বিংশ শতাব্দির শুরু থেকেই একের পর এক ভূমি হারাতে থাকে মুসলিমরা। সংকীর্ণ হতে থাকে মুসলিম বিশ্ব। এমন এক মুহুর্তে আবির্ভাব হয় ইমাম হাসান আল বান্নার। তিনি মুসলিম যুব সমাজকে জাগাতে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু তার এই কাজের বাধা হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম শাসকগোষ্ঠী। যারা ইংল্যান্ডের স্বার্থকেই বেশি দেখতো মুসলিম কিংবা মিশরিয়দের স্বার্থের চাইতে। আর তারা এমন কাজ করবে না কেন, কারণ ব্রিটিশদের তাবেদারি করেই তারা ক্ষমতায় আছে।
আরব ভূমির ইসলামী রেনেসাঁর সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলেমিনের প্রতিষ্ঠাতা। মিশর থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইখওয়ানুল মুসলেমিনের বিপ্লবী বার্তা ছড়িয়ে পড়ে আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে। পতনের অপেক্ষায় থাকা মুসলিমরা তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রত্যয় পায়। মুসলিম সমাজের এই জাগরণ স্বাভাবিকভাবেই চক্ষুশূল হয় ব্রিটিশ ও তাদের দালালদের। নানানভাবে ইমাম হাসান আল বান্নাকে হেনস্তা করতে চায় তারা। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে দমাতে পারেনি শাসকগোষ্ঠী। বার বার কারা নির্যাতন লেগেই ছিল। অবশেষে ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইমামকে তারা খুন করে।
তারা ইমামকে খুন মিশর থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ তাঁর পথে জীবন দেয়া শহীদকে বাঁচিয়ে রাখেন। ইমাম হাসান আল বান্না তাই আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছেন সারা পৃথিবীতে। আজ পুরো পৃথিবীতে তাঁর থেকে প্রেরণা নিয়ে ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে লাখো যুবক।
জন্ম ও শৈশব
১৯০৬ সালে ইমাম হাসান আল বান্না মিশরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা আবদুর রাহমান আল বান্না একজন উঁচু মাপের ইসলামী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আট বছর বয়সে ইমাম হাসান আল বান্না’র আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাদরাসা আর রাশাদ আদ দ্বীনিয়াহ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। একইসাথে তিনি আল কুরআন হিফয করতে থাকেন। কিছুকাল পর তিনি মাহমুদিয়ার মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র হন। বছর খানেকের মধ্যেই শায়খ হাসানুল বান্না দামানহুর টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পান। এই স্কুলে লেখাপড়া কালে তিনি দামানহুরের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিদের নিকট যাতায়াত করতেন। তাঁদের কাছ থেকে তিনি দ্বীনের শিক্ষা লাভ করেন। এই সময় ব্যাপকভাবে ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নের দিকেও তিনি মনোযোগ দেন।
অতঃপর তিনি কায়রো যান এবং আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দারুল উলুমে ভর্তি হন। এই সময় তাঁর আব্বা সপরিবারে মাহমুদিয়া থেকে কায়রোতে স্থানন্তরিত হন। কায়রোতে অবস্থানকালে শায়খ হাসানুল বান্না মিসরের অন্যতম সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব শায়খ মাহমুদ কর্তৃক পরিচালিত জামিয়াতুল মাকারিমিল আখলাক আল ইসলামিয়াহ নামক সংস্থার সদস্য হন। এখানে তার আমর বিল মা’রূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার (সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ) তৎপরতার হাতেখড়ি। ১৯২৭ সনের জুলাই মাসে দারুল উলুম থেকে তিনি ডিপ্লোমা লাভ করেন। এখানেই তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
কর্মজীবন
