অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত গণহত্যার দিন। একজন দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর জন্য এই একটি দিনেই সারাদেশে প্রাণ দিয়েছিলো অন্তত ৭০ জন। এই দিনটি ছিলো মূলত ধারাবাহিক গণহত্যার প্রথম ও সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। যুদ্ধাবস্থা ছাড়া একদিনে এত সংখ্যক লোক হত্যার ইতিহাস বাংলাদেশে আর নেই। এই বর্বরোচিত ইতিহাসের রচয়িতা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের মদদপুষ্ট পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সম্মিলিত বাহিনী। ২০১৩ সালের এই সময়টিতে মাত্র ৮ দিনে নির্বিচার গণহত্যার শিকার হয় নারীসহ প্রায় দেড় শতাধিক প্রতিবাদি নিরস্ত্র মানুষ।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের একটি রায়কে কেন্দ্র করে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘোষণার পর পরই দেশব্যাপী ফুঁসে উঠে জনতা। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ইসলাম প্রিয় ও সাধারণ জনতা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার সাঈদীভক্ত রাস্তায় নেমে আসে।
যেই সংখ্যালঘুদের উপর কথিত নির্যাতনের অভিযোগে সাঈদীকে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো, সেই সংখ্যালঘু হিন্দুরাও সাঈদীর মুক্তির দাবিতে নেমে পড়েছিলো রাজপথে।
এরপরই শুরু হয় রক্তাক্ত সেই গণহত্যার ইতিহাসের সূচনা। আওয়ামী লীগ সরকারের মদদপুষ্ট পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং ছাত্রলীগ যুবলীগের সসস্ত্র ক্যাডাররা সাধারণ মানুষের উপর হামলে পড়ে। গুলি চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়।
রায় পরবর্তি প্রায় এক সপ্তাহ জুড়ে চালানো গণহত্যায় সারাদেশ পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। কোথাও বিক্ষোভ মিছিলে সরাসরি গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। কোথাও আবার আটকের পর খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়! খেতে-খামারে, রাস্তা-ঘাটে পড়ে ছিলো লাশ। সেদিন লাশের দেশে পরিণত হয়েছিলো সমগ্র বাংলাদেশ।
শুধু ২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার একদিনেই সারাদেশে হত্যা করা হয় নারীসহ অন্তত ৭০ জনকে। তখনকার পত্রিকার তথ্যমতে, ২৮ ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে সাতক্ষীরায় ১০, রংপুরে ৭, পঞ্চগড়ে ৭, চট্টগ্রামে ৩, কক্সবাজারে ৪, সিরাজগঞ্জে ৩, নারায়ণগঞ্জে ৩, দিনাজপুরে ৩, ঠাকুরগাঁওয়ে ৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৪, নোয়াখালীতে ৩, মৌলভীবাজারে ৩, গাইবান্ধায় ৩, ঢাকার মিরপুরে ১, উত্তরায় ১, কুমিল্লা, নাটোর, যশোর, লক্ষ্মীপুরে ১ জনসহ সারাদেশে মোট ৬৫ জন নিহত হয়েছে। সেদিনের পত্রিকায় অবশ্য সারাদেশের খবর ঠিকমত আসেনি। পরবর্তিতে নিহতের আসল সংখ্যা জানা যায় অন্তত ৭০।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তথ্যমতে ২৮ ফেব্রুয়ারির আগের ও পরের ৮ দিনে সারাদেশে হত্যা করা হয় মোট ১৪৭ জনকে। তবে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান মতে মৃতের সংখ্যা ১৫৫। এছাড়া পুলিশের গুলিতে একই সময়ে আহত হয়েছিলেন প্রায় ৫ সহস্রাধিক এবং গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ২ সহস্রাধিক আর নিখোঁজের সংখ্যাও ছিলো অনেক।
সরকারি বাহিনীর এমন বর্বর গণহত্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। সরকারি বাহিনীর এমন নির্বিচার গণহত্যায় দেশ-বিদেশে উদ্বেগ উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছিলো। সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো সর্বত্র।
নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তখনকার সরকারের সমর্থনপুষ্ট মিডিয়া আর বুদ্ধিজিবীরা নিরব থাকলেও কিছু বিবেকবান বুদ্ধিজীবি সেদিন নিশ্চুপ থাকেননি। ফরহাদ মাজহার এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ‘এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুণ’ ও ‘গণহত্যা কি?’ শিরোনামে প্রতিবাদি কলাম লিখেছিলেন।
এখনো সরকারি সমর্থপুষ্ট মিডিয়া এই বর্বর গণহত্যাকে সম্পূর্ণভাবে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। একজন দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর জন্য দেড় শতাধিক মানুষের জীবন বিলিয়ে দেয়ার সেই শোকাবহ আর বর্বর ইতিহাস কখনো বাংলাদেশের মানুষ ভুলবে না। সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া মানুষগুলোর পরিবারগুলোর খোঁজখবরও তেমনভাবে কেউ নেয়নি। উল্টো তাদেরকে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়তে হয়েছে বার বার। যদিও তারা রাজনীতি বা কোনো দলের জন্য নয়, জীবন দিয়েছিলেন কেবলই একজন দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে ভালোবেসে।