শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ. আশির দশক থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর কুরআন বুঝানোর দক্ষতা ও সুললিত কন্ঠ মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতো। তাঁর আলোচনার প্রভাবে বামপন্থী যুবকদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয়। তারা বামপন্থা ছেড়ে ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে। তাঁর বক্তব্যে সারাদেশের বিশেষভাবে চট্টগ্রাম ও সিলেটে বহু মুসলিম বিদআত ছেড়ে দিয়েছে। আল্লামা সাঈদীর হৃদয়গ্রাহী আহ্বানে সারা পৃথিবীর সহস্রাধিক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন।
আল্লামা সাঈদীর দাওয়াতী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে মুশরিকরা ও সমাজতান্ত্রিক বামপন্থীরা। রাম ও বামেরা মিলিতভাবে আল্লামা সাঈদীকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। অন্তত: চার বার হত্যা করার লক্ষ্যে কোরআনের পাখি আল্লামা সাঈদীর প্রতি সরাসরি গুলী ছুড়া হয়েছিল এবং আক্রমন করা হয়েছিল।
১.
প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৯৭৩ সালের ১৪ জানুয়ারী। উত্তরবঙ্গের চাঁপাই নবাবগঞ্জের একটি কলেজ মাঠে আয়োজিত তাফসীর মাহফিলে অংশগ্রহনের জন্য কোরআনের পাখি আল্লামা সাঈদী চাঁপাই নবাবগঞ্জ গমন করেন। মাহফিল শেষে তাকে যে বাড়িতে রাখা হয়েছিলো, সেই বাড়িটি গভীর রাতে ঘিরে ফেলে নাক মুখ বাঁধা সশস্ত্র আততায়ীরা। আল্লামা সাঈদীর সাথে তখন উপস্থিত ছিলেন পাবনা ইশ্বরদীর নন্দিত আলেম মাওলানা খোদা বখ্স খান (মরহুম)।
ঘাতকদের উপস্থিতি টের পেয়ে মাওলানা খোদা বখ্স খান আল্লামা সাঈদীকে নিয়ে পাশ্ববর্তী এক বাড়িতে অবস্থান নেন। আল্লামা সাঈদী যে রুমে ছিলেন ঘাতকরা এসে সেই রুমেই ৫/৬ রাউন্ড গুলি ছুড়ে মুহুর্তেও মধ্যেই স্থান ত্যাগ করে। হয়তো ঘাতকেরা ভেবেছিলো তারা তাদের ষড়যন্ত্রে সফল হয়েছে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর গোলাম, কোরআনের একনিষ্ঠ খাদেম আল্লামা সাঈদীকে ঘাতকদের হাত থেকে সেদিন আপন কুদরতে রক্ষা করেছিলেন।
২.
হত্যা প্রচেষ্টার দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে পরের বছর ১৯৭৪ সালের ২৯ নভেম্বর। পাবনা শহরের অদূরে পুষ্পপাড়া আলিয়া মাদরাসা মাঠে আয়োজিত তাফসীর মাহফিলের প্রধান মেহমান ছিলেন আল্লামা সাঈদী। মাহফিল শেষে মাদারাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আইয়ুব আল্লামা সাঈদীর বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বিশ্রামস্থলে যাওয়ার জন্য দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন ঐ মাদরাসারই প্রধান মুহাদ্দিস মাওলানা নুরুল্লাহ। সেখানে পোঁছে খাবার শেষ হতে না হতেই হঠাৎ ঘাতকেরা গুলি চালায়।
ঘাতকের ছুঁড়ে দেওয়া একঝাঁক বুলেট মুহুর্তেই ঝাঁঝড়া করে দেয় আল্লামা সাঈদীর পাশেই দন্ডায়মান মাওলানা নুরুল্লাহর শরীর। ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন মাওলানা নুরুল্লাহ। এভাবে সে যাত্রায়ও আল্লাহ তায়ালা একান্ত দয়া পরবশ হয়ে আল্লামা সাঈদীকে ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।
৩.
