বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘শাসন করা তারই সাঝে সোহাগ করে যে’। সূরা আল মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের জীবন বিধান পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের জন্য আমার নিয়ামতও পূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের জন্য জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম।’ সূরা আল ইমরানের ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার নিকট (মানুষের জন্য) ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনব্যবস্থা।’ তাই মুসলমান শাসকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সূরা আল হজের ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন, ‘আমি এ জনপদে যদি (মুসলমান দাবিদার) কাউকে (রাজনৈতিকভাবে) প্রতিষ্ঠা দান করি (বা কোনো মুসলমানকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করি) তাহলে তার (প্রথম) দায়িত্ব হলো সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, (দ্বিতীয়ত) জাকাত আদায় করবে, আর (তৃতীয়ত) জনগণকে সৎকাজের আদেশ দেবে ও অন্যায় আর অসৎকাজ থেকে বিরত রাখবে (অর্থাৎ ন্যায়বিচার, ইনসাফ ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করবে), তবে সব কাজের চূড়ান্ত পরিণতি একান্তভাবে আল্লাহ তায়ালারই এখতিয়ারভুক্ত’। রাসূল মুহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরতের পর ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। সেখানে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার পর ন্যায়বিচার, ইনসাফ ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অতঃপর খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলকে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণ যুগ বলে অবিহিত করা হয়েছে।
সূরা আন নিসার ১০৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:-এর উদ্দেশে বলছেন, ‘অবশ্যই আমি সত্য দ্বীনসহ (মানুষের জন্য জীবনব্যবস্থা) মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল করেছি, যাতে করে আল্লাহ তায়ালা আপনাকে যে (জ্ঞানের আলো) দেখিয়েছেন তার আলোকে আপনি মানুষের মধ্যে বিচার ফয়সালা করতে পারেন; (তবে বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে) আপনি কখনো বিশ^াসঘাতকদের পক্ষ অবলম্বন করবেন না। সূরা আল মায়েদার ৪৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা (রাসূল সা:-কে নির্দেশ করছেন, ‘আর আপনার ওপর আল্লাহ তায়ালা যে আইনকানুন নাজিল করেছেন আপনি তারই ভিত্তিতে তাদের (জনগণের) মধ্যে বিচার ফয়সালা করুন এবং কখনো তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করবেন না আর তাদের থেকে সতর্র্ক থাকুন, যা আপনার ওপর নাজিল হয়েছে তার কোনো বিষয়ে যেন তারা (জনগণ) কখনো আপনাকে ফেতনায় ফেলতে না পারে।’ সূরা আল মায়েদার ৫০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা (রাসূল সা:-এর উদ্দেশে) প্রশ্ন রাখছেন, ‘তবে তারা (জনগণ) কি আবার জাহেলিয়াতের বিচারব্যবস্থা তালাশ করছে? অথচ যারা আল্লাহ তায়ালার ওপর দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করে, তাদের কাছে আল্লাহ তায়ালার চেয়ে উত্তম বিচারক আর কে হতে পারেন?