১৯২৭ সনের সেপ্টেম্বর মাসে শায়খ হাসানুল বান্না সরকারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তাঁকে পোস্টিং দেয়া হয় ইসমাঈলিয়াতে। ইসমাঈলিয়া সুয়েজখালের সাথে সংযুক্ত তিমসাহ ঝিলের সন্নিকটে অবস্থিত একটি শহর। স্কুলের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্তব্য পালন করতে থাকেন। আর সময় সুযোগ মতো তিনি নিকটবর্তী ক্লাব ও কফি হাউসে গিয়ে দ্বীনি বক্তব্য পেশ করা শুরু করেন।
আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন
ইমাম হাসান আল বান্না’র সংক্ষিপ্ত অথচ জ্ঞানগর্ভ ইসলামী ভাষণ চিন্তাশীল লোকদেরকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে ছয়জন ব্যক্তি তাঁর বাসায় আসেন তাঁর সাথে আলাপ করতে। হাসান আল বান্না তাঁদের সামনের তাঁর চিন্তাধারা পেশ করেন এবং সমাজ অংগনের সর্বত্র ইসলামের প্রধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে।
এই মিটিংয়ে আগত ছয়জন ব্যক্তি হচ্ছেন- ১. হাফিয আবদুল হামীদ, ২. আহমাদ আল হাসরী, ৩. ফুয়াদ ইবরাহীম, ৪. আবদুর রাহমান হাসবুল্লাহ, ৫. ইসমাইল ইযয ও ৬. যাকী আল মাগরিবী। আলোচনা শেষে একটি সংগঠন কায়েমের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন’। আর এর আলমুরশিদুল আম নির্বাচিত হন শায়খ হাসানুল বান্না। এইভাবে ১৯২৮ সনের মার্চ মাসে মিসরের অন্যতম শহর ইসমাঈলিয়াতে সাতজন সদস্য নিয়ে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূন গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে তখন শায়খ হাসানুল বান্না ছিলেন ২২ বছরের একজন দীপ্তিমান যুবক।
শায়খ হাসানুল বান্না ভালো করেই জানতেন যে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আল জিহাদু ফিল ইসলাম বা ইসলামী আন্দোলনের প্রধান কাজ হচ্ছে আদ্দা’ওয়াতু ইলাল্লাহ বা আল্লাহর দিকে লোকদেরকে ডাকা। এই কাজ করতে হলে লোকদের সামনে প্রথমেই তুলে ধরতে হয় আল্লাহর পরিচয়, তারপর আল্লাহর পথের তথা ইসলামের পরিচয়। এরপর তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হয় ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর বিধান অনুসরণের সাথে সাথে সামষ্টিক জীবনে আল্লাহর বিধান কায়েম করার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের প্রসার
ইমাম হাসান আল বান্না ইসমাঈলিয়া শহর চষে বেড়াতে থাকেন। তিনি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে লোকদের সাথে আলাপ করতেন ও ইসলামের আলো ছড়াতেন। এইভাবে কাজ চলে তিনটি বছর। বেশ কিছু লোক তাঁর ডাকে সাড়া দেয়। ইখওয়ানের সদস্যগণ তাঁদের নেতার অনুকরণে লোকদের বাড়িতে বাড়িতে যেতেন। বিশিষ্ট সদস্যগণ মাসজিদে সমবেত লোকদের সামনে বক্তব্য পেশ করতেন। তাঁরা কফি-খানাতেও যেতেন। উপস্থিত লেকাদেরকে নিজেদের বক্তব্য শুনাতেন। সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে তাঁরা যেতেন, তাদের সাথে মিশতেন, তাদের কথা শুনতেন ও তাদেরকে দীনের কথা শুনাতেন।
মাত্র চার বছরের মধ্যেই আল ইখওয়ান খুবই পরিচিত একটি সংগঠনে পরিণত হয়। ইসমাঈলিয়াতে অনেকগুলো শাখা কায়েম হয়। আর নিকটবর্তী শহর পোর্ট সাঈদ, সুয়েজ, আবু সুয়াইর ও সুবরাখিতেও শাখা সংগঠন কায়েম হয়। তখন ইসমাঈলিয়াতেই অবস্থিত ছিলো আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এখানে নির্মাণ করা হয় একটি মসজিদ।
কিছুকাল পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে বালকদের জন্য একটি ও বালিকাদের জন্য আরেকটি স্কুল স্থাপিত হয়। এই স্কুলগুলোতে এমন শিক্ষাপদ্ধতি চালু করা হয় যাতে একজন শিক্ষার্থী পার্থিব বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের সাথে সাথে ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে উঠে। আরো কিছুকাল পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সন্নিকটে গড়ে তোলা হয় ক্লাব। এই ক্লাবে শরীর চর্চা ও নির্মল আনন্দদানের বিভিন্ন আয়োজন ছিলো। লোকদের কর্মসংস্থানের জন্য নিকটেই গড়ে তোলা হয় কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিলো মডেল। শাখা-সংগঠনগুলো শক্তিশালী হতেই মাসজিদ নির্মাণ, শিক্ষালয় স্থাপন, ক্লাব গঠন ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতো।
রাজা ফুয়াদের বাঁকাদৃষ্টি
এই সময় মিসরের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন কিং ফুয়াদ। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইসমাঈল সিদকী পাশা। আল ইখওয়ান তখনো কোন শক্তিধর সংগঠন ছিলো না। তথাপিও শাসকগোষ্ঠী এইটিকে বাঁকা চোখে দেখতেন।
শায়খ হাসানুল বান্না একটি সরকারী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা শরু হলো এই বলে যে তিনি সরকারী টাকা খরচ করে দল গঠন করেছেন। তাঁরা কার্যাবলী পরীক্ষা করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত করে আপত্তিকর কিছুই পেলোনা। আসলে তাঁকে হয়রানি করার ছিলো এই অভিযোগের আসল উদ্দেশ্য। সরকারি মহল থেকে প্রচারণা শরু হলো যে হাসানুল বান্না কিং ফুয়াদকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও রাজতন্ত্র খতম করার জন্য এই সংগঠন গড়ে তুলেছেন।
কায়রোতে বদলি
১৯৩২ সনের অক্টোবর মাসে শায়খ হাসানুল বান্না কায়রোতে বদলি হন। এই বদলি আল ইখওয়ানের জন্য কল্যাণকর হয়েছিলো। আল ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থানান্তরিত হয় কায়রোতে। এখানে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়। বুঝা যাচ্ছিলো, আগামী দিনগুলোতে আল ইখওয়ান একটি শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। উল্লেখ্য যে কায়রোতে বদলি হওয়ার পর শায়খ হাসানুল বান্না বিয়ে করেন। একটি মাসজিদে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর বিয়ে সম্পন্ন হয়।
প্রধানমন্ত্রী ইসমাঈল সিদকী পাশা আল ইখওয়ানের ওপর বিশেষ দৃষ্টি রাখছিলেন। কিন্তু তিনি আল ইখওয়ানকে ভালো চোখে দেখতেন না। তবে নৈতিক ভাবে দুর্বল করে ফেলার জন্য তিনি আল ইখওয়ানকে অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব করেন। বিচক্ষণ শায়খ হাসানুল বান্না এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
শায়খ হাসানুল বান্না কেন্দ্রীয় কার্যালয়টিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন। স্কুলে যাবার আগে তিনি কার্যালয়ে আসতেন। সেই দিনের করণীয় কাজের ফিরিস্তি তৈরী করে সহকারীদের হাতে দিয়ে যেতেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি আবার আসতেন কার্যালয়ে। বিকালের সময়টাতে সাধারণত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। এই সভায় তিনি আল কুরআনে উপস্থাপিত বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করে বক্তব্য রাখতেন। এভাবে ইখওয়ান মজবুতি অর্জন করতে থাকে।
অতি বিপ্লবী কিছু লোকের ভূমিকা
দাওয়াতী কাজে বেশ সফলতা লাভ করে ইখওয়ান। তাই ইখওয়ানের একটি অতি বিপ্লবী গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠে। এরা মনে করলো যে বিপ্লবের সময় এসে গেছে। এখন দেরি করা কাপুরুষতার নামান্তর। ক্ষমতা দখল করে নিলেই হয়। তারা যুক্তি দেখালো যে আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘যদি তোমাদের কেউ কোন গর্হিত কাজ হতে দেখে তবে সে তার হাত দ্বারা তার প্রতিরোধ করবে, যদি তা করতে সক্ষম না হয় তবে জবান দ্বারা তার প্রতিবাদ করবে, যদি তাও করা সম্ভব না হয় তা হলে হৃদয়ে তার প্রতিরোধের চিন্তা-ভাবনা করবে। অবশ্য শেষটি হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’
এদের বক্তব্যের জবাবে শায়খ হাসানুল বান্না আল কুরআনের আয়াত বিশেষের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘তুমি লোকদেরকে তোমার রবের পথে ডাক হিকমাহ ও সুন্দর বক্তব্য সহকারে। আর তাদের সাথে আলাপ কর অতীব সুন্দর পদ্ধতিতে। তোমার রব জানেন কে তাঁর পথ ছেড়ে বিভ্রান্ত হয়েছে, আর জানেন কে হিদায়াত অনুসরণ করে চলেছে।’’
এই আয়াত উদ্ধৃতির মাধ্যমে ইমাম হাসান আল বান্না ইসলামী বিপ্লবের সুস্থ ও স্বাভাবিক পদ্ধতি কী তা তাদের সামনে তুলে ধরেন। ইমাম হাসান আল বান্না হাওয়ার দোলায় আন্দোলিত হবার মতো ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি স্রোতের সাথে ভেসে যাবার পাত্র ছিলেন না। হঠকারিতার পরিণতি কী হতে পারে তাও তিনি বুঝতেন। তাই তিনি স্বীয় মতে অটল থাকেন। কিছু লোক সংগঠন ছেড়ে চলে যায় একটি গুপ্ত জঙ্গী সংগঠন তৈরি করে।
সরকারের ওপর ইংরেজদের ও ইখওয়ানের চাপ
১৯৩৯ সনে শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। গ্রেট ব্রিটেন চাইছিলো মিসর তার পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুক। অথচ গ্রেট ব্রিটেনের পক্ষাবলম্বন করার মানে ছিলো তুর্কীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা। অর্থাৎ মুসলিম সৈন্যগণ মুসলিম সৈন্যদেরকে আহত ও নিহত করা। এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ ব্যাপার ছিলো না। ইমাম হাসান আল বান্না এই বিষয়ে সরকারকে আগেই হুঁশিয়ার করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী আলী মাহির পাশা ও প্রধান সেনাপতি জেনারেল আযীয আলী আল মিসরীও ইংরেজ তোষণ নীতি গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। ইংরেজদের বিরাট স্বার্থ তখন সুয়েজে। মিশরের স্বাধীনচেতা সরকার গ্রেট বৃটেনের স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ নিতে পারে, এই আশংকা তাদেরকে পেয়ে বসে। ইংরেজগণ গোপনে কিং ফারুকের ওপর কুটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। দুঃখের বিষয়, কিং ফারুক ইংরেজদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন।
১৯৪০ সনে কিং ফারুক প্রধান সেনাপতি জেনারেল আযীয আলী আল মিসরীকে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠিয়ে দেন। এই ছুটি আর কোনদিন শেষ হয়নি। কিছুদিন পরে আলী মাহির পাশাকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। মিসরে ইংরেজদের কূটনীতি বিজয় লাভ করে। ১৯৪০ সনের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন হাসান সাবরী পাশা। তাঁর নেতৃত্বে মিসর আফ্রিকার রণাঙ্গনে ইংল্যান্ডের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ঐ বছরের নভেম্বর মাসে হাসান সাবরী পাশা মৃত্যুবরণ করলে নতুন প্রধানমন্ত্রী হন হুসাইন সিররী পাশা।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আলী মাহির পাশা ও প্রাক্তন প্রধান সেনাপতি আযীয আলী আল মিসরী গ্রেট বৃটেনের তাবেদারী করতে প্রস্তুত ছিলেন না। জনগণের ওপর তাঁদের বেশ প্রভাব ছিলো। পাছে ইমাম হাসান আল বান্না তাঁদের সাথে মিলিত হয়ে সরকার বিরোধী কোন ঐক্য গড়ে তোলেন এই আশংকায় ইমাম হাসান আল বান্নাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। গৃহবন্দী করা হয় আলী মাহির পাশাকে। আর গ্রেফতার করা হয় আযীয আলী আল মিসরীকে।
ইমাম হাসান আল বান্না প্রথম কারাবরণ
অল্প কাল করেই ইমাম হাসান আল বান্না কায়রোতে আসেন ইংরেজ বিরোধী জনমত গড়ে তোলার জন্য। সরকার আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সরকার ইমাম হাসান আল বান্না ও সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল হাকীম আবিদীনকে মুক্তি দেয়। ইংল্যান্ড বরাবরই ইসলামের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করে আসছিলো। মিশরে ক্রমবর্ধমান ইসলামী জাগরণ তাদের শংকিত করে তোলে। কূট-কৌশলের মাধ্যমে ইসলামী শক্তিকে বশে আনা যায় কিনা সেই চেষ্টাও তারা করে। ইংল্যান্ডের দূতাবাস থেকে ইমাম হাসান আল বান্না সাথে যোগাযোগ করা হয়। দূতাবাসের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আল ইখওয়ানুল মুসলিমুনের লক্ষ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি জানতে চান। তাঁকে সব জানানো হয়।
