– রুদ্র আহনাফ
আক্রান্ত মৃত্যুর হার যখন প্রতিদিন যখন বেড়েই চলছে তখন কোন নিয়ম তোয়াক্কা না করেই লকডাউন উঠিয়ে দিল সরকার। আর ক্ষমতাসীনদের এমন ঘোষণার প্রথম দিনেই মৃত্যুর সংখ্যা পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। উর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেই তাদের এমন ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। তবে সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিদিন যেখানে করোনাভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে সে সময়ে লকটডাউন তুলে নেয়াটা ভুল ও ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। দুই মাসের লকডাউন তুলে নেয়ার পরে মানুষের চলাচল বেড়ে গিয়ে দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের মারাত্মক প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সীমিত সংখ্যক যাত্রী বহন করার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তবে গণপরিবহনে মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে যাতায়াত করতে অভ্যস্ত এতে এ নির্দেশনা বজায় রাখা সম্ভব হবে কি না এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এর প্রমাণও আমরা ইতিপূর্বে পেয়েছি। লকডাউন থাকা অবস্থায়ও ফেরীঘাটে জনতার ঢল দেখে। সরকারের এমন দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে নিঃসন্দেহে ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাবে।
লকডাউনের শুরু থেকে গার্মেন্টস কর্মীদের নিয়ে সরকার নানা নাটকীয়তার শেষে এই মরণঘাতীর ঝুঁকি নিয়ে তাদের কাজ করতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয় বেতন না পেয়ে দিনের পর দিন রাজপথে আন্দোলন করতেও দেখা যায় এই শ্রমিকদের। কিন্তু আশ্বাস মিললেও বিশ্বাস মেলেনি। শ্রমিকরা হতাশ হয়ে কেউ কাজে অংশ নেন আবার কেউ পেটের দায়ে পাড়ি জমান গ্রামে। এরই মধ্যে গত ৪ মে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান ঘোষণা দিলেন করোনাভাইরাসের কারণে যেসব গার্মেন্ট শ্রমিক কাজে যোগ দিতে পারেননি বা কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন তারা বেতনের ৬৫ শতাংশ পাবেন। এখন প্রশ্ন হলো একদিকে সমগ্র দেশ বিচ্ছিন্ন অন্যদিকে পোষাক কারখানা খুলে দেওয়া হলো তাহলে বাড়ি ফেরা শ্রমিকরা ফিরবে কিভাবে? তবুও দেখা গেছে বহুপথ হেঁটে হেঁটে কোন প্রকার সামাজিক দূরত্ব না মেনে হুমড়ি খেয়ে কাজে অংশ নিয়েছে শ্রমিকরা। ফলাফল ৯০টি কারখানার দুইশতাধিকেরও বেশি শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত।
এবার লকডাউন তুলে দেওয়ার পর আবারও নাটকীয়তার জন্ম নিয়েছে। আবারও চরম দ্বায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। অফিস আদালত খোলার ঘোষণা দিয়েছে ৩১ ই মে। কিন্তু গাড়ি খোলার ঘোষণা দিলেন একদিন পর। তাহলে যারা পেটে খাবার দিতে না পেরে এই ঢাকা শহর থেকে ছেড়ে মফস্বলে রয়েছে তারা কিভাবে অফিস করবেন? অফিসে সময়মত না গেলেও বেতন থেকে টাকাও কর্তন করা হবে এমন পরিস্থিতিতে একজন মধ্যবিত্ত কিভাবে নিজের সংসার চালাবেন। সরকার গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক করে অফিস খোলার সিদ্ধান্ত দিতে পারতো। কিন্তু সেখানেও চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে তারা। সে যাইহোক এদিকে গাড়ির মালিকদের ক্ষতি পোষাতে ৬০ শতাংশ ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। ১ জুন থেকে তা কার্যকর হবে। এদিকে বাস মালিকদের এই দাবির পর যাত্রী পরিবহন করতে হবে, এই অজুহাতে লঞ্চেরও ভাড়া বাড়ানোর দাবি তুলেছিলেন লঞ্চমালিকেরা।
