আজ রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০০৬ সালের এই দিনে লগি-বৈঠার তাণ্ডবে নিহত হন ১৩ জন। এরপর একে একে কেটে গেলো ১৫টি বছর। পাল্টেনি দৃশ্যপট। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে রাজধানীর পল্টন ময়দানে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৬ নেতাকর্মীকে জনসম্মুখে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেই থেমে থাকেনি আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী।
সেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজনীতিতে লগি-বৈঠা দিয়ে বর্বরতার যাত্রা শুরু করে আজ অবধি চলছেই। মানবাধিকার লুন্ঠন, গণহত্যা, গুম, ধর্ষণ, গণতন্ত্র হত্যা, কিংবা জনগণের বাক-স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার সে অশুভ প্রতিযোগীতার বিরুদ্ধে আর কাউকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। শুধু সময় গড়িয়ে গেছে মাত্র। দীর্ঘ সময়ে শহীদ পরিবারগুলোর সুবিচারতো দূরের কথা কত শত প্রান যে কেড়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা তার হিসেবও নেই। এছাড়া সেই পরিবারগুলোর প্রতি নানা ধরনের হুমকি-ধামকি অব্যাহত রেখেছে আওয়ামী সরকার। খুনি পরিবার আরও বেপরওয়া হয়ে উঠছে।
শুকায়নি সেই রক্তাক্ত রাজপথ, ওত পেতে আছে সেই হায়নারা
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মামলা এক তরফাভাবে প্রত্যাহার করেছে। ঐদিন নিহতদের পরিবারগুলোর ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা আর্তনাদ হয়ে নিভৃতে নীরবে কেঁদে মরছে।
শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানান, খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত তাদেরকে গুণ্ডাবাহিনীর দ্বারা নানা ধরনের হুমকির শিকার হচ্ছেন। তারা অনেক সময় নামাজে যেতেও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। ব্যবসায়-বাণিজ্যে হচ্ছে ক্ষতির মুখোমুখি।
লগি-বৈঠা দিয়ে বর্বর হত্যাকান্ডের পর ১/১১ এর বিতর্কিত সেনা সমর্থিত সরকার গঠন করে ২০০৯ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর ‘হাইব্রিড’ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। জনগণের প্রত্যাশা কে ভুল প্রমাণ করে ক্ষমতায় আসার পর সরকারের প্রত্যক্ষ মদদেই পিলখানায় ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয় সেটাও আজ ধোঁয়াশায়।
এসব হত্যকান্ডের মাধ্যমে মূলত দেশের সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে ক্ষমতায় থাকার চক্রান্ত করা হয়েছিলো। এরপর সাভারে রানা প্লাজা ভেঙে পড়ে ১১শ’র বেশি পোশাক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ছিল শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরই অন্যতম ভয়াবহ শিল্প-দুর্ঘটনা। যার পেছনে ক্ষমতানসীন সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী স্বার্থান্বেষী চক্রের যোগসূত্র প্রমাণিত হয়েছে।
তারপর থেকে টিঁপাইমুখ বাঁধ, পার্বত্য এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার, এশিয়ান হাইওয়ে এবং টাস্কফোর্সসহ স্বার্থপর প্রতিবেশী ভারতের সাথে নানা ধরনের গোপন চুক্তি আজও বাংলাদেশ ভুলেনি।
ওপাড়ের ইশারায় কথিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের নামে প্রহসন করে আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় দেয়া হয়। রায়ের প্রতিবাদে যখন সারাদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা রাজপথে নেমে এসেছিল তখন তাদের উপর যে বর্বর গণহত্যা চালানো হয়েছিল বাংলার প্রতিটি রাজপথ এখনো তার সাক্ষ্য বহন করে।
