১৯৮৪ সালে এরশাদের সাথে সংলাপ ব্যর্থ হয়ে গেলে বিনা বাধায় ‘৮৪ সালের মে মাসে উপজিলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয়ে গেল। এ সাফল্যের ভিত্তিতেই ‘৮৫ সালের ২১শে মার্চ স্বৈরশাসকদের ঐতিহ্য মোতাবেক তথাকথিত গণ-ভোটের মাধ্যমে প্রধান সামরিক শাসনকর্তা ‘নির্বাচিত’ প্রেসিডেন্ট হয়ে গদীতে মজবুত হয়ে বসলেন।
‘৮৫ সালের শেষ দিকে যুগপৎ আন্দোলনের আবার সূচনা হলো। আন্দোলন দানা বাঁধার মুখে ‘৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে চরম মতবিরোধ হয়। যুগপৎ আন্দোলন আবার থেমে যায়।
রাজনৈতিক ঐ পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের তিন দিনব্যাপী এক বৈঠক হয়। ব্যাপক আলোচনার পর জামায়াত সিদ্ধান্ত নেয় যে, যুগপৎ আন্দোলনের কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য না থাকায় স্বৈরশাসককে অপসারণের কোনো সম্ভাবনাই নেই, তাই জনগণকে নির্বাচনমুখী করা ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচির প্রতি তেমন সাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। দুই জোটকেও নির্বাচনমুখী করার চেষ্টা করতে হবে। নির্বাচনে যাতে এরশাদের দল কিছুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হতে না পারে, সে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অন্য কোনো বিকল্প কর্মসূচির সম্ভাবনা নেই।
বিশেষ করে জামায়াতের জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ সবচেয়ে জরুরি। কারণ, নতুন দেশ বাংলাদেশে জামায়াতের নামে তখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে আইনগতভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। কোনো দল পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এবং নির্বাচন কমিশন সে দলের জন্য প্রতীক বরাদ্দ করলে দলটি আইনগতভাবে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে গেল।
যদি নির্বাচনে অন্তত ১০টি আসনে জয়ী হয় তবে পার্লামেন্টারি পার্টির মর্যাদা পেয়ে যায়। নির্বাচনে কোনো আসন না পেলেও আইনগত সার্টিফিকেট পেয়ে গেল। এ মর্যাদা পেলে রাজনৈতিক ময়দানে সে দলটিকে স্বীকৃতি দিতে সবাই বাধ্য। শেষ পর্যন্ত কর্মপরিষদের সকল সদস্য একমত হলেন যে, জামায়াতের অস্তিত্বের স্বার্থেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন।
এত বড় ইস্যুতে কর্মপরিষদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের গঠনতান্ত্রিক ইখতিয়ার না থাকায় জামায়াতের মজলিসে শূরা আহ্বান করা হলো। মজলিসে শূরা সদস্যগণ বিষয়টির গভীর তাৎপর্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রাণ খুলে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। মজলিসে শূরায় দুই দিন বিস্তারিত আলোচনার পর নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ।
রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলসমূহ ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অপরদিকে প্রকাশ্যে নির্বাচনবিরোধী বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছিল। বড় দুই জোটের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকাই স্বাভাবিক। কোনো দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা না বলায় পারস্পরিক সন্দেহ বিরাজ করছিল। এ পরিবেশে শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে দলীয় জনসভায় বলেন, এরশাদ সরকারের পরিচালনায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অর্থহীন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদের গদি মযবুত করবে তারা ‘জাতীয় বেঈমান’ হিসেবে গণ্য হবে।
অথচ ১৫ দলীয় জোটের শরীক দলগুলো নির্বাচনে আসন দাবি করে লীগের সাথে রীতিমতো দর কষাকষি চালাচ্ছে। তখন জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার আলোচনা চলছে। বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে কর্নেল মুস্তাফিজ ও জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকাদি চলল। প্রথমে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতকে মাত্র ২০টি আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কয়েক দিনের দর কষাকষির পর কর্নেল মুস্তাফিজ ৫০টি আসন জামায়াতকে ছেড়ে দিতে সম্মত হলে শেষ পর্যন্ত জামায়াত তা মেনে নেয়।
