মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ সম্প্রতি তুরস্ক সফর করার সময় সে দেশের সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারটির বিশেষ অংশ অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের তুলে ধরা হলো। সাক্ষাতকারটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছে প্রথম আলো।
আনাদোলু এজেন্সি: ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনের পক্ষে আপনি দীর্ঘদিন অনড় থেকে এসেছেন। এ কারণে মুসলিম বিশ্বে আপনার ব্যাপক সমর্থন ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের নৃশংস নীতির বিরুদ্ধে কী ধরনের নীতি নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
মাহাথির মোহাম্মদ: ফিলিস্তিনের মানুষের সমস্যার বিষয়ে আসল সত্য এখনো যথার্থভাবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বা টেলিভিশনে তুলে ধরা হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ফিলিস্তিনিদের সমস্যা নিয়ে সংবাদ প্রচারের বিষয়ে সংবাদমাধ্যম কোনো অলিখিত চুক্তি করে বসে আছে। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে কীভাবে তাদের ভূমি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তা কেউ উল্লেখ করতে চায় না। ইসরায়েল একের পর এক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ফিলিস্তিনের জমি দখল করেই যাচ্ছে। এ নিয়ে মিডিয়ায় কোনো উচ্চবাচ্য হয় না। আমাদের আসলে সন্ত্রাসের মূল কারণের ওপর সব সময়ই জোর দেওয়া উচিত। আজ ঢালাওভাবে মুসলমানদের সন্ত্রাসের জন্য দোষারোপ করা একটা সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেওয়ার পর এবং ইসরায়েলের বারবার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের পরই এসব তথাকথিত সন্ত্রাস ছড়িয়েছে। এই সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্তি পেতে হলে আগে সন্ত্রাসীরা কেন সন্ত্রাস করছে, তার আসল কারণ আমলে নিতে হবে।
মালয়েশিয়ায় আমরা সব মানুষের হৃদয় জয় করার পরিকল্পনা করেছিলাম। এমনকি মালয়েশিয়ার সন্ত্রাসীদেরও আমরা ভালোবাসায় বন্দী করতে চেয়েছি এবং সে কারণেই আমাদের দেশে সন্ত্রাসবাদের সমাপ্তি হয়েছে।
আনাদোলু এজেন্সি: যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংকট নিরসনে ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ শীর্ষক একটি ধারণা সামনে এনে থাকে। এই ধারণা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মাহাথির মোহাম্মদ: হ্যাঁ, শুধু তাদের নিজেদের দিককার সমস্যার কথা প্রচার করার জন্য এই ‘প্রকল্প’ বানানো হয়েছে। ফিলিস্তিনে আন্তর্জাতিক আইন কীভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেদিকে মন না দিয়ে তারা ফিলিস্তিনে যা যা করছে, তা এর মধ্য দিয়ে ‘জায়েজ’ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের জায়গাজমি কেড়ে নেওয়ার সময় কিন্তু তারা কখনো গণভোট দেয় না বা জনমত জানার আগ্রহ দেখায় না। ফিলিস্তিনের জায়গা কেড়ে নিয়ে ইসরায়েলের হাতে তুলে দেওয়ার সময় তারা কিন্তু একবারও সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের কথা ভাবেনি।
আনাদোলু এজেন্সি: আপনি বলছেন ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল ইস্যুতে সন্ত্রাসের মূল কারণের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আপনি কি মনে করেন, অবৈধভাবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠাই সন্ত্রাসের প্রধান কারণ?
