মীযানুল করীম
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে রেড ক্রিসেন্টের ত্রাণসামগ্রী বহনকারী ট্রাক উল্টে মর্মান্তিকভাবে ৯ জন প্রাণ হারালেন। বাংলাদেশে কোনো দুর্যোগে ত্রাণকার্যক্রমের সময় এমন ট্র্যাজেডি আর ঘটেনি। গত বৃহস্পতিবার রাতে টিভিতে এই খবরের সাথে আরেকটি খবরে জানা যায়, মিয়ানমারে বৌদ্ধ বিক্ষোভকারীরা ত্রাণবাহী যানে পেট্রলবোমা ছুড়ে মেরেছে। সীমান্তের দুই পাশে পরস্পরবিরোধী দু’টি চিত্র অসহায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে। সোজা কথায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের একপাশে পাশবিকতার তাণ্ডব, আরেক পাশে মানবাধিকার তৎপরতা।
রোহিঙ্গাদের বেলায় মিয়ানমার যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, তা সভ্যতা, মানবতা ও আধুনিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। দেশটির সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক আচরণের কারণে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে PARIAH বা অচ্ছুৎ রাষ্ট্র হিসেবে বর্জিত ও নিন্দিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে সেখানে গণতন্ত্রের দিকে প্রত্যাবর্তনের সূচনায় বিশ্বশক্তির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে মিয়ানমার কিছুটা ‘জাতে উঠলেও’ তার রোহিঙ্গা নির্যাতন কমেনি এতটুকুও। উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদী আচরণ এবং বিশেষ করে ভিক্ষু ও রাখাইনদের সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ সামরিক শাসনামলের মতো আজো অব্যাহত। অর্থাৎ সু চির নেতৃত্বে গণতন্ত্রের কথিত বিজয় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ভাগ্য বদলায়নি, বরং তারা আবারো জাতিগত নিধন ও পরিকল্পিত নির্মূল অভিযানের টার্গেট হয়েছে। একবিংশ শতকে কোনো সভ্য দেশে যা কল্পনাও করা যায় না, সেটাই আজ ঘটছে মিয়ানমারে। এটা সম্ভব হচ্ছে সরকারের নীলনকশায়, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় আর বাইরে থেকে ভারত-চীন-রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায়।
রোহিঙ্গাদের বলা হয় ‘বিশ্বের সর্বাধিক হতভাগ্য জনগোষ্ঠী।’ কারণ, একটা বড় জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও এবং মিয়ানমারে শত শত বছর ধরে বসবাসের পরও তারা নাগরিকত্ব পায়নি। তাই বাস্তবে তাদের কোনো দেশ নেই। এমনকি ন্যূনতম মানবাধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। মিয়ানমারে সরকার তথা সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সাথে সে দেশের গরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ওপর সম্ভাব্য সব উপায়ে অত্যাচার-অবিচার চালিয়ে আসছে। অথচ তাদের ধর্মের মূলবাণী, জীব হত্যা মহাপাপ। একটা পিঁপড়াকেও হত্যা করা গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার পরিপন্থী। অথচ তার অহিংসনীতির ‘পূজারী’রা অবর্ণনীয় সহিংসতার প্রমাণ দিচ্ছে রোহিঙ্গা তথা মুসলিম অধিবাসীদের ক্ষেত্রে। আরো ন্যক্কারজনক ব্যাপার হলো, বৌদ্ধ ধর্মগুরু বা ভিক্ষুরা এই বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক সহিংস তৎপরতার হোতা। অশিন বিরাথুর মতো গেরুয়া বসনধারী কোনো কোনো উগ্র ভিক্ষু রোহিঙ্গা নিধনের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছে। অন্য কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুরা এমন সহিংস ও বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়ার নজির কোথাও পাওয়া যায় না। গত শতাব্দী থেকেই বিশেষত এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি অঞ্চল নজিরবিহীন শরণার্থী সমস্যার শিকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, সিরিয়া, মিয়ানমার (রোহিঙ্গা), দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, রুয়ান্ডা প্রভৃতি। এর মধ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ১৯৭৮ থেকে বারবার শরণার্থী হতে বাধ্য হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, বসতি ধ্বংস, উচ্ছেদ প্রভৃতি কারণে দফায় দফায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ছুটে এসেছে বা আসছে।
জেনারেল অনুপ চাকমা
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এলে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অনুপ কুমার চাকমা। তিনি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রাখাইন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ওই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিভিন্ন শক্তি সক্রিয় রয়েছে। সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এখনকার রোহিঙ্গা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলেন, এবারের ঘটনার ভয়াবহতার কাছে অতীতের সব ঘটনা ঢাকা পড়ে গেছে। সমস্যার সমাধানে কফি আনান কমিশন ছিল একটি বড় ধরনের অগ্রগতি। কিন্তু যেদিন এই কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলো, সেদিনই সন্ত্রাসী হামলা হলো এবং সাথে সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শুরু করল অভিযান।’
অনুপ চাকমা বলেছেন, ‘আনান কমিশন আরাকানে (রাখাইন স্টেট) বসবাসকারী সংখ্যালঘু মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে বলেছে। এটি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের উপায় হতে পারে। সীমান্ত অঞ্চলে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মংডুর ৯০ শতাংশ অধিবাসী রোহিঙ্গা মুসলিম। রাজ্যটিতে বহু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করা না গেলে মিয়ানমার কতটা লাভবান হবে, সন্দেহ আছে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সবাইকে এক হতে বলা উচিত হয়নি। বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশ সে দেশের কোনো সশস্ত্র গ্রুপকেই সহায়তা দিচ্ছে না।’
তার মতে, মিয়ানমার থেকে এবার যে জনস্রোত এসেছে, তা সীমান্তে বাধা দিয়ে ফেরানো যেত না। সেনাবাহিনীর এই সাবেক জেনারেলের অভিমত, বাস্তবে মিয়ানমারের পক্ষে রাখাইনে যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না। কারণ রাজ্যটি দুর্গম পাহাড় ও অরণ্যে পরিপূর্ণ; রাস্তাঘাট নেই বলে যানবাহন চলতে পারে না। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত ভূমিকার কথাও বলেছেন। নিজ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছেন, ২০১২ সালে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ। তখন একজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তা সীমান্ত খুলে দেয়ার ওপর জোর দিলেন। তাকে প্রশ্ন করি, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেয়ার কী নিশ্চয়তা আছে? তখন সেই কর্মকর্তা লা-জবাব। আসলে মিয়ানমারে মার্কিন প্রভাব নেই। অপর দিকে, দেশটি চীনের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল।
‘রোহিঙ্গা’ অ্যালার্জি ও সমাধান সূত্র
বাংলাদেশের প্রবীণ সাংবাদিক-কলামিস্ট হাসান শাহরিয়ার তার একটি কলামের শুরুতেই বলছেন, ‘বিশ্বায়ন আর মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলশ্রুতিতে আগের বিশ্ব আর নেই। সব দেশই বদলে গেছে; বিভিন্ন সংস্কৃতির সমাহারে হয়ে উঠেছে বহুজাতিক। কোনো দেশই এখন আর বিশেষ এক বা একাধিক জাতিগোষ্ঠীর জন্য চিহ্নিত নয়।’ আধুনিক রাষ্ট্রে অভিবাসীদের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ‘কিন্তু দীর্ঘ দিন অবরুদ্ধ থাকার পরও বার্মা বা মিয়ানমার এখনো পেছন দিকে হাঁটছে। সে দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করে, বর্মির জন্য বার্মা। সে দেশের সরকারপন্থী ও উগ্রপন্থী লোকজনের বক্তব্য প্রসঙ্গে হাসান শাহরিয়ার লিখেছেন, তাদের দাবি, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি যেন আর ব্যবহৃত না হয়। এ নামে তাদের দেশে নাকি কোনো জাতিগোষ্ঠী নেই। ‘রোহিঙ্গারা বাঙালি ও সন্ত্রাসী।’ শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমরা বাঙালি নই। আমাদের দেশ বার্মা। সেখানে বাপদাদার ভিটা আছে; তাদের কবর আছে। আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই।’