আইন অনুসারে মিনিবাসের আসন ৩০টি। আর বড় বাসের ৫১টি। ঢাকার প্রতিটি বাস-মিনিবাসে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আসন বাড়িয়ে নিয়েছেন মালিকেরা। অর্থাৎ সরকার যে হিসাব করে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, তাতে বিদ্যমান বাস-মিনিবাসের ৫০ শতাংশ ফাঁকা রাখলেও লোকসান হওয়ার কথা নয়। এ ছাড়া ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পরিবহনমালিকেরা ‘সিটিং সার্ভিস’সহ নানা নামে আগে থেকেই শতভাগ বা এরও বেশি ভাড়া আদায় করে আসছেন। নতুন করে ৬০ শতাংশ বাড়তি ভাড়া সেই আগের বাড়তি ভাড়ার সঙ্গেই যুক্ত করে আদায় করবেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা।
অন্যদিকে দূরপাল্লার বাসের মধ্যে সরকার শুধু শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বিহীন (নন-এসি) বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। বিলাসবহুল ও এসি বাসের ভাড়া মালিকেরা নিজেরাই ঠিক করে থাকেন। অর্থাৎ বাজারে চাহিদা-জোগানের ওপর ভাড়া নির্ভরশীল। এসব বাসের ভাড়া আগে থেকেই এত বেশি যে কখনো কখনো ২০-৩০ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকলেও তাঁদের লোকসান গুনতে হয় না। সবার জন্য ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এ ছাড়া দূরপাল্লার পথের নন-এসি বাসগুলোও সব সময় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করে থাকে। ফলে এখন ৬০ শতাংশ বাড়তি মানে হচ্ছে আগের বাড়তি ভাড়ার ওপর আরও ভাড়া বাড়ানো।
আসলে পরিবহন খাতের মালিকেরা যে ভাড়া আদায় করছেন, তা দিয়েই লোকসান এড়ানো সম্ভব। কিন্তু পদে পদে আওয়ামী ষন্ডারা চাঁদাবাজি করে তাঁদের লাভ খেয়ে ফেলছে। এ জন্য যতই ভাড়া বাড়ানো হোক না কেন, সাধারণ পরিবহন শ্রমিকরা লাভ পাবেন না। ক্ষমতাসীনরা চাঁদাবাজি বন্ধ করে দিলে ভাড়া বাড়ানো ছাড়াই লাভ করা সম্ভব।
বাস কোম্পানিগুলোর মালিক, এমডি বা চেয়ারম্যানের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীনদের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিরা। এছাড়া রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আত্মীয়। তাঁরা একটি বা খুব কমসংখ্যক বাস নামিয়ে কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে যান। এরপর সাধারণ মালিকেরা তাঁদের অধীনে বাস চালাতে দেন। বিনিময়ে কোম্পানিকে দৈনিক ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। শুধু তাই নয় এই চাঁদার কিছু অংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে ব্যয় হয়। স্থানে স্থানে কোম্পানির টিকিট পরীক্ষা করার যে লোক থাকেন, তাঁদের পেছনে কিছু খরচ হয়। কিছুটা অফিস খরচ। সিংহভাগই আওয়ামী ষন্ডাদের পকেটে চলে যায়। সব মিলিয়ে বাস মালিকদের নামে আসলে লাভ যাচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পকেটে। তারা একদিকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের পকেট কেটে নিচ্ছে আবার বাস মালিকদের অযুহাতে নিজেদের পকেট ভারি করছে।
অন্যদিকে সাধারণ জনগণ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে। শারীরিক ঝুঁকি নিয়ে অফিসের কাজে অংশ নিচ্ছে। মরণঘাতী করোনা থেকে জনতার ক্ষতিটা কে পোষাবে কে!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট