অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
গুম-খুন-ধর্ষণ যেন দেশের নিত্য দিনের ঘটনা পরিনত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দাবী করে আসছেন এর নেপথ্যে বিএনপি জামায়াতের হাত রয়েছে। শেখ হাসিনাতো বরাবর ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে আসছেন, বিএনপি-জামায়াতের শাসনামল থেকে নাকি এদেশে গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সূচনা হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে নাকি এসব গুম-খুন বন্ধ করেছে।
কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। দেখা গেছে জামায়াত বিএনপির আমলে নয় বরং স্বাধীনতা পরবর্তী তথা শেখ মুজিবের শাসনামল থেকে দেশে গুম-খুনের প্রচলন শুরু হয়েছিল।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, শেখ মুজিবের শাসনামলে ধর্ষণ- খুন-গুমের মাধ্যমে বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য মুজিব বাহিনী নামে একটি সন্ত্রাসী-গলাকাটা বাহিনী গঠন হয়েছিল। তারা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিরোধী মতের লোকজনকে ধরে এনে জবাই করে হত্যা করতো। শুধু তাই নয় নিজের পছন্দ হলেই সেই মেয়ে বা বধূকে তুলে নিয়ে ধর্ষনও করা হতো মুজিব আমলে।
এদেশের মানুষ কখনো ভুলতে পারবে না সেই মুজিব বাহিনী আর রক্ষীবাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও সীমাহীন অত্যাচারের কথা। আওয়ামী লীগের সেই ইতিহাস ছিল এক কালো ইতিহাস। মানুষ হত্যার ইতিহাস। মুখ দিয়ে মানবতার কথা বলা আর হাত দিয়ে মানুষ হত্যা করা ছিল আওয়ামী লীগের মূলনীতি। বিনা অপরাধে হত্যা করা হয়েছে শত শত আলেম-ওলামা আর হাজার হাজার নারী-পুরুষকে। মুজিববাহিনীর অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। নির্যাতিত মানুষের আর্তচিৎকারের সেই ধ্বনি যেন এখনো আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগের জুলুম-নির্যাতনের এই ইতিহাস নতুন করে কিছু বলার নেই।
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের আমলের খুন-গুম নিয়ে আহমদ মূসার লেখা ‘স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সূচনা পর্ব: ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’’ নামক বই থেকে পাঠকদের অবগতির জন্য এখানে মাত্র তিনটি ঘটনার উল্লেখ করা হলো।
এক.
কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার ইকোরটিয়াই মুজিব বাহিনীর হাতে নিহত আববাস উদ্দিনের ভাই সামসুদ্দিন বলেছেন, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে শাহজাহান, আজিজ ও বাচ্চুর নেতৃত্বে একদল মুজিব বাহিনীর লোক এসে আমার মায়ের সামনে আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করল। ওরা যাওয়ার সময় বলে গেছে ওর লাশ শৃগাল কুকুরে খাবে, কেউ কবর দিলে তাকেও হত্যা করা হবে। কেউ কাঁদলে তাকেও হত্যা করা হবে। সকালে মেরে ওরা আবার বিকালে এসে দেখে গেছে লাশ কেউ কবর দিয়েছে কি না। কেউ কান্নাকাটি করছে কি না। পরে রাতের আঁধারে গ্রামবাসী বিলে নিয়ে লাশটি পুঁতে রাখে। এই হলো আওয়ামী লীগের মানবাধিকার রক্ষার শ্লোগানের বাস্তব চিত্র।
দুই.
