কামরুল আহসান নোমানী
খালেদা জিয়া তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনে অপশক্তির সাথে আপোস করেছেন এরকম একটা উদাহরণ আমাকে দেখান তো। আমি জানি আপনি দেখাতে পারবেননা। পারবেননা কারণ অপশক্তির সাথে আপোষের দৃষ্টান্ত খালেদা জিয়ার নেই। একজন সাধারণ গৃহবধু থেকে আজকের খালেদা জিয়া হয়ে উঠার পথটা বড় সহজ ছিলোনা, পদে পদে কাঁটা বিছানো ছিলো। তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন বারবার। কিন্তু হাল ছাড়েননি। হাল ছাড়া শব্দটা খালেদা জিয়ার অভিধানে নেই।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামীলীগ যখন আন্দোলনের পিঠে ছুরি মেরে এরশাদের সাথে ছিয়াশির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলো, খালেদা জিয়া তখনো ছিলেন অনমনীয়। তিনি হাল ছাড়েননি। স্বৈরাচারের সাথে আপোষ করেননি। একাই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। মূলত: খালেদা জিয়ার আপোষহীন মনোভাবের কারণেই শেষপর্যন্ত স্বৈরাচার এরশাদ শাহীকে বিদায় নিতে হয়েছিলো।
মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিনের আমলে তারেক রহমানকে গ্রেফতারের পর টর্চার সেলে তাকে নির্যাতনের অডিও সিডি খালেদা জিয়াকে শুনিয়ে বলা হয়েছিলো, দেশ ছাড়েন, আপনার সন্তান বেঁচে যাবে। সেদিনও খালেদা জিয়া ছিলেন অনমনীয়। সন্তান স্নেহে কেঁদে ফেলেছিলেন কিন্তু অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি। বলেছিলেন, আমি কোথায় যাবো? বিদেশে আমার কোন বাড়ি নেই। এইটাই আমার দেশ। এই দেশ, এই দেশের মানুষ ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা।
সেইদিন খালেদা জিয়ার আপোষহীন মনোভাবের কারণেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে পেরেছিলেন। ভেস্তে যায় দুই উদ্দিনের ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’।
দুই উদ্দিনের আমলে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে তার নামের মামলাগুলো প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছেন। খালেদা জিয়ার মামলাগুলো আছে। সেই মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে তিয়াত্তর বছর বয়সী খালেদা জিয়াকে আদালতে পাঁচ ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে। এক কাপ চা খেয়ে আদালতে দুপুর পার করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
শেখ হাসিনা যখন তার বোনের ছেলে আর নাতি পুতি নিয়ে ভ্যানে করে রাজ্য দেখতে বের হন, খালেদা জিয়া তখন তাঁর নাতনীর কাঁধে ভর দিয়ে আদালতে আসেন। এই সরকারের আমলে তাঁকে এক কাপড়ে দীর্ঘ দিনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হয়েছে, সন্তান আরাফাতকে হারিয়েছেন, মাকে হারিয়েছেন, ভাইকে হারিয়েছেন, তারেক রহমান তো থেকেও নেই।
স্বজনহারা এই বৃদ্ধা তবুও ছিলেন হিমালয়ের মত অটল!
খালেদা জিয়াকে প্রতিনিয়ত সরকারের তরফ থেকে গালমন্দ শুনতে হয়, সরকার প্রধান সূযোগ পেলেই উনাকে নিয়ে অশ্লীল রসিকতা করেন, অথচ অন্যদিকে দেখেন… খালেদা জিয়া কী আশ্চর্য ধী স্থির! কখনো প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কোন নেতাকে নিয়ে উনার মুখ থেকে কোন কটু কথা শুনিনি।
শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, খালেদা জিয়া অশিক্ষিত। অন্যদিকে শেখ হাসিনা অনেক শিক্ষিত। ডজনে ডজনে ডিগ্রী উনার। কিন্তু মানুষের ভালোবাসাটা কেমন যেন! বারবার সেটা কেবল ওই স্বল্প শিক্ষিত গৃহবধু থেকে আপোষহীন নেত্রী হয়ে উঠা বেগম জিয়ার গলাতেই বরমাল্য হয়ে ঝুলে!
খালেদা জিয়া নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথ নন, খালেদা জিয়া বিলগেটস নন, খালেদা জিয়া এমনকি শচীন টেন্ডুলকারও নন। এরা সবাই প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী না হয়েও তাদের কর্মগুনে বিশ্বখ্যাত। খালেদা জিয়া কেবলই খালেদা জিয়া। সাধারণ একজন গৃহবধু থেকে আপোষহীন নেত্রী হয়ে উঠতে তাঁর ‘উচ্চশিক্ষা’ লাগেনি, স্বৈরাচার এরশাদের বিপক্ষে দীর্ঘ নয় বছর লড়ে যেতে তার গন্ডায় গন্ডায় ‘অনারারি ডিগ্রি’ কেনার দরকার পড়েনি, দেশের সবচয়ে জনপ্রিয় নেত্রী হয়ে উঠতে তাঁর ‘অভিনয় বিদ্যা’ জানার দরকার পড়েনি, নিজের মানবিক গুনাবলীর জানান দিতে তাঁর হাতব্যাগে করে ‘গ্লিসারিন’ নিয়ে ঘোরার দরকার পড়েনি…
উনার আচার আচরণ, উনার কথাবার্তা, উনার বিনয় অথবা মানুষের প্রতি উনার শ্রদ্ধাবোধ দেখলে একটা ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিত করেই বলা যায়- খালেদা জিয়া যতটুকু পড়েছেন, যতটুকু শিখেছেন সেটা সুশিক্ষাই ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আপনাকে উচ্চশিক্ষিত বানাতে পারে তবে সুশিক্ষিত হয়ে উঠাটা নির্ভর করে আপনার পরিবার এবং পারিপার্শ্বিকতার উপর। খালেদা জিয়া সেটা পেয়েছেন, উনার প্রতিদ্বন্ধী নেত্রী সেটা পাননাই। এই কারণে দুই ডজন অনারারি ডিগ্রি বাগিয়ে নেবার পরেও স্রেফ আড়াই ইঞ্চি জিভের কারণে কাউকে কাউকে বস্তির মর্জিনাদের চেয়ে আলাদা করা দুষ্কর হয়ে পড়ে।
এই দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই চারটা গ্রেফতারি পরওয়ানা এবং চরম বৈরি একটা পরিবেশেও বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফেরার সাহস দেখাতে পারেন। উনি খালেদা জিয়া বলেই পারেন। এবং আমি নিশ্চিত খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইটা চালিয়ে যাবেন। এই লড়াইয়ে জিতবেনও তিনি। ইনশাল্লাহ।
মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি আর কিছু নেই।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট
Discussion about this post