এরপর ৫ই মে রাতের আধারে হেফাজত ইসলামী এর নেতা-কর্মীদের ওপর নৃশংস ভাবে যে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল বাংলার মানুষ আজও তার সাক্ষী হয়ে আছে। এ সময় এই নৃশংস হত্যাকান্ড সরাসরি সম্প্রচার করায় জনপ্রিয় দিগন্ত ও ইসলামী টিভি বন্ধ করে মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার এক নির্লজ্জ দৃষ্টান্তও জনগণের চোখে ভেসে বেড়ায়।
শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয় দেশের সাধারণ ছাত্রসমাজ যখন নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তাদের আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে লেলিয়ে দেওয়া হলো হাতুড়ি বাহিনী। কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবি করায় জাতীয় সংসদ থেকে তাদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেয়া হয়। রক্তাক্ত হয় শাহবাগ, শহীদ মিনারসহ সারাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এতবেশি রক্তাক্ত হয়নি। গ্রেফতার করা হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। গুম করা হয় আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের। ভাংচুর করে জ্বালিয়ে দেয়া হয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন।
এরপর বাড়িতে ফেরার অপেক্ষায় থাকা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মমভাবে চালিয়ে দেয়া হলো গাড়ি। নিহত হলো দুই কিশোর শিক্ষার্থী। কিন্তু এ নিয়ে কোন প্রকার দুঃখ প্রকাশ না করে উল্টো মন্ত্রী মশাইয়ের হাস্যরসে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নেমে আসলো রাজপথে। শুরু হলো নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন। রাজধানীর ঝিগাতলাসহ রাজধানীর অলিগলিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর লেলিয়ে দেওয়া হলো দলান্ধ পুলিশ ও বর্বর হেলমেট বাহিনী। ধানমণ্ডিস্থ আওয়ামী লীগ আফিসে স্কুল ছাত্রীদের আটক রেখে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হয়। এরপর ভারত বিরোধী স্ট্যাটাস দেওয়ার কারনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মেধাবী ছাত্র আবরারকে।
বিচার একদিন হবেই শহীদ পরিবার
শহীদ জসিম উদ্দিনের পরিবার সদস্যদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, তার বাবা নিরাপত্তার অভাবে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়তেও যেতে পারেন না। বেশ কয়েকবার স্থানীয় সন্ত্রাসীসের দ্বারা তিনি হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন। এখন নিরাপত্তাহীনতার কারণে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারেন না। তিনি নিজের সংসারের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, জসিম শহীদ হওয়ার পর থেকে আমার পরিবারে ব্যবসায়-বাণিজ্যে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। ব্যবসায়ীপার্টি মাল নিয়ে টাকা শোধ করতে গড়ি মসি করে। কোথাও গিয়ে বিচার পাচ্ছি না।
জসিম সম্পর্কে তার আত্মীয় ইকবাল বলেন, জসিমের মতো এমন ভদ্র-মার্জিত লোক আমি জীবনে কোথাও দেখিনি। সে প্রতি মাসে একবার করে হলেও আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজখবর নিতেন। অত্র এলাকার কোনো একটি মানুষও তার বিরুদ্ধে কোনো দিন অভিযোগ করেনি। সে সবার সাথে উত্তম আচরণ করতো। অথচ এমন একটি ছেলেকে শুধুমাত্র ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে তরতাজা প্রাণটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মতো পিটিয়ে মেরেছে। এমন ঘটনা হয়তো এটাই প্রথম। কিন্তু আফসোস হচ্ছে আমরা এর কোনো সুবিচার পেলাম না। উল্টো আমাদের পরিবারের প্রতি নানা ধরনের হুমকি-ধামকি অব্যাহত রয়েছে। আমরা কি এর কোনো বিচার পাবো এ পৃথিবীতে?
পবিত্র কুরআনের হাফেজ শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপনের বাবা মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমার সন্তানদের মধ্যে শিপন ছিল সবচেয়ে মেধাবী। আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না ওর দাখিল ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীার ফলাফল ঘোষণার পর সেই খবর জানানোর স্মৃতি। আমি মনে করি শিপনের শাহাদাত শুধু আমার বুকে সন্তান হারানোর বিয়োগ ব্যথাই সৃষ্টি করেনি, জাতি হারিয়েছে এক সম্ভাবনাময় তরুণকে। শিপন দাখিল পরীায় মেধাতালিকায় ১১তম স্থান অর্জন করেছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীার ফলাফলেও ছিল তার কৃতিত্বের স্বার। শিপন ছিল পবিত্র কুরআনের হাফেজ, সে কুরআনের বাংলা করতে পারতো। শিপন যখন ওর সমবয়সী বন্ধুদের পবিত্র কুরআন অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ বুঝাতো তখন আমি আশ্চার্য হয়ে ভাবতাম আর মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতাম।
শিপনের মা মাহফুজা বেগম বলেন, সন্তান হারানোর শোকে যে মানসিক আঘাত পেয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে তার মুখ বাঁকা হয়ে যায়, তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তারপরও তিনি পাথরে বুক বেধে রেখেছেন, শহীদের জননী হিসেবে তিনি গর্বিত। ২০০৬ সালে ঈদুল ফিতরের আমেজ কাটার আগেই তিনি হারান তার প্রিয় সন্তান শিপনকে। শিপন ঈদ উপলে তার মায়ের জন্য চুড়ি কিনে এনে নিজ হাতে তাকে পরিয়ে দিয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেছে মা তোমার আর কি লাগবে, আমি তোমাকে তা এনে দেব। তোমাকে খুশি করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগে। তিনি বলেছিলেন, বাবা আমার কিছু লাগবে না। এখনো তার কানে বাজে শিপনের মা মা ডাক। শিপনের মা বাবার দাবি ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের সনাক্ত করে বিচার করা হোক। তারা বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে গণতন্ত্রের মুখোসের আড়ালে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চর্চা চলতেই থাকবে। যতই রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলা হোক কোনো কাজে আসবে না। মাহফুজা বেগম বলেন, আমাদের ছেলে হত্যার বিচার পেলাম না। দেশে আইনের শাসন থাকলে হয়তো এ অবস্থার শিকার হতে হতো না।
শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের বাবা মাহতাব উদ্দিন আহমদ বলেন, আমার ছেলের অপরাধ ছিল সে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করতো। এই এলাকার প্রতিটি মানুষ তাকে ভালোবাসতো। আমার বন্ধুবান্ধবরা এখনো আমাকে বলে, সত্যি তোমার ছেলে মাসুম ছিলো একটা হিরের টুকরো। সন্তান হারানো বাবা মার কষ্ট বুঝানোর কোনো ভাষা পৃথিবীতে আছে কি না তা আমার জানা নেই। আমার বুকে যে কি কষ্ট তা আমি বুঝাতে পারবো না। তারপরও সব কষ্ট ভুলে যাই যখন ভাবি আমি এক শহীদের পিতা আমার সন্তান জীবন দিয়েছে বাংলাদেশে আল্লাহ দেয়া জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার জন্য। আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ওর নম্রভদ্র ব্যবহার, মাসুম ওর প্রয়োজনের কথা আমাকে জানাতো খুবই নম্র ও ভদ্র ভাষায়। ওর প্রতিটি কাজই ছিল নিখুঁত। মাসুমের শাহাদাতের পর ওর ডায়েরি দেখে আমি ভেবেছি, আল্লাহতায়ালা তার এমন বান্দাকে তো পছন্দ করবেনই। ওর ডায়েরির পাতায় প্রতিদিনের কাজ, মনের ভাবনা এবং কে কত টাকা পাবে সব লেখাছিল। আমরা বাসায় না থাকলে ওর বন্ধুবান্ধব আসলে সামনের দোকান থেকে অনেক সময় বাকীতে বিস্কুট, চানাচুর, এনে তাদের আপ্যায়ন করত। সে হিসাবও ওর ডায়েরিতে লেখা ছিল। শহীদ মাসুমের পিতা বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে তার সন্তান হত্যার বিচার চান। তিনি মনে করেন এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে ব্যর্থ হলে এ সরকারকে ইতিহাস কোনো দিন মা করবেনা। শহীদ মাসুমের মা শামসুন্নাহার বেগম বলেন, আমি শহীদ মাসুমের মা এটাই আমার সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। যখন মাসুমের জন্য কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়, আমি দেখি আমার চেয়ে বেশি বেদনা ভারাক্রান্ত আমার প্রতিবেশীরা। তারা আমার চেয়ে বেশি কাঁদছে। তখন আমি আমার প্রিয় সন্তান হারানোর কষ্ট ভুলে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া আদায় করি। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন ২৮ অক্টোবরের নির্মম ও বর্বর হত্যাকাণ্ড গোটা পৃথিবী প্রত্য করেছে। ভিডিও ফুটেজে খুনীদের ছবি রয়েছে, খুনীরা এখনো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপরও কেন সরকার ওদের বিচার করতে পারছে না? তাহলে কি আমরা ধরে নিবো খুনীদের সাথে সরকারের আঁতাত রয়েছে?