সব শুনে তিনি বাহ্যতঃ সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি আল ইখওয়ানকে আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব দেন। বিচক্ষণ শায়খ হাসানুল বান্না ধন্যবাদ সহকারে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্রধানমন্ত্রী হুসাইন সিররী পাশা নির্বিঘ্নে শাসন চালাতে পারছিলেন না। ইংরেজদের সাথে তাঁর মাখামাখি জনমনে ক্রোধের সঞ্চার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে হুসাইন সিররী পাশা পদত্যাগ করেন। কিং ফারুক ওয়াফদ পার্টির নেতা মুসতাফা আন্নাহাস পাশাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।
এই সময় সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তারা একদিকে কিং ফারুক ও অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত প্রশাসনের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদেরকে বিরক্ত করে তোলে। কিছু সংখ্যক তরুণ অফিসার ‘‘ফ্রি অফিসারস’’ নামে একটি গোপন সংস্থা গড়ে তোলে। তারা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আঁটছিলো। এই অফিসারগণ দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। আনোয়ারুস সা’দাত ও আবদুন মুনীম আবদুর রউফ শায়খ হাসানুল বান্নার সাথে যোগাযোগ করেন।
শর্ত সাপেক্ষে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো
এই দিকে প্রধানমন্ত্রী মুসতাফা আন্ নাহাস পাশা পার্লামেন্টের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। আল ইখওয়ান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিতে থাকে। সিদ্ধান্ত হলো ইমাম হাসান আল বান্না ইসমাঈলিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। প্রধানমন্ত্রী মুসতাফা আন নাহাস পাশা দেখলেন যে আল ইখওয়ান নির্বাচনে নামলে তাঁর দল ওয়াফ্দ পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই জন্য তিনি শায়খ হাসানুল বান্নাকে তাঁর কাছে ডেকে নেন এবং আল ইখওয়ান যাতে নির্বাচনে না নামে তার জন্য চাপ দেন। অনেক বাদানুবাদ হয়। অবশেষে কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে আল ইখওয়ান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে সম্মত হয়। প্রধানমন্ত্রী ওয়াদা করেন যে আল ইখওয়ানকে নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে দেয়া হবে। মদ ও বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আল ইখওয়ানের পত্র-পত্রিকাগুলোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে।
১৯৪২ সনের শেষ ভাগে প্রধানমন্ত্রী মুসতাফা আন্ নাহাস পাশা বেঁকে বসেন। আল ইখওয়ানের প্রতি তিনি আবার বৈরি মনোভংগি দেখাতে শুরু করেন। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আল ইখওয়ানের শাখাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। কেবল কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়।
মুস্তাফা আন্ নাহাস পাশার সরকার ইংরেজদের সমর্থনপুষ্ট ছিলো। এই সরকার ইমাম হাসান আল বান্নাকে তাদের পথে সবচে’ বড় কাঁটা মনো করতো। শুনা যাচ্ছিলো, শায়খ বান্নাকে অচিরেই কোথাও নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তিনি এর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে থাকেন। আর একটি সার্কুলার লেটারের মাধ্যমে তিনি কর্মীদের জন্য বিশেষ হিদায়াত পাঠান। তবে শেষ পর্যন্ত ইমাম হাসান আল বান্নাকে নির্বাসিত করা হয়নি।
পার্লামেন্ট নির্বাচনে আল ইখওয়ান