জামায়াতকে এত বেশি আসন ছেড়ে দিতে সম্মত হওয়ায় নিজ দলীয় বৈঠকে কর্নেল মুস্তাফিজ রীতিমতো নাজেহাল হন। ফলে বিএনপির সাথে নির্বাচনী সমঝোতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে রাজনৈতিক জোট ও দলসমূহের কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা না হওয়ায় জেনারেল এরশাদ ধমকের সুরে ঘোষণা করলেন, ১৯ মার্চ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। ২০ মার্চ তিনি জাতির উদ্দেশে নির্বাচন সম্পর্কে ভাষণ দেবেন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না তাদেরকে নির্বাচন বিরোধী কোনো তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার খবর তিনি হয়তো জানতেন। তাই এই টাইপের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে পেরেছেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১৯ মার্চ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিজ নিজ দলীয় কার্যালয়ে মিটিং ডাকলো। জামায়াতও ঐ একই তারিখে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিল।
জামায়াত আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে দুই জোটের এক জোটও যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে জামায়াত অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। জামায়াত অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলো। জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির আহ্বায়ক শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন।
রাত ১১টা পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত জানা গেল না। দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিক ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে আওয়ামী লীগের সংবাদ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। বিএনপির খবর মুজাহিদ সাহেব ফোনে নিচ্ছিলেন। রাত ২টার সময় দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিক মোটর সাইকেলে খবর নিয়ে এলেন। খবর এল যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু বিএনপি তখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছেনি।
বিএনপির তদানীন্তন মহাসচিব ওবায়দুর রহমানের সাথে মুজাহিদ সাহেব অব্যাহতভাবে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। রাত তিনটায় ওবায়েদ সাহেব শহীদ মুজাহিদ সাহেবকে জানালেন, //একটা টেকনিক্যাল কারণে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আগামীকাল সিদ্ধান্ত নেব। আপনাদের সিদ্ধান্ত পত্রিকায় দিয়ে দিন।//
সকল পত্রিকা অফিস তখন পর্যন্ত খবরের প্রতীক্ষা করছিল। ২০ মার্চ (১৯৮৬) বড় বড় হেডিং-এ পত্রিকায় খবর বের হলো, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বিএনপি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বিএনপির টেকনিক্যাল কারণটি কী?
শহীদ মুজাহিদ ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করে ঐ কারণটি জেনে নিলেন। বিএনপির প্রথম সারির নয়-দশজন নেতা প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের মন্ত্রী ছিলেন। জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করার পর তাদের বেশ কয়েকজনকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য বলে অন্যায়ভাবে অর্ডিন্যান্স জারি করেন। তাদের মধ্যে ওবায়দুর রহমানও ছিলেন একজন।
বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করার উদ্দেশ্যে ঐ অর্ডিন্যান্স বাতিল করে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ওয়াদাও নাকি এরশাদ বিএনপি-কে দিয়েছিলেন। ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পর্যন্ত ঐ ওয়াদা পূরণ না করায় বিএনপি সমস্যায় পড়ে গেল। পরের দিন ওয়াদা পূরণের অপেক্ষায় থাকার পর বিএনপি বুঝতে পারল, স্বৈরাচার এরশাদ তাদের ধোঁকা দিয়েছেন।
তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে হাসিনার দেওয়া ‘জাতীয় বেঈমান’ উপাধিটি আওয়ামী লীগের প্রতি সার্থকভাবে প্রয়োগ করল। আসল যে কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলো না, তা তো জনগণের নিকট প্রকাশ করা যায় না।
উভয় জোট এতদিন পর্যন্ত এরশাদ সরকারের পরিচালনায় নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে প্রচার করেছে। এখন বিএনপি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে নির্বাচন বর্জনকে গৌরবের সাথে প্রচার করতে থাকল। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন দল হিসেবে আবির্ভূত হলো। ‘জাতীয় বেঈমান’ গালি খেয়ে আওয়ামী লীগ দাবি করলো, বিএনপি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তারা আরো দাবি করলো, বিএনপির সাথে তাদের নির্বাচনী প্রার্থীদের তালিকার বিনিময়ও হয়েছে।