কি ঘটেছিলো সেই দিন:
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শাসনামল ২০০১-২০০৬। এই শাসনামল শেষে সংবিধান অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে চারদলীয় জোট। সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন সর্বশেষ বিদায়ী প্রধান বিচারপতি। প্রধানবিচারপতি হিসেবে কে এম হাসানের বয়স বাড়ানো হলো। অবসরের পর তিনিই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। দেশের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়ানোর বিরোধিতা শুরু করলো। কে এম হাসানকে বিএনপির লোক আখ্যায়িত করে তাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে না নেয়ার ঘোষণা দিল আওয়ামী লীগ। তার আগে থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বিচারপতি এম এ আজিজকে গ্রহণ করতে পারছিল না তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য বামপন্থী সকল দলকে সাথে নিয়ে গঠন করলো ১৪ দলীয় মহাজোট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করে।
একের পর এক হরতাল অবরোধ পালন করতে থাকে। একদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজকে সরানোর আন্দোলন অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কে এম হাসানকে মেনে না নেয়ার আন্দোলন। তৎকালীন বিরোধী দলের আন্দোলন সরকারের কাছ থেকে কোন দাবীই আদায় করতে পারেনি। এক পর্যায়ে তাদের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলন আরো বেগবান হতে থাকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগের দাবীতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ঘেরাও করা হয়। সারাদেশে পালন করা হয় হরতাল ও অবরোধ। এক পর্যায়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ’০৬ পল্টনের মহাসমাবেশ থেকে তৎকালীন বিরোধী দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন লগি-বৈঠা-লাঠি নিয়ে ঢাকায় আসার জন্য। নেতাকর্মীদের বুঝতে বাকি রইল না- কী করতে হবে তাদের। চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ই দেশে শুরু হয় অরাজক ও বিশৃঙ্খল অবস্থা।
এক অজানা উৎকণ্ঠায় সারাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। পবিত্র মাহে রমজানের পর ঈদ-উল ফিতরের আনন্দ উৎসবের রেশ তখনও বিদ্যমান। দেশে যে গণতান্ত্রিক সুন্দর ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় ঈদের ৩ দিন পরই চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কেয়ারটেকার সরকারের কাছে। শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন এ ঐতিহাসিক মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছে, সে সময়ই এক অজানা আশঙ্কা ভর করেছে সবার মনে। ঢাকা শহরে এক অদ্ভুত থমথমে নীরবতা, গ্রাম-গঞ্জে আটকেপড়া শহরমুখী মানুষ এক অবর্ণনীয় দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে টিভি এবং রেডিওর সামনে কি অবস্থা দেশের? রেওয়াজ অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে এম হাসানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে চারদলীয় জোট সরকার। কিন্তু সেদিন তা আর সম্ভব হলো না। ২৭ অক্টোবর রাত থেকেই পরিকল্পিতভাবে সারাদেশে সৃষ্টি করা হলো এক চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। সেই পুরনো দৃশ্য ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট ও সড়ক অবরোধ।
পরদিন ২৮ অক্টোবর, সব জায়গায় থমথমে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, টিভি চ্যানেলে যখনই কোন সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কী পরিস্থিতি তা জানার জন্য। অবরোধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের নেতকর্মীরা লগি-বৈঠা-লাঠি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ফলে হঠাৎ করেই দেশে নেমে আসে চরম নৈরাজ্য। রাজপথ ও সভাস্থল দখলের নামে আওয়ামী লীগ আক্রমণ করে জামায়াত ও জোট নেতাকর্মীদের ওপর, শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। অত্যন্ত সুকৌশলে দেশকে ঠেলে দেয়া হয় অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার দিকে, যার সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ জনগণ। বিকেল এবং সন্ধ্যায় প্রায় সবকটি টিভি চ্যানেলে যখন সচিত্র সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছিল কোটি কোটি মানুষের চোখ তখন স্থির। ঢাকার পল্টন মোড়ে এ কি লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখছে তারা? লগি, বৈঠা, কিরিচ, লাঠি ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একদল উন্মত্ত মানুষ কিভাবে নির্বিচারে অত্যাচার চালাচ্ছে আরেকদল মানুষের ওপর। কিভাবে পিটিয়ে, খুঁচিয়ে আঘাতের পর আঘাতে জীবন্ত যুবকদের হত্যা করছে, হত্যার পর মৃত লাশের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাসনৃত্য করছে। পুলিশের সামনেই মুহুর্মুহু গুলী ও বোমা ফাটিয়ে শত শত বনি আদমকে আহত করছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাজপথ। উহ্! এ দৃশ্য দেখে মূর্ছা গেছেন অনেক মা-বোন, কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মানবিক চেতনাসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ। গণতান্ত্রিক সভ্যতার যুগে এ কেমন ভয়ঙ্কর রূপ! সদ্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া বাংলার কতিপয় মানুষের এ কেমন খোলস?
সেদিন শুধু রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে জামায়াত-শিবির কর্মীরা আওয়ামী লীগের বর্বোরচিত হামলার শিকার হন। অনেকের বাড়িঘর দখল করে নেয়া হয়, কারো বাড়ি আর সহায়-সম্পত্তিতে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়, কারো হাত কেটে নেয়া হয়, আবার কারো চোখ উপড়ে ফেলা হয়। আর এভাবেই জামায়াতে ইসলামীসহ জোটের ৪ সহস্রাধিক নেতাকর্মী আহত হন। যার মধ্যে অসংখ্য সাধারণ মানুষও রয়েছে। তৈরি হয় লাশের স্তুপ। জামায়াতে ইসলামীর ১৩ জনসহ মোট ২৬টি লাশ ঝরে পড়ে।
নিহতদে জন্য দোয়া’র আহবান
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর সারা দেশে লগি-বৈঠার নির্মম আঘাতে নিহতদের স্মরণে ‘আলোচনা ও দোয়া’র আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান।
জামায়াত আমীর বলেছেন, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠাধারীদের হত্যা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ২৮ শে অক্টোবরের পথ ধরেই দেশে ওয়ান-ইলেভেনের আগমন ঘটে। দেশকে রাজনীতি শূন্য করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকারসহ মানুষের সকল অধিকার কেড়ে নেয়া হয়।
তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবরের নারকীয় ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে খুনিদের বিচারের দাবিতে জামায়াতের পক্ষ থেকে দাবী জানানো হয়েছিল এবং মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেই মামলা প্রত্যাহার করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি এ দেশের শান্তিকামী জনগণের বিবেকের আদালতে একদিন লগিবৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যাকারীদের বিচার হবে এবং জনগণ সন্ত্রাসীদের প্রত্যাখ্যান করবে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে দেশ হত্যা ও নৈরাজ্যের কবল থেকে মুক্তি পাবে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাবে ইনশাআল্লাহ।
দেশেবাসীর প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছেন তাদের শাহাদাত কবুলের জন্য ‘আলোচনা ও দোয়া’ করার জন্য আমি জামায়াতে ইসলামীর সকল জনশক্তি ও দেশবাসীর প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
Discussion about this post