হত্যা ও সন্ত্রাসের বিচার সম্পর্কে সূরা আল মায়েদার ৩২ ও ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন, আমি বনি ইসরাঈলদের জন্য বিধান জারি করেছিলাম, কেউ যদি পৃথিবীতে কাউকে অনর্থক হত্যা করে বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে, সে যেন গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করল, আবার যদি কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করে সে যেন গোটা মানব জাতিরই প্রাণ রক্ষা করল, এদের কাছে আমার রসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে এসেছিল তারপরও তারা পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবেই রয়ে গেল। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে (অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার আইন আর রাসূল সা:-এর বিচার ফয়সালা অমান্য করে) পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাহলে তাদের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি হচ্ছে, ‘হত্যার বিনিময়ে হত্যা’ বা তাদেরকে শূলবিদ্ধ করা অথবা উল্টোদিক থেকে তাদের হাত-পা কেটে ফেলা, কিংবা দেশ থেকে নির্বাসিত করা, এই অপমানজনক শাস্তি তাদের দুনিয়ার জীবনের জন্য, তা ছাড়া আখেরাতে তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি।
বিচারব্যবস্থা ও বিচারক সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা আন নিসার ৬৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করছেন, ‘না, (হে নবী!) আপনার মালিকের শপথ, এরা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারে না, যতক্ষণ না তারা তাদের যাবতীয় মতবিরোধের (বিচার) ফয়সালার ব্যাপারে আপনাকে (শর্তহীনভাবে) বিচারক মেনে নেবে, অতঃপর আপনি যে বিচার ফয়সালা দেবেন সে ব্যাপারে তাদের মনে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ থাকবে না, বরং আপনার সিদ্ধান্ত তারা সর্বান্তকরণে মেনে নেবে’। রাষ্ট্র শাসকের দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার করা আর জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে শাসকের বিচার ফয়সালা মেনে নেয়া। বিচারের ক্ষেত্রে শাসক জুলুম করলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে, এ কথা শাসককে অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
ইসলামি শরিয়তের আইনের তিন প্রকার প্রয়োগ আছে। যেমন, (১) ‘হদ্দ’ এ আইনে যিনা ব্যভিচার, মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, বিদ্রোহ ও ধর্মত্যাগসংক্রান্ত অপরাধের বিচার করা হয়, (২) ‘কিসাস ও দিয়াত’ এ আইনে হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড ও রক্তপণ আদায়সক্রান্ত বিচার করা হয়, (৩) ‘তাযির’ এ আইনে শরিয়তের কোনো শাস্তি নির্ধারিত নয়, যা সরকার বা সরকারের প্রতিনিধি বা বিচারকের বিবেচনার ওপর ন্যস্ত এমন সব বিচার করা হয়।
চুরির বিচার সম্পর্কে সূরা আল মায়েদার ৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘নারী-পুরুষ এদের মধ্যে যে কেউই চুরি করবে, তাদের হাত দুটো কেটে ফেলো, এটা তাদেরই কর্মফল এবং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত দণ্ড, আল্লাহ তায়ালা মহাশক্তিশালী ও প্রবল প্রজ্ঞাময়।’
হত্যার বিচার হত্যা, চোরের বিচার হাত কাটা আর যিনার বিচার পাথর মেরে হত্যা তখনই হবে, যখন কুরআন ও সুন্নাহর আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। তখন অবশ্যই রাষ্ট্র, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তা এই ছয়টি মানবীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ বা মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারবে। তার পরও যদি কোনো ব্যক্তি কাউকে হত্যা করল, চুরি করল বা যিনা করল আর হাতেনাতে ধরা পরার সাথে সাথে তাকে হত্যা করা, হাত কেটে দেয়া আর পাথর মেরে হত্যা করা যাবে না। মনে করুন চুরির বিচার; প্রথমত, দেখতে হবে চোর নারী বা পুরুষ সে বালেগ কি না। দ্বিতীয়ত, তার চুরি করার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। তৃতীয়ত, আটটি শর্ত বিদ্যমান থাকলে চুরি বলে গণ্য হবে, (১) গোপনে (চুরির বস্তু বা মাল) হস্তগত করলে, (২) হস্তগত বস্তু ‘মাল’ হলে (অর্থাৎ বস্তুটি হস্তান্তর যোগ্য, মূল্যমান ও স্থানান্তর যোগ্য