথা বলেছে কিন্তু গণআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যেই সংবিধান সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন ও বিপ্লব করে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানো হলো সেখানে সাংবিধানিক ধারাবাহিকাতা বজায় রাখলে তো জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সকলের সর্বোচ্চ ফাঁসিও হতে পারে । তবে বিএনপি কি ভবিষতে রাষ্ট্রকে আরও একটি রক্তপাত ও সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে চায়? বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো কি এই বাস্তবতা উপলবদ্ধি করছে না? এ বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে জাতির সামনে পরিষ্কার না করায় আপামর ছাত্র সমাজ ও জনগনের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্ধ ও আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে এবং তা বুদ্ধিবৃত্তিক মহলেও ব্যাপকভাবে আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে ।
এ সকল বিষয় পরিষ্কার না করলে, বিএনপির ক্ষমতায় আসা যেমন কঠিন হবে তেমনি ক্ষমতায় আসলেও বিপ্লব ব্যর্থতার জন্য বিএনপি’কেও দায় নিতে হবে। আর, বিএনপি জনগণের আস্থা হারালে তা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য শুভ নাও হতে পারে । কেননা, গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী সরকারি দল ও বিরোধী দল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এক্ষেত্রে নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো যদি প্রাসঙ্গিক হতে থাকে তবে তা বিএনপি-জামায়াতের মতো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্য ক্ষমতার রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ ও চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই । গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান খুবই স্বাভাবিক কিন্তু তা যদি বাংলাদেশ ভূখন্ডে একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় কিংবা আস্থাহীনতার সংকট সৃষ্টি করে তবে তা বাংলাদেশকে আবারও অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং এই সুযোগটিই নিতে চাইবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফ্যাসিবাদী শক্তি ও বাংলাদেশ বিরোধী বিদেশী শক্তি । এজন্য নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত আগামী সরকারে সকলকে নিয়ে ঐকমতের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার বা এ জাতীয় কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশকেই শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করবে; যা রাজনৈতিক দলগুলো ভেবে দেখতে পারে । আবার, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ হলে সেখানে যেন রাষ্ট্রের সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক কিন্তু তা যেন কোনক্রমেই গণতন্ত্র ও ন্যায়ের মৌলিক ভিত্তিতে দুর্বল না করে সেদিকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে । এ সকল বিষয়ে যথার্থ নীতিগত সিদ্ধান্তের জন্য অতি অবশ্যই বিএনপি-জামায়াতের মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে উদারতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে । রাষ্ট্র কোনো একক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ফসল নয় বরং রাষ্ট্র হলো আপামর জনগণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন । রাজা চতুর্দশ লুই বলেছিলেন ‘আমিই রাষ্ট্র’। এই আমিত্ববোধের জন্যই গিলোটিনে চতুর্দশ লুইকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ।
জনাব তারেক রহমান নিজের একটি বক্তব্যে উল্লেখ করেন তার পিতাকে হত্যা করা হয়েছে, মাতা বেগম খালেদা জিয়াকে সীমাহীন কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তার কনিষ্ঠ ভাইকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে, তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এক দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনে। তিনি বলেছেন এসব ভুলে গিয়ে তিনি ৩১ দফার নিরিখে নির্মাণ করতে চান ভারতের নাগপাশ থেকে মুক্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই বিপ্লব পরবর্তী ৩১ দফা নিয়ে আরও বিস্তৃত চিন্তা ও জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতির প্রয়োজনীতা দেখা দিয়েছে । শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশ, বেগম জিয়ার আপোষহীন সুদীর্ঘ সংগ্রাম তারেক রহমানের হাত ধরে পূর্ণতা পাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ তারেক রহমানের সামনে এসেছে । তিনি যদি তা নির্মোহভাবে করতে পারেন তবে আগামীর বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হবে এবং তারেক রহমান হবেন ইতিহাসের অন্যতম সফল চরিত্র । কিন্তু এটি করার জন্য ওনাকে অবশ্যই দল, মত, চাটুকারিতা ও সংকীর্ণ বৃত্তের বাইরে গিয়ে মেধাবীদের দিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নিতে হবে । তবে তিনি বা তাঁর দল যদি উদারতা দেখানোর নামে ফ্যাসিবাদী শক্তি কিংবা বাংলাদেশ বিরোধী বিদেশী শক্তির সাথে কোন রকম সমঝোতা কিংবা আপোষের চেষ্টা করেন তবে তা হবে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য খুবই আত্মঘাতী । বাংলাদেশকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে কিন্তু কোনক্রমেই বাংলাদেশের স্বার্থের সাথে আপোষ করা চলবে না যা বাংলাদেশের প্রত্যেক ব্যক্তি ও সকল রাজনৈতিক দলের জন্যই একটি রেড লাইন ।
আমরা সাধারণ ছাত্রজনতা যখন খুবই সাদামাটা ও উপরিতলের দৃশ্যমান রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তখন বাংলাদেশ বিরোধী দেশি বিদেশি অনেক শক্তিই রাষ্ট্রের গভীর, জটিল, নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে খেলার সুযোগ পায় । কেননা তারাও জানে যে, জনগণ উপরিতলের দৃশ্যমান, সাদামাটা ও আলোচিত ইস্যুগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন । দেশি-বিদেশি অপশক্তির রাষ্ট্রের গভীরের এ সকল স্পর্শকাতর ও জটিল বিয়য়গুলো নিয়ে খুব বেশি আলোচনাও হবে না বিভিন্ন মহল ও অনলাইন জনপরিসরে। ফলে এভাবে তারা দেশের ভিতরে ও দেশের বাইরের নীতি নির্ধারণী (Policy Making) জায়গাগুলোতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম হয় । ফলে, একদিকে যেমন দেশের মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় তেমনি অন্যদিকে বর্হিবিশ্বের থেকেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বার্তা আসে ।
রাষ্ট্রের সংবিধানে বাংলাদেশের সকল জাতিগোষ্ঠীকেই সমমর্যাদার নৃগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করতে হবে । ফলে বাংলাদেশের কোন নাগরিক বঞ্চিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না এবং নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার, কর্তব্য, আনুগত্য, সুযোগ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকবে । তদুপরি, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার সকল দেশি-বিদেশী অপতৎপরতাও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হবে ।
৩৬ জুলাই নিছক কোনো সরকার পতন আন্দোলন নয়, আমরা অবশ্যই এটাকে মহান বিপ্লব হিসেবেই অভিহিত করি। বিপ্লবের নানান শর্ত পূরণ হয়নি এমন দাবি তুলে অনেক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এটাকে অভ্যুত্থান বলে নিজেদের হীনমন্যতাই প্রকাশ করেন! আমাদের স্পষ্ট অভিপ্রায় হলো- প্রয়োজনে জুলাইকে বিপ্লবের স্বীকৃতি বিষয়ক আদালতের পর্যবেক্ষণ ও রায় দিতে হবে । জুলাইয়ের চলমান এই অপূর্ণ বিপ্লবকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যমেই মহান জুলাই বিপ্লব পূর্ণতা পাবে ।
Discussion about this post