একই এলাকায় মুজিব বাহিনীর নির্মম বুলেটের আঘাতে নিহত হয় রশিদ। রশিদের বাবা আব্দুল আলী বললেন, ওরা আমার কাছে এক হাজার টাকা চাঁদা চাইছিল। আমি গরীব মানুষ। টাকা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিছুদিন পর শাহজাহানের নেতৃত্বে একদল লোক এসে আমার সামনে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। আমার হাতে কুঠার দিয়ে বলল মাথা কেটে দে, ফুটবল খেলব। আমি কি তা করতে পারি? আমি যে তার বাপ। অত্যাচার আর কতক্ষণ সহ্য করা যায়? সহ্য করতে না পেরে অবশেষে নিজ হাতে ছেলের মাথা কেটে দিলাম। আমার ছেলে আওয়ামী লীগ করত না। এটাই ছিল তার অপরাধ।
পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আর কী হতে পারে? ওরা হত্যা করে আবার বাবাকে বাধ্য করেছে ছেলের মাথা কেটে দিতে। ওরা কি মানুষ ছিল?
তিন.
ভেড়ামারার কামালপুর কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ফজিলাতুন্নেসাকে গুলি করে হত্যা করে মুজিববাহিনীর লোকেরা। নিহতের ভাই ফিরোজ আহসান বললেন, তারা আমার বোনকে হত্যা করে আমাদের কাউকে লাশটি দাফন করতে দেয়নি। আমার বাড়িতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের একটি মিটিং হয়েছিল। এটাই আমার বোনের অপরাধ।
শুধু তাই নয় ইতিহাস বলছে শেখ মুজিবের ছেলে হিসেবে শেখ কামালের কুকর্মেরও সীমা ছিলো না। ডাকাতি থেকে শুরু করে ধর্ষণ ছিলো খুব সামান্য বিষয়। মেজর ডালিমের বউকেও তুলে নিয়েগিয়ে ধর্ষণেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়া ইতিহাস বলেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ধর্ষণ করেই কালের বিবর্তনে আজ সে দেশপ্রেমিক।
১৯৭৪ সাল। তখন বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন শিশু রাষ্ট্র। যুদ্ধ পরবর্তী একটি দেশের অবস্থা যতটা নাজুক থাকতে পারে, দেশের ও জনগণের অবস্থা একদম ঠিক তাই। দেশের সর্বময় ক্ষমতা তখন শেখ সাহেবের হাতে। তার কথাই আইন, তার কথাই বিচার। এখন যেমন হাজারও অন্যায় অত্যাচার দেখার পরেও কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। কেউ সাহস করে মুখ খুলতে তার অবস্থা হয় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মত। ঠিক তখনও কারও মুখে কোনো রা শব্দটি নেই। তেমনই এক সময়ে এক নবদম্পতি গাড়ীতে করে যাচ্ছিল গাজিপুর থেকে ঢাকার দিকে। স্বভাবতই চাঁদা কিংবা কে যায় দেখার জন্য গাড়ি থামায় জনৈক মোজাম্মেল। এই থামানোর অধিকার মোজাম্মেলের আছে। কারণ তিনি শেখ মুজিবের লোক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ বানিয়েছেন। গাড়ি থামিয়ে তিনি দেখতে পান সেখানে নতুন বউ। মেয়েটিকে দেখে পছন্দ হয় স্বয়ং মোজাম্মেলের!
