সারাদেশে পারিবারিক খুন বাড়ছে। মা তার সন্তানকে খুন করছে। স্বামী তার স্ত্রীকে খুন করছে। স্ত্রী তার স্বামীকে খুন করাচ্ছে ভাড়াটে খুনি দিয়ে ইত্যাদি অহরহ ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে। এইসব খুনের মূল উপজীব্য বিষয় হলো পরকীয়া। পরকীয়া এই সমাজে নতুন নয়। তবে বাংলাদেশে এর সর্বগ্রাসী রূপ এতটা কখনোই ছিল না। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন সমাজে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে দিন দিন। মেলামেশার সুবিধার কারণে অনেক সময় নারী-পুরুষের বন্ধুতা থেকে শুরু হয় পরকীয়ার। তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ সুবিধার কারণেও এই ধরনের অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। মোবাইল কোম্পানিগুলোর নানা অফার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ফেসবুক এবং পর্নোগ্রাফির মতো সহজলভ্য উপাদান থেকে আকৃষ্ট হয়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা হারাচ্ছে অনেকে। ভিনদেশী টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ছাড়াও ইদানীং দেশে তৈরি অনেক নাটক-সিনেমাতেও পরকীয়াকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পরকীয়ার কারণে পরিবার ভেঙে যায়। পারিবারিক ও সামাজিক সুখ নষ্ট হয়। একটি সমাজকে নষ্ট করে দেয়ার জন্য পরকীয়া বিষাক্ত ভাইরাসের মতোই কাজ করে বলে তারা মনে করেন।
পরকীয়ার কারণে তৈরী হচ্ছে নানান সামাজিক অপরাধ। এর পরিণতিতে খুন-খারাবি হচ্ছে নিয়মিত। বাড্ডায় জামিল শেখ নয় বছরের মেয়েসহ খুন হয়েছেন স্ত্রীর পরকীয়ার বলি হয়ে। ২১ অক্টোবর চট্টগ্রামের মিরসরাই এ ফারুককে হত্যা করেছে তার স্ত্রী জেসমিন আক্তার।১২ অক্টোবর কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে রাকিব হোসেনকে খুন করে তার স্ত্রী ও ছোট ভাই। ৯ অক্টোবর বনশ্রীতে জান্নাতুল বুশরাকে হত্যা করেছে তার স্বামী।এভাবে প্রায় প্রতিদিনই পরকীয়ার বলি হচ্ছে মানুষ। এছাড়াও পারিবারিক কলহ বাড়ছে। পারিবারিক নির্যাতন বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদও।
ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণ ও উত্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার। গতবছর এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ হাজার। যা ২০১৫ সালে ছিল প্রায় ৯ হাজার। এর আগে ২০১৪ সালে ৮ হাজার ২১৫টি, ২০১৩ সালে ৮ হাজার ২১৪, ২০১২ সালে ৭ হাজার ৯৯৫, ২০১১ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে ৫ হাজার ৩২২ এবং ২০১০ সালে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার। প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টির মতো বিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে। প্রতিবছরই আগের বছরের তুলনায় বাড়ছে এই সংখ্যা। বর্তমানে রাজধানীতেই নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ৪৯ হাজার বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন। ঢাকা শহরের চেয়ে সারাদেশে এই চিত্র আরো ভয়াবহ।
সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে জীবনযাপন মানুষের জীবনের খুব বেশি প্রভাব ফেলছে। এজন্য মধ্য ও উচ্চবিত্ত প্রায় প্রতিটি পরিবারের মধ্যেই খুব অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। উপরে উঠার জন্য ও নিজেদের প্রকাশ করার প্রতিযোগিতায় সমাজের মানুষ খুব বেশি অধৈর্য হয়ে পড়ছে। পরিবারগুলোর মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিকতার চর্চা উঠে যাচ্ছে। পারস্পরিক সহমর্মিতার অভাব, সম্মানবোধের অভাব সর্বোপরি ধর্মহীনতা, পর্দাহীনতার কারণে পরিবারগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ পরকীয়ার ঘটনা ঘটছে।
