মার্শাল আমিন
গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দানকারী বিএনপি-সমর্থক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘হেল্প সেল’। গুম-খুন বন্ধে বিভিন্ন সময়ে সেমিনারেরও আয়োজন করে আসছে সংগঠনটি। এই সংগঠনটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরু। যাকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়ার ১২ ঘণ্টা পর গতকাল হাত-পা বাঁধা গুলিবিদ্ধ লাশ অবস্থায় পাওয়া গেছে কর্ণফুলী নদীর তীরে।
পত্রিকার সূত্রমতে, ২৯ মার্চ বুধবার রাত ১২টার দিকে নগরীর চকবাজার থানাধীন চন্দনপুরা (পশ্চিম গলি) মিন্নি মহলের বাসা থেকে ১০-১২ জন পুলিশ পরিচয়ে তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায়। ৩০ মার্চ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের খেলারঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে তার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। লাশের দুই হাত ও পা নাইলনের রশি দিয়ে বাঁধা ও মুখে কাপড় ঢোকানো ছিল। মাথায় গুলি ও সারা শরীরে জখমের চিহ্ন ছিলো।
অর্থাৎ অন্যসব গুম গুলোর মতই তাকেও বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং খুব নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তার মাথায় গুলির চিহ্ন থাকা মানে তাকে নির্যাতনের পর গুলি করেই হত্যা করা হয়। হাত পা সবকিছু দড়িতে বাঁধা দেখে বোঝা যায় যে, তাকে হত্যার পর লাশ চিরদিনের জন্য গুম করে দিতেই ভারি কোন কিছুর সাথে বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু কোনো কারনে ভারী বস্তুটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লাশটি নদীতে ভেসে উঠে। এমনটা না হলে হয়তো গুমের শিকার অন্যদের মত নুরুও চিরদিনের জন্য নিখোঁজই থেকে যেতো।
তাহলে কি আমরা ধারণা করতে পারি যে, গুম হওয়া সকলের পরিণতি নুরুর মতই হয়েছে? যদিও এমন কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু গুম হওয়ার ১২ ঘন্টার মাথায়ই নুরুল আলম নুরুর লাশ পাওয়া মানে তাকে তুলে নেয়ার পরপরই হত্যা করা হয়েছে। অন্যদেরকেও অর্থাৎ ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, ওয়ালিউল্লাহ, আল মোকাদ্দাসকেও কি তুলে নেয়ার পরই হত্যা করা হয়েছে? তাদের লাশ হয়তো নুরুর মত ভুল করে নদীতে ভেসে উঠেনি বা কোথাও খোঁজ মেলেনি। আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই না। আমরা আশাকরি তারা সবাই ফিরে আসবে।
নুরু কি জানতো, যেই গুম-খুন হওয়া মানুষদের জন্য তিনি সর্বদা পেরেশান ছিলেন, সেই গুম-খুনের তালিকায় একসময় তিনি নিজেও চলে যাবেন? এটা কি তিনি একদিন আগেও ভেবেছিলেন? গুম হওয়ার আগেরদিনও তিনি ফেসবুকে একটি অভিমানি পোষ্ট দিয়েছিলেন। পরের দিনই অভিমান নিয়েই হারিয়ে গেলেন।
অনেকের মতো আমিও মনে করি গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দানকারী ও সেমিনার আয়োজনকারী হেল্প সেলে তার স্বত:স্ফূর্ত ও সক্রিয় উপস্থিতিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চক্রান্তকারীরা তথা গুম-খুনের মূল হোতারা তার এবং তাদের এই কার্যক্রমকে সহ্য করতে পারেনি। তারা চায়নি গুম খুনের শিকারদের নিয়ে কোনো আলোচনা বা সেমিনার হোক। তারা চায়নি গুম খুনের শিকার পরিবারের লোকদের আবেগাপ্লুত অস্রুশিক্ত বক্তব্য মিডিয়ায় যাক। তারা চায়নি বাংলাদেশের গুম খুনের এই ভয়ংকর পরিস্থিতি বিশ্ব জানুক। তারা চেয়েছিলো, গুম খুনের শিকাররা চিরতরে হারিয়ে যাবে। তাদের হারিয়ে যাওয়া থেকে বাকিরা শিক্ষা নিবে এবং সরকারি দলের শত অপকর্মেও কোনো প্রতিবাদ জানাবে না, চুপটি মেরে থাকবে কিংবা এলাকা ও দেশ ছেড়ে পালাবে।
কিন্তু নুরুরা তাদের সেই চাওয়াকে সফল হতে দেয়নি। তারা সভা সেমিনারের মাধ্যমে বাংলাদেশের গুম খুনের ভয়ংকর পরিস্থিতিকে বার বার আলোচনায় এনেছে এবং বিশ্বব্যাপী জানান দিয়েছে।
এসব কারনেই হতে পারে নুরুদের উপর যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়েছে গোপন গুম/কিলার বাহিনী। যার ফলাফলে নুরুকে এভাবে গুম ও খুনের শিকার হতে হলো। নুরুকে গুম-খুনের মাধ্যমে তারা হয়তো বার্তা দিতে চেয়েছে, যারাই গুম খুন নিয়ে মাতামাতি করবে কিংবা কোনো কার্যক্রম চালাবে তাদেরকেই নুরুর মত গুম খুনের শিকার হতে হবে।
পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, পুলিশ ১০ ঘন্টা পর তার লাশটি নদীর পাড় থেকে তুলে আনতে যায়। এই দশ ঘন্টা তার লাশ নদীর পাড়েই পড়ে ছিলো। দলবাজ পুলিশ কতটা নির্লিপ্ত আর ডেমকেয়ার হলে এমনটা করতে পারে।
এই লেখাটি যখন শেষ করবো, তখনই প্রথম আলোতে একটি শিরোনাম দেখলাম – “৪ জেলায় ১২ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ”
গুম খুনের রাজনীতি কখনো শুভ পরিণতি বয়ে আনেনা। ৭২-৭৫ এর গুম-খুন শুভ পরিণতি বয়ে আনেনি। আজও আনবে না। সুতরাং এসব বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করা জরুরি। নয়তো গুম-খুনের শিকার মজলুম পরিবারগুলোর জমানো ক্ষোভগুলো একত্রিত হয়ে যখন বিষ্ফোরিত হবে, তখন খুনিরা কেউ রক্ষা পাবে না।
Discussion about this post