তারপরের কাহিনী নিয়মিত ঘটনার মতোই। টঙ্গীর আওয়ামীলীগ নেতা ও দেশপ্রেমিক মোজাম্মেল দলবলসহ গাড়িটি আটক করে। ড্রাইভার আর নববধূর স্বামীকে হত্যা করে। মেয়েটিকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে, অতঃপর তিনদিন পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় টঙ্গী ব্রিজের নিচে।
পৈশাচিক এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় সর্বত্র। বিশেষ অভিযানে দায়িত্বরত মেজর নাসেরের হাতে মোজাম্মেল ধরা পড়ে। মোজাম্মেল মেজরকে বলে- ঝামেলা না করে আমাকে ছেড়ে দিন, আপনাকে তিন লাখ টাকা দেবো। বিষয়টা সরকারি পর্যায়ে নেবেন না। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমি ছাড়া পাবো। আপনি পড়বেন বিপদে। আমি তুচ্ছ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে জড়াতে চাই না। মেজর নাসের হুঙ্কার ছাড়লেন, এটা তুচ্ছ বিষয়? আমি অবশ্যই তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা করবো। তোমার তিনলাখ টাকা তুমি তোমার গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে রাখো।
এরপরের কাহিনী অতি সরল। কুখ্যাত সন্ত্রাসী মোজাম্মেলের বাবা, দুই ভাই গেল শেখ সাহেবের কাছে। তিনি ঢোকা মাত্র মোজাম্মেল এর বাবা ও দুই ভাই কেঁদে তার পায়ে পড়লো। টঙ্গী আওয়ামী লীগ এর সভাপতিও পায়ে ধরার চেষ্টা করলেন। পা খুঁজে পেলেন না। শেখ সাহেবের পা তখন মোজাম্মেল এর আত্মীয় স্বজনের দখলে।
শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করলেন, ঘটনা কি? টঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতি বললেন, আমাদের সোনার ছেলে মোজাম্মেলকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। মেজর নাসির তাকে ধরে নিয়ে গেছে। বলেছে তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দিবে। কাঁদতে কাঁদতে আরো বললো, এই মেজর আওয়ামী লীগের নাম শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে, টঙ্গীতে আমি আওয়ামী লীগের কোন শূয়োর রাখবো না। বঙ্গবন্ধু, আমি নিজেও এখন ভয়ে অস্থির! টঙ্গীতে থাকি না। ঢাকায় চলে আসছি। (ক্রন্দন)
এবার হুঙ্কার ছাড়লেন মুজিব, কান্দিস না। কান্দার মত কিছু ঘটে নাই। আমি এখনো বাইচ্যা আছি তো, মইরা তো যাই নাই। এখনি ব্যবস্থা নিতাছি। অতঃপর মোজাম্মেলকে তাৎক্ষণিক ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মেজর নাসেরকে টঙ্গী থেকে সরিয়ে দেয়ার জরুরী আদেশ দেওয়া হলো। মোজাম্মেল ছাড়া পেয়ে মেজর নাসেরকে তার বাসায় পাকা কাঁঠাল খাওয়ার নিমন্ত্রন করেছিল। (Bangladesh Legacy of Blood, Anthony Mascarenhass, দেয়াল, হুমায়ুন আহমেদ)
এছাড়া, সিরাজ শিকদারকে কারা গুলি করে হত্যা করেছে? শেখ মুজিবের গুন্ডা বাহিনীই সিরাজ শিকদারকে হত্যা করেছি। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডের পর শেখ মুজিব দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেছিল-কোথায় আজ সিরাজ শিকদার?
কিন্তু, সেই গুম-খুন- ধর্ষণের নায়ক শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা আজ বড় গলায় বলছেন যে, তাদের আমলে দেশে কোনো গুম-খুনে ও ধর্ষণের মত কোন ঘটনা ঘটেনি। যা রীতিমত হাস্যকর।
জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুমের শিকার হয়েছেন ৫২০ জন।অথচ, শেখ হাসিনা বলছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোন গুমের ঘটনা ঘটেনি। এমনকি খুন-গুমের সকল দায়ভার তিনি বিরোধী দলের ওপর চাপাচ্ছেন।
এছাড়া অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায় ২০১৩ সালে সারাদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছিল ৩৬৫০টি। পরের বছর মামলা সংখ্যা আরও ৪৫টি বেড়ে হয় ৩৬৯৫টি। ২০১৫ সালে ধর্ষণের মামলা আরও বেড়ে হয় ৩৯৩০টি। ২০১৬ সালে এটা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩৭২৮টি। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯৯৫ টি। আর ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৫৯২ টি অর্থাৎ দিনে প্রায় ১২ টি ধর্ষণের মামলা হচ্ছে দেশে। দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছেই। শেখ হাসিনা সরকারের ২য় মেয়াদে বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২১৫৯০ টি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২ জন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি৷ ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী।
আসক এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে চারটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অথচ ধর্ষণের শতকরা মাত্র তিন ভাগ মামলার অপরাধীরা শাস্তি পায়। আসকের হিসেব মতে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে ৫৯টি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৯২ জন।