টেলিভিশনের মাধ্যমে, রিয়েলেটি শো, নাটক, সিনেমায় বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে ক্রমান্বয়ে লজ্জা কমে যাচ্ছে। যে কারণে মানুষের বৈচিত্র্যময় গোপন ইচ্ছেগুলো সহজে প্রকাশ পাচ্ছে। একসময় ডিভোর্স ছিলো খুব লজ্জার। কারও ডিভোর্স হলে তা গোপন রাখা হতো। যুগের পরিবর্তনে এখন অহরহ ডিভোর্স হচ্ছে। এতে কারও লজ্জা হচ্ছে না। একইভাবে পরকীয়াকে অনেকে সমর্থন করছেন। কিন্তু সমাজের জন্য তা কোনভাবেই ভালো হতে পারে না। উন্নত বিশ্বের আধুনিকায়নের অভিশাপ হচ্ছে আমাদের দেশের পরকীয়া সম্পর্ক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন হচ্ছে। আগে শিশুদের যেভাবে শিক্ষা দেয়া হতো এখন সেভাবে দেয়া হচ্ছে না। এখন বাবা-মায়েরা সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়ে ভাবছেন সন্তানকে তারা স্মার্ট বানাচ্ছেন। কিন্তু সন্তান যে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে চারিত্রিক দিক দিয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে এই ব্যাপারে পিতামাতারা একেবারে উদাসীন। সন্তানরা যেন অনৈতিক দিকে পা না বাড়ায় সেভাবেই তাদের শিক্ষা দিতে হবে। নতুবা বিশৃঙ্খলা-অশান্তির আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পাবে।
পরকীয়ার এই বিষাক্ত পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিল করে তুলছে কিছু মুক্তমনা নামধারী সামাজিক কীট। যারা পরকীয়াকে সামাজিক স্বীকৃতি দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগছেন। ওদের চাওয়া সমাজ থেকে ধর্মের প্রভাব উঠে যাক। পরিবার প্রথা ধ্বংস হয়ে যাক। এমনই একজন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তার মতে পরকীয়াতে লজ্জার কিছু নেই। মানসিক শান্তি-স্বস্তির জন্যই পরকীয়া মেনে নেয়া প্রয়োজন।
শুধু রোবায়েত ফেরদৌস নয়, এই নিকৃষ্ট কাজে অবদান রেখে যাচ্ছে এদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের কুশীলবরা। তারা সিনেমা এবং টিভি নাটকে পরকীয়াকে প্রমোট করছেন। আর একটি সাইটের কথা না বললেই নয় তা হলো উইম্যান চ্যাপ্টার। ‘পরকীয়া নয় স্বকীয়া’এসব আর্টিকেল লিখে তারা পরকীয়ার ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছে। সবশেষে দায় সরকারের। সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্টকারী এসব নাটক সিনেমা কীভাবে প্রচার পায়, কীভাবে তারা ছাড়পত্র পায় এসব বিষয় দেখার দায়িত্ব সরকারের। নারীর স্বাধীনতার নামে নারীকে পরকীয়াতে উৎসাহিত করে এমন লোকদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার। অশ্লীল সাইটসমূহ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া দরকার।
যেভাবে দেশ ধ্বংসের পথে আগাচ্ছে তাতে বাঙালি তার স্বকীয়তা হারাবে। আগামী প্রজন্মকে সুন্দর পারিবারিক জীবন উপহার না দিতে পারলে দেশ হারাবে তার দক্ষ, সৃজনশীল জনশক্তি। পরিবার-সমাজ ধ্বংস হলে এদেশের মানুষ পশুতে পরিণত হবে। পরকীয়ার কারণে দৈনিক মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হবে। পরিবারগুলো রক্ষা করতে হবে। আমাদের ভালোবাসার সুন্দর সম্পর্কগুলো রক্ষা করতে হবে। সময় ফুরিয়ে যায়নি। লাগাম টেনে ধরতে হবে এখনই। আর এর জন্য দায়িত্ব রয়েছে আমাদের সবার।
Discussion about this post