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮৬ সালের ২১ অক্টোবর। হত্যাপ্রচেষ্টার ঘটনাটি ছিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। স্থানীয় বামপন্থী আর সমাজতন্ত্রীরা সন্ধ্যার কিছু আগে স্থানীয় সাতকানিয়া স্কুল মাঠে আয়োজিত তাফসীর মাহফিলে অংশগ্রহনের পথে আল্লামা সাঈদীর গাড়ি আটকিয়ে দেয়। তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে হত্যার হুমকি ও শ্লোগানসহ আল্লামা সাঈদীকে বহনকারী গাড়ির দিকে আগাতে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার পরিকল্পনা ভিন্ন। গন্ডগোলের মধ্যেই কেউ একজন স্থানীয় থানায় ফোন করে।
সাতকানিয়া থানায় তখন চট্টগ্রামের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (নাম উলেখ করা হলোনা, তিনি এখন বর্তমান সরকারের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা) সাতকানিয়া থানা পরিদর্শনে ছিলেন এবং যিনি কিনা আল্লামা সাঈদীকে তার প্রানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। কোরআনের ভাষ্যকার আল্লামা সাঈদী সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন খবরটি পেয়েই তিনি নিজে সদলবলে ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। তিনি এসেই আল্লামা সাঈদীকে বহনকারী গাড়িটিকে নিজ হেফাজতে নিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর পুলিশি তৎপড়তা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সন্ত্রাসীরা যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে।
অস্ত্রসহ পুলিশ সেদিন ৫জনকে গ্রেফতারও করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে থানা পুলিশ সন্ত্রাসীদেরকে আর আটকে রাখতে পারেনি, ‘উপরের নির্দেশে’ অর্থাৎ এরশাদ সরকারের ছত্রছায়ায় তাদেরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো পুলিশ। আল্লাহ তায়ালা সেদিনও আল্লামা সাঈদীকে বাতিল শক্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তাঁরই একান্ত দয়ায়।
৪.
হত্যা প্রচেষ্টার চতুর্থ ঘটনাটি ঘটে ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সেদিন ছিল রাজধানী ঢাকার পান্থপথে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজিত সীরাতুন্নবী (সা) মাহফিল। মাহফিলে প্রধান মেহমান ছিলেন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। মাহফিলের সভাপতিত্ব করছিলেন শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি আ.জ.ম ওবায়দুল্লাহ। পান্থপথের রাস্তার এ মাথা থেকে সে মাথা সন্ধার মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল।
ইসলামের এই গণজোয়ার দেখে বাতিল শক্তি সহ্য করতে পারলোনা। তারা আল্লামা সাঈদীকে হত্যার পরিকল্পনায় মেতে উঠলো। মাহফিলের মঞ্চের পাশেই ছিল ‘আনোয়ারা হাসপাতাল’। এই হাসপাতালের ছাদেই অবস্থান করছিলো সন্ত্রাসীরা। মাগরিবের নামাজের পর লক্ষ লক্ষ জনতাকে নিয়ে কোরআনের পাখি আল্লামা সাঈদী যেইমাত্র তার আলোচনা শুরু করেছেন, ঠিক তখনি ঘাতকেরা আল্লামা সাঈদীকে উদ্দেশ্য করে পরপর ৮/১০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে।
আল্লামা সাঈদী শাহাদাতের তামান্না নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। মঞ্চে উপবিষ্ট শিবির সভাপতি আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহসহ সকলেই আল্লামা সাঈদীকে বসিয়ে দেওয়ার জন্য হাত ধরে টানতে থাকে, ব্যাকুল কন্ঠে অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু আল্লামা সাঈদী দৃঢ় কন্ঠে সেদিন বলেছিলেন, “মৃত্যুকে সাঈদী ভয় পায় না। আমি আমার জীবন মহান আল্লাহর রাস্তায় ওয়াক্ফ করে দিয়েছি। লাখো জনতার মধ্যে যদি আমি বসে যাই, তবে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?”
উপস্থিত লাখো জনতা জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাৎক্ষনিক আনোয়ারা হাসপাতাল ঘেরাও করে অস্ত্রসহ ৩ জন গুপ্তঘাতককে ধরেও ফেলেছিলো। বাকিরা পালিয়ে গিয়েছিলো। জনতা ঘাতকদেরকে পুলিশের হাতে সোপর্দও করেছিলো- কিন্তু তৎকালীন সরকার সন্ত্রাসীদের বিচার তো দূরের কথা, থানায় মামলাও গ্রহন করেনি।
সন্ত্রাসীরা ছিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সন্ত্রাসী। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই জঙ্গী সংগঠনি গড়ে ওঠে। সারা দেশে বহু ইসলামপন্থী মানুষকে তারা খুন করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেসময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি জামায়াতের সমর্থন নিয়েই সরকার গঠন করেছিল। অথচ বিএনপি ভারতীয় অর্থে গড়ে ওঠা ইসলামবিরোধী এই জঙ্গী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ তো করেই নি, উল্টো প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিয়েছে জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য।
Discussion about this post