১৯৪৫ সনের জানুয়ারী মাসে মিসরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্ট গঠনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন অংশগ্রহণ করে। ইমাম হাসান আল বান্না ইসমাঈলিয়া থেকে ও অন্য নেতৃবৃন্দ অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জনমত এতোখানি অনুকূল ছিলো যে নেতৃবৃন্দের সকলেই নির্বাচিত হওয়ার কথা। চরম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বহুমুখী কারসাজি করে ইমাম হাসান আল বান্না ও তাঁর সহকর্মীদের নিশ্চিত বিজয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করা হয়। আহমাদ মাহির পাশার দলকে জয়ী করা হয়।
শায়খ হাসানুল বান্নার দ্বিতীয় কারাবরণ
নির্বাচনের পর আহমাদ মাহির পাশা শক্ত হয়ে বসেন। তিনি ইংরেজদের ইচ্ছা পূরণের উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত নেন জার্মেনী ও তুর্কীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার। ১৯৪৫ সনের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি আহমাদ মাহির পাশা যুদ্ধে নামার সিদ্ধান্ত সম্বলিত ঘোষণাটি পাঠকালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। প্রচার করা হলো, এটি আল ইখওয়ানের কাজ। শায়খ হাসানুল বান্না, আহমাদ আশ্ শুককারী ও আবদুল হাকী আবিদীনকে গ্রেফতার করা হয়।
আততায়ী ধরা পড়েছিলো। জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে স্বীকার যে সে ন্যাশনালিস্ট পার্টির লোক। অতপর শায়খ হাসানুল বান্না ও তাঁর দুইজন সহকর্মীকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন মাহমুদ ফাহমী আন্ নুক্রাশী পাশা। শায়খ হাসানুল বান্না তাঁর সাথে দেখা করেন। আহমাদ মাহির পাশার হত্যাতে দুঃখ প্রকাশ করেন। এই সুযোগে তিনি তাঁকে আল ইখওয়ানের লক্ষ্য কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি অবহিত করেন। মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা আল ইখওয়ানকে ঘৃণা চোখে দেখতেন। শায়খ হাসানুল বান্নার সাক্ষাত ও আলাপের পরও তাঁর মনোভংগির কোনই পরিবর্তন হয়নি। বরং তিনি আল ইখওয়ানের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি আরো বাড়িয়ে দেন।
মিসরের জনমত ছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে। সুয়েজ খালে ইংরেজদের অবস্থান জনগণ মেনে নিতে পারছিলো না। গ্রেট ব্রিটেনের প্রতি নতজানু নীতি দেশের গণ-মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তরুণ সমাজ সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মুসতাফা মুমিনের নেতৃত্বে ছাত্রগণ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার মুখে মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা পদত্যাগ করেন। উল্লেখ্য যে মুস্তাফা মুমিন আল ইখওয়ানের ছাত্র-শাখার একজন নেতা ছিলেন।
১৯৪৬ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন ইসমাইল সিদকী পাশা। তিনিও ইংরেজদের আজ্ঞাবহ ছিলেন। আল ইখওয়ান ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ও আপোসহীন মনোভাব গ্রহণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ দিতে থাকে। এই দাবি উত্থাপিত হয় ছাত্র ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। দেশে দারুণ রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এই অবস্থাতেই ইসমাইল সিদকী পাশা ইংরেজদের সাথে চুক্তির একটি খসড়া প্রকাশ করেন। মিসরের গণ-মানুষ বিক্ষোভের মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করে। ৮ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা আবার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
ফিলিস্তিন যুদ্ধে ইখওয়ানুল মুসলেমিন