জামায়াত বিএনপি’র সাথে পরামর্শ করেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর জামায়াত আওয়ামীলীগের মতো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণাও দেয়নি। এই প্রসঙ্গে শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //জামায়াত বিএনপির সাথে এবং তাদের মহাসচিবের সম্মতি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের খবর পত্রিকায় পরিবেশন করেছে। তাই জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি। জামায়াত তো নিশ্চিতই ছিল যে, বিএনপিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।//
১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অনেক দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে ১৫ দল থেকে পাঁচটি বামদল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে, আওয়ামী লীগ ৭৬ আসনে ও জামায়াত ১০ আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে এরশাদ ঢালাওভাবে ডাকাতি না করে জেনারেল জিয়াকে অনুসরণ করেছিলেন। কোন কোন আসন জাতীয় পার্টিকে জয়ী করা হবে তা আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে। জামায়াতের রংপুরের এক প্রার্থী শাহ রুহুল ইসলামকে জোরপূর্বক হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই আসনের সকল ব্যালট বাক্স সেনাবাহিনী সেনানিবাসে নিয়ে এসে ফলাফল ঘোষণা দেয়।
জামায়াত নির্বাচনে সন্তুষ্ট না হলেও রাজনৈতিক টার্গেট পূরণ হয়। পার্লামেন্টারিয়ান দলে পরিণত হয়। মার্কা হিসেবে দাড়িপাল্লাও বৈধতা পায়। নির্বাচনের শুরুতে এই নিয়ে ঝামেলা হয়। এটা সুপ্রিম কোর্টের প্রতীক হিসেবে জামায়াতকে পাল্লা মার্কার বরাদ্দ দিতে চায়নি নির্বাচন কমিশন। পরে ১৯৭০ এর নির্বাচনের নথিপত্র দেখিয়ে এই বৈধতা অর্জন করে।
১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আবার যুগপৎ আন্দোলন গড়ে উঠে। ‘৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় তারাই এ আন্দোলনে অধিকতর সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে। বিরোধী দলগুলো সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে সংসদ থেকে গণ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ৬ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ১০ সদস্য- বিশিষ্ট সংসদীয় দল তাদের নেতা অধ্যাপক মুজীবুর রহমানের নেতৃত্বে স্পীকার জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীর নিকট যেয়ে পদত্যাগ পত্র পেশ করেন।
আওয়ামী লীগ বিবিসি’কে পদত্যাগ করবেন বলে জানানো সত্ত্বেও বিদেশে অবস্থানকারী নেত্রীর সম্মতির অভাবে দোদুল্যমান থাকা অবস্থায় তিন দিন পর সরকার সংসদ ভেঙ্গে দেয়। আওয়ামী লীগ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। এরশাদ সরকার সংসদ ভেঙ্গে দেয়।
প্রধান দুই দলের সমন্বয়ের অভাবে যুগপৎ আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় ঐ অনুকূল পরিবেশটিকেও কাজে লাগনো গেল না। ফলে এরশাদ ‘৮৮ সালের মার্চ মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এ নির্বাচনে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে কয়েকটি বাম দল ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের সকল দলই ঐ নির্বাচন বয়কট করে । প্রহসনমূলক এবং ভোটার বিহীন নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিত্বহীন সংসদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো সোচ্চার হতে থাকে। এরশাদের পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙ্গে দেবার দাবীতে আন্দোলন ঢিমে তালে চলতে থাকে ।
১৯৮৯ সালের অক্টোবরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জামায়াত প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারে সম্মত হয়। এবার সব বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অভিন্ন দাবীর কারণে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাংগা হয়ে উঠে। কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সুনির্দিষ্ট দাবী সর্বমহলে সহজে বোধগম্য হওয়ায় স্বৈরশাসনের অবসানের পথ সুগম হয়।
কীভাবে সরকার পরিবর্তন করা হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দাবী উত্থাপিত হওয়ায় আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার হয়। কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর দেওয়া ফর্মূলা অনুযায়ীই ১৫, ৭ ও ৫ দলীয় জোটের নামে একটা রূপরেখা পেশ করা হয়। এতে বলা হয় যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির হাতে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। প্রধান বিচারপতি অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত (মন্ত্রীর মর্যাদায়) উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। এ নবগঠিত সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন।