মাহাথির মোহাম্মদ: হ্যাঁ, এটিই প্রধান কারণ। তবে এটি এখন অবশ্যই মানতে হবে যে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এখন ইসরায়েলের ফিলিস্তিনিদের নিজ নিজ বসতিতে ফিরতে দেওয়া উচিত। তা না পারলে অন্তত পশ্চিম তীরে নতুন নতুন ইহুদি বসতি গড়া বন্ধ করা উচিত। ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে ইনসাফ নিশ্চিত করা গেলে সারা বিশ্বেই সন্ত্রাস বহুলাংশে কমে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আনাদোলু এজেন্সি: মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে আপনার সরকারের আগ্রহ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের এপর চাপ দিতে আপনার সরকার আহ্বান জানিয়েছে। এ ছাড়া আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন আবদুল্লাহ মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা নিধনে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মালয়েশিয়া কোন নীতি অনুসরণ করছে, সে বিষয়ে একটু বলবেন?
মাহাথির মোহাম্মদ: মালয়েশিয়া সাধারণত আরেক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে চায় না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে নির্বিচারে গণহত্যা হয়েছে, একটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে সমূলে বিনাশ করার চেষ্টা হয়েছে। যেহেতু মালয়েশিয়া গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেহেতু এ বিষয়ে আমরা আমাদের দিক থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। আমরা রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যা দেখে মনে করছি, মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে নেওয়া উচিত। মিয়ানমার একসময় অনেকগুলো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সেসব রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন আদিবাসী, উপজাতি ও নৃগোষ্ঠী ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেই বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলোকে এক করে শাসন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যের একটি সম্প্রদায়। মালয়েশিয়া সরকার মনে করে, মিয়ানমার সরকারকে হয় তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে, নয়তো তাদের নিজেদের মতো করে আলাদা রাজ্য দিতে হবে। আমরা মনে করি রোহিঙ্গারা নিপীড়িত হচ্ছে। তাই আমরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আছি।
আনাদোলু এজেন্সি: রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের (আইসিজে) সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মাহাথির মোহাম্মদ: উভয় পক্ষ যদি আদালতের তদন্ত প্রতিবেদনের সত্যতা মেনে নিতে রাজি হয়, শুধু তখনই আইসিজের সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়া সম্ভব। কিন্তু আইসিজে যদি একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে না। সে কারণে আইসিজের সিদ্ধান্ত কার্যকরের পূর্বশর্ত হিসেবে সবার আগে আমাদের মিয়ানমারকে এ বিষয়ে রাজি করাতে হবে।
আনাদোলু এজেন্সি: চীন থেকে বিতাড়িত হয়ে পূর্ব তুর্কিস্তানে যাওয়া উইঘুরদের দুর্দশা নিরসনে কী করা যেতে পারে বলে মনে করেন?
মাহাথির মোহাম্মদ: আমরা চীনকে বলতে পারি, দয়া করে এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে নাগরিক হিসেবে মূল্যায়ন করুন। বাস্তবতা হলো, শুধু একটি ভিন্ন ধর্মের মানুষ হওয়ার কারণেই তাদের সঙ্গে এই অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য ঠিক নয়। ধরুন মালয়েশিয়া, এটি একটি বহু ধর্মাবলম্বীর দেশ। কিন্তু এখানে সব ধর্মের মানুষকে সমভাবে মূল্যায়ন করা হয়। চীনে যখনই কোনো ছোটখাটো সহিংস ঘটনা ঘটবে, তখনই বুঝবেন এটি চীন সরকারের খেলা। এই সহিংসতা দেখিয়ে চীন দাবি করে, এই সহিংসতার কারণেই উইঘুরদের সঙ্গে ভিন্ন আচরণ করা হয়। এই অবস্থান থেকে চীনকে অবশ্যই সরে আসতে হবে।
আনাদোলু এজেন্সি: দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে গত বছর আবার ক্ষমতায় আসার পর আপনার সরকার মূলত কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করেন?
মাহাথির মোহাম্মদ: আমরা ক্ষমতায় এসে সাংঘাতিক কিছু সমস্যায় পড়েছি। বিশেষ করে আগের সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে সরকারের আর্থিক খাতকে বেকায়দায় রেখে গেছে। সেই ঋণের বোঝা কমানো আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আনাদোলু এজেন্সি: ধন্যবাদ।
মাহাথির মোহাম্মদ: ধন্যবাদ।