হলে), (৩) কারো দখলভুক্ত মাল হলে, (৪) সংরক্ষিত স্থান থেকে হস্তগত (বা চুরি) করলে, (৫) বস্তুটি (চোরের) নিজ দখলে নিলে, (৬) চুরির মাল নিসাব (বা দশ দিরহাম) পরিমাণ হলে, (৭) বস্তুটি স্থানান্তরিত করা হলে ও (৮) বস্তুটি অসৎ উদ্দেশ্যে হস্তগত ও স্থানান্তর করলে। এসব বিষয় আবার উপযুক্ত সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত হতে হবে অথবা চোর স্বেচ্ছায় চুরি করার কথা স্বীকার করলে অথবা চুরির মালের দাবিদার চুরি যাওয়ার ব্যাপারে শপথ করলে তবেই চোরের ওপর হাত কাটার শাস্তি আরোপ করা যাবে। তার পরও আত্মীয়স্বজন, চাকর বা কর্মচারী, মেহমান চুরি করলে হদ্দ বা হাত কাটার আইন প্রযোজ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে তাযির বা শরিয়তের আইনের পরিবর্তে প্রচলিত আইন অথবা সরকারের নিযুক্ত বিচারক বা প্রতিনিধির দ্বারা শাস্তি নির্ধারিত হবে।
দুনিয়ার শাসক, বিচারক আর জনগণকে অবশ্যই একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়ার শাসক বা বিচারকগণ হচ্ছেন, বিশ্বজাহানের স্রষ্টা, মানুষের সৃষ্টিকর্তা ও শেষ বিচার দিনের মালিক আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত ও নির্বাচিত প্রতিনিধি বা ‘খলিফা’। আল্লাহ তায়ালা সূরা আল আ’রাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করছেন, সৃষ্টি যেহেতু তাঁর (আল্লাহ তায়ালার, সুতরাং হুকুমও চলবে একমাত্র তাঁরই, সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত দয়ালু ও বরকতময়। সূরা আর বাকারার ১০৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:-এর উদ্দেশে ঘোষণা করছেন, ‘হে নবী! আপনি কি জানেন না, আসমানসমূহ ও জমিনের সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্যই নির্দিষ্ট।’ সূরা আল মূলক-এর প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন, ‘সকল বরকতময় মহিমা সেই মহান সত্ত্বার জন্য রাজত্ব যার হাতের মুঠোয়, তিনি সকল জিনিসের ওপর একক ক্ষমতাবান।’ সূরা আল হাদিদের ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করছেন, ‘আসমান ও জমিনের বাদশাহী তাঁরই (আল্লাহ তায়ালার), সকল ব্যাপারই তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে।’ আল্লাহ তায়ালা সূরা আস সিজদাহর ৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন, ‘আকাশ থেকে জমিন পর্যন্ত সকল কিছুর ব্যবস্থাপনা-পরিচালনা একমাত্র তিনিই করেন।’
অতএব, আল্লাহ তায়ালার এই জমিনে আল্লাহর আইন ছাড়া মানব রচিত আইন দ্বারা রাষ্ট্র শাসন করা, বিচার করা এটা ইনসাফ, ন্যায়নীতি ও ইহসান পরিপন্থী। কারণ মানব রচিত কোনো আইনই কখনোই পক্ষপাতহীন হতে পারে না। যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই হতে পারেন একমাত্র পক্ষপাতহীন। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কোনো বস্তু তৈরি করে তাহলে যে ব্যক্তি বস্তুটি তৈরি করেছেন তিনিই ভালো জানেন বস্তুটির ব্যবহারবিধি কী হওয়া উচিত বা কিভাবে ব্যবহার করলে সে বস্তুটির যথার্থ ব্যবহার হবে বা বস্তুটির উপযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। এই মর্মে প্রস্তুতকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠা সে বস্তুর প্রস্তুত প্রণালি ও ব্যবহার বিধিসংবলিত লিফলেট বা বুকলেট তৈরি করে বস্তুটির ব্যবহারকারীকে জানিয়ে দেয়া হয়। তদ্রƒপ যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন (মহান আল্লাহ) তিনিই ভালো জানেন মানুষ কোন বিধিবিধান মেনে চললে ইহসান আর ইনসাফ হবে, কিভাবে মানুষ তার দায়িত্ব পালন করবে, কিভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করবে, কিভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। এ জন্য মানুষের স্রষ্টা (আল্লাহ তায়ালা) মানুষের জীবন বিধানসংবলিত মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল করেছেন। আর আল কুরআনের বাস্তব অনুসারী বা জীবন্ত কুরআন ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ সা:। তিনি যেভাবে আর যে আইনে রাষ্ট্র শাসন আর বিচার পরিচালনা করেছেন, ঈমানের দাবিদার প্রত্যেক মুসলমান শাসকের উচিত, রাসূল মুহাম্মাদ সা:-এর পথ অনুসরণ করা। যেমন করেছেন খোলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফা।
লেখক : মানবাধিকারকর্মী
Discussion about this post