এবার সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন জোরদার হলো এবং জনগণ সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলো। ঠিক ঐ পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ায় আন্দোলন তুঙ্গে উঠলো। সরকারের ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে জনগণ ময়দানে নেমে এলো। সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে এরশাদ সরকারের পক্ষে ভূমিকা রাখতে অস্বীকার করলো। বাধ্য হয়ে এরশাদ ৬ই ডিসেম্বর (১৯৯০) পদত্যাগ করলো।
কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলন সফল হলো। প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হাতে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হলেন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে ১৫ ও ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামীর সাথে জেনারেল এরশাদের সংলাপের সময় যদি কেয়ারটেকার সরকার দাবীটি সবাই একসাথে পেশ করতে সক্ষম হতো তাহলে স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি ‘৯০ সাল পর্যন্ত বিলম্বিত হতো না ।
প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত সফল নিরপেক্ষ নির্বাচনে কোন দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে সমস্যা দেখা দিল। ঘটনাক্রমে ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ১৮টি আসনের অধিকারী জামায়াতে ইসলামীর হাতে ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’ এসে পড়লো। জামায়াত ক্ষমতায় অংশীদার না হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থভাবে বিএনপি’কে সরকার গঠনে সাহায্য করলো। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন।
জুন মাসে বাজেট সেশনেই জামায়াতে ইসলামী পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিকে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভূক্ত করার উদ্দেশ্যে সংসদে পেশ করার জন্য একটি বিল জমা দেন। পরে ঐ বছরই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি পৃথকভাবে এ উদ্দেশ্যে বিল জমা দেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বিএনপি এ বিষয়ে মোটেই গ্রাহ্য করলো না।
১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন যদি জেনারেল এরশাদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হতো তাহলে নিশ্চয়ই বিএনপি ক্ষমতাসীন হতে পারতো না। বিএনপি সরকার কেয়ারটেকার সরকারেরই ফসল। ভবিষ্যতে যাতে এ পদ্ধতিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য দেশের শাসনতন্ত্রে এ বিষয়ে একটি আইনের সংযোজন করাই সবচাইতে যুক্তিসংগত। এ পদ্ধতিতেই জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিশ্চিত হয়।
দুঃখের বিষয় বিএনপি সংসদে ‘কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি’ সম্পর্কিত বিল আলোচনার সুযোগই দিতে রাজি হলো না। জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকার দাবী নিয়ে ১০ বছর (১৯৮০ থেকে ১৯৯০) আন্দোলন করেছে। ‘৯০ সালে বিএনপিও এ আন্দোলনে শরীক ছিল। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির সুবাদেই তাঁরা ক্ষমতায় গেলেন। অথচ এ পদ্ধতিটি সংসদে আলোচনা পর্যন্ত করতে দিলেন না। তাঁরা ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় নির্বাচন করে ক্ষমতায় স্থায়ী হবার অবৈধ উদ্দেশ্য না থাকলে এমন স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারতো না।
১৯৯৪ সালের এপ্রিলে মাগুরা জেলার একটি আসনে উপনির্বাচন হয়। এটি আওয়ামী লীগের আসন ছিল। বিএনপি’র খালেদা সরকার একচেটিয়াভাবে সন্ত্রাসী দিয়ে সকল কেন্দ্র করে নেয়। এভাবে নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে নেবার পর আওয়ামী লীগ ঘোষণা করল যে কেয়ারটেকার সরকার কায়েম না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি সরকারের পরিচালনায় কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো না। নতুন করে আবার শুরু হলো কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন।
– চলবে
লেখক : ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Discussion about this post