১৯৪৭ সনের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন বিভক্তকরণের প্রস্তাব গ্রহীত হয়। ফিলিস্তিনের বুকে একটি ইয়াহুদী রাষ্ট্র পত্তনের জন্যই গৃহীত হয় এই প্রস্তাব। দুনিয়ার মুসলিমদের পক্ষে এই প্রস্তাব মেনে নেয়া সম্ভব ছিলো না। ফিলিস্তিনের গ্র্যান্ড মুফতী আমীন আল হুসাইনী ইয়াহুদীদের মুকাবিলার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আল ইখওয়ানের অন্যতম সদস্য ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার মাহমুদ লাবীব। ইমাম হাসান আল বান্না তাঁকে ফিলিস্তিন পাঠান।
মাহমুদ লাবীব মুফতী আল হুসাইনীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ফিলিস্তিনী যুবকদের সমন্বয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। তিনি এই কাজ বেশি দিন করতে পারেননি। ইংরেজগণ তাঁকে ফিলিস্তিন ত্যাগ করতে বাধ্য করে। এই সময় আরব লীগের উদ্যোগে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছিলো। আল ইখওয়ানের কর্মীগণ ব্যাপক হারে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দেয়।
১৯৪৮ সন। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি ছিলো আরেকটি কঠিন বছর। ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনে জেঁকে বসে। ইসলামী চিন্তা নায়কগণ জিহাদের ডাক দেন। এই দুর্দিনে ফিলিস্তিনের মুসলিম ভাইদের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য ছিলো দুনিয়ার সকল মুসলিমের। শায়খ হাসানুল বান্না মিসর থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনের সদস্যদেরকে ফিলিস্তিন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। আহমাদ আবদুল আযীযের কমাণ্ডে একদল স্বেচ্ছাসেবক অচিরেই আল আরিস গিয়ে পৌঁছে। সেনাবাহিনী ছেড়ে আসা কামালুদ্দীন হুসাইন ও সালাহ সালিম স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগদান করেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ইয়াহুদীদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
ফালুজা অঞ্চলে মিসরীয় সেনাবাহিনীর একটি দল ইয়াহুদীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গিয়েছিলো। আল ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তাদের সাহায্যে এগিয়ে যায়। যুদ্ধে আল ইখওয়ানের বীরত্ব ও দেশময় তাদের জনপ্রিয়তা দেখে ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো ইংরেজদের প্রিয়পাত্র প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা। রাজা ফারুকের মনেও ভয় ঢুকে গেলো। এই বুঝি আল ইখওয়ান গোটা মিসর দখল করে বসে!
ফিলিস্তিন যুদ্ধে ইখওয়ানের স্বেচ্ছাসেবকগণ বীরের মতো লড়ছিলো ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে। ইয়াহুদীরা এদেরকে ভীষণ ভয় করতো। দুঃখের বিষয় তাদের সাফল্যই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। একদিন রাতে মিসরের সেনাবাহিনী স্বেচ্ছাসেবকদের শিবিরগুলো ঘিরে ফেলে। প্রধান সেনাপতি ফুয়াদ সাদিক তাদেরকে নির্দেশে দেন অস্ত্র ত্যাগ করে দেশে ফিরে যেতে অথবা সরাসরি মিসরীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডে থেকে যুদ্ধ করতে। ক্ষুণ্ন মনে কেউ দেশে ফিরে গেলো। কেউ বা কোন না কোনভাবে যুদ্ধের ময়দানে থেকে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করলো।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন নিষিদ্ধ ঘোষণা
ইতোমধ্যে সারাদেশে আল ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শাখা সংখ্যা দুই হাজারে উন্নীত হয়। জনশক্তির সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় বিশ লাখ। আল ইখওয়ানের অব্যাহত শক্তি বৃদ্ধি সরকারকে ভীত-শংকিত করে তোলে। মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশা আল ইখওয়ানুল মুসলিমূনকে বে-আইনী ঘোষণার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে বোমা ও অস্ত্রশস্ত্র রেখে বলা হতে থাকে যে এইগুলো আল ইখওয়ানের কাণ্ড। বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তি আততায়ীর হাতে প্রাণ হারায়। বলা হলো, এইসব হত্যাকাণ্ড আল ইখওয়ান সংঘটিত করেছে।
১৯৪৮ সনের ৮ ই ডিসেম্বর। রাত এগারোটা। শায়খ হাসানুল বান্না তাঁর সহকর্মীদেরকে নিয়ে কায়রোতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে রেডিওতে প্রচারিত খবর শুনছিলেন। খবর প্রচারিত হলো, আল ইখওয়ানুল মুসিলিমূনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হলো যে আল ইখওয়ান দেশে একটি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাবার প্রস্তুতি নিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসে পুলিশের গাড়ি। উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতার করা হলো না শুধু শায়খ হাসানুল বান্নাকে। আল ইখওয়ানের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। আল ইখওয়ান পরিচালিত স্কুল, ক্লাব, হাসপাতাল, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ডিসেম্বর মাসে ঘটে আরেক ঘটনা। আবদুল মাজীদ আহমাদ হাসান নামক ২৩ বছর বয়সী একজন ছাত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ফাহমী আন্নুকরাশী পাশাকে হত্যা করে। এবারও উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হয়। আল ইখওয়ানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার তীব্রতর করা হয়।
নতুন প্রধানমন্ত্রী হন ইবরাহীন আবদুল হাদী। আল ইখওয়ান তো দূরে থাক, তিনি কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবুও শায়খ হাসানুল বান্না তাঁর সাথে দেখা করেন। তাঁকে নানাভাবে বুঝাতে থাকেন যাতে আল ইখওয়ানের ওপর থেকে তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। কিন্তু কোন ফল হলো না। ইমাম হাসান আল বান্না আশা ছাড়লেন না। সরকারী মনোভাব পরিবর্তনের জন্য তিনি ধৈর্যসহকারে প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন।
সারাদেশ থেকে ইখওয়ানের লোকদেরকে গ্রেফতার করা হয়। বন্দীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে দাঁড়ায়। জেলখানায় তাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। কেন্দ্র থেকে শুরু করে গ্রাম-পর্যায়ের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু শায়খ হাসানুল বান্নাকে গ্রেফতার করা হয়নি। ইমাম হাসান আল বান্না বলতেন, তাঁকে গ্রেফতার না করার অর্থ হচ্ছে যে তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়েছে।
ইমাম হাসান আল বান্নার শাহাদাত
১৯৪৯ সনের ১২ই ফেব্রুয়ারী। এই দিন কায়রোতে ইয়াং মুসলিমস এসোসিয়েশানের একটি মিটিংয়ে শায়খ হাসানুল বান্না মেহমান বক্তা হিসেবে আসেন। মিটিং শেষে তিনি উক্ত সংস্থার কার্যালয় থেকে বের হন। রাস্তায় নেমে তিনি ট্যাকসীতে উঠতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আততায়ীর গুলি এসে বিঁধে তাঁর বুকে। রক্ত রঞ্জিত দেহ নিয়ে শায়খ হাসানুল বান্না ঢলে পড়েন। সংগীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। আল্লাহর দীনের সৈনিক আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে চলে যান।
লাশ পাঠানো হয় তাঁর বাসায়। পুলিশ এসে বাড়ির চারদিক ঘেরাও করে ফেলে। নিকট আত্মীয় ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হলোনা তাঁর বাড়িতে। ট্যাংক বাহিনী ও সাঁজোয়া বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীসহকারে তাঁর লাশ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ দূরে অবস্থান করে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। সরকার তাদেরকে তাঁর জানাযা ও দাফন কাজে অংশগ্রহণ করতে দিলোনা।
আলহামদুলিল্লাহ! তারা ইমামকে মিশর থেকে মুছে দিয়ে চেয়েছিল কিন্তু ইমাম ছড়িয়ে পড়েছেন সারাবিশ্বে।
Discussion about this post