রোহিঙ্গা ইস্যু মিয়ানমারের ঘরোয়া ব্যাপার বলে যেমন মুখ ফিরিয়ে থাকা যাবে না, তেমনি এটাও সত্য- এ সঙ্কট ওই দেশেরই সৃষ্টি করা। তাই এর প্রকৃত ও স্থায়ী সমাধানও তাদের ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা প্রভৃতি সহায়তা দিতে পারে আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতায়। কিন্তু এটা তো রোহিঙ্গা সঙ্কটের আসল সমাধান নয়। সমস্যাটা নিছক মানবিক বিপর্যয় নয়; এটা মূলত রাজনৈতিক দুর্যোগ। তাই এর মূল কারণ ও উৎস দূর করতে হবে রাজনৈতিকভাবেই। এ জন্য মিয়ানমারের সুমতির উদয় হতে হবে সর্বাগ্রে। তাদের আচরণ যে আধুনিক সুসভ্য যুগে অচল এবং স্বৈরাচারকবলিত কোনো রাষ্ট্রও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি এমন চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ করতে পারে না, তা নে পি দ সরকারকেÑ সু চি এবং তার সশস্ত্রবাহিনীকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে হবে। বিশ্বসংস্থায় চীন-রাশিয়া বা আর কেউ যাতে ভেটো দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুকে আরো জটিল, আরো মর্মান্তিক করতে না পারে, এ জন্য কার্যকর কূটনীতি জরুরি।
প্রেস ক্লাব থেকে হলিউড
রোহিঙ্গা সঙ্কট এমনই এক অভাবনীয় দুর্যোগ হিসেবে গণ্য হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। এই প্রভাব বহুমাত্রিক- শুধু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়। এ দেশে সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। এর দু-একটি দৃষ্টান্ত হলো- ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে প্রতিবাদী কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান হয়েছে। এতে নবীন-প্রবীণ কবি ও ছড়াকাররা অংশ নিয়েছেন দলমত নির্বিশেষে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন বন্ধ করার জন্য তারা বিশ্বের তাবৎ মানবতাবাদীদের প্রতি সরব হতে আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের কবিরা অত্যাচার-নির্যাতন তথা মানবতাবিরোধী সব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অতীতের মতো আগামীতেও সোচ্চার থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
তা ছাড়া ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, তাদের ওপর নিপীড়নের প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি, মিয়ানমার সরকারের চরম অমানবিক নীতি, সু চির লজ্জাকর ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে সাক্ষাৎকার ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে অনেক। সাহিত্যের পাতায় কবিতা ও ছড়া ছাপা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের অপরিসীম দুর্গতি ও বঞ্চনা তুলে ধরে। এমনকি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের জগতে উদীয়মান লেখক স্বকৃত নোমান রোহিঙ্গাদের ওপর ‘বেগানা’ (অনাত্মীয়) নামে উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। বাংলাবাজারের একটি সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান এটি প্রকাশ করেছে। বইটির পরিচিতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস, স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মর্মস্পর্শী আখ্যান।’
রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিণতি ঘটতে পারত না যদি বিশ্বসংস্থা এবং বিশ্বের ‘মুরব্বি’রা তাদের দায়িত্ব পালন করত। ইচ্ছাকৃত দ্বিচারিতা ও উদাসীনতা, সঙ্কীর্ণ স্বার্থপূজা, বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ প্রভৃতি কারণে তারা দায়িত্ব এড়িয়ে যায় এবং অত্যাচারী শাসকদের সুযোগ দেয় মানবতাকে যথেচ্ছ লাঞ্ছিত করার।
এ প্রেক্ষাপটে ব্যঙ্গ করে, বাংলাদেশের এক কবি লিখেছেন, ‘এখানে নোবেল আছে বছরান্তে;/ আছে এক জাতিসংঘ-জলশূন্য দমকল বাহিনী।/ ভেলুপিল্লাই প্রভাকরন জাফনার বাঘ হলে/যদি এই দুনিয়াটা ভস্মীভূত হয়ে যায় লঙ্কার সমান!/ কাশ্মীরে হলে সূর্যোদয়/যদি গোটা পৃথিবীতে লেগে যায় রোমের আগুন!/প্যালেস্টাইন হয়ে উঠলে পল্লবিত তরু/ফের যদি জ্বলেপুড়ে ছাই হয় মূসারপর্বত!/ আর যদি না-ই ঘটে রোহিঙ্গার নির্মম নিধন,/ কী করে ছাই ধন্য হবে অহিংসায় বুদ্ধের নাম?’
আরেক কবির ভাষায় ‘আরাকান থেকে আফগানিস্তান আদিগন্ত শুধু অন্তহীন রক্তধারা। শুধুই সূর্যগ্রাসের উল্লাস। …দজলা-ফোরাত থেকে গঙ্গা ও নাফ। কোথাও জলের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু রক্তস্রোতে শ্যাওলার মতো ভেসে যাচ্ছে মানবতার বিবস্ত্র দেহ। গঙ্গা জানে, নাফ জানে- কে তার বস্ত্র হরণ করেছে।’
‘কাকে তুমি করছ বাস্তুছাড়া- বলছ বহিরাগত?’ এই প্রশ্ন বুদ্ধের কথিত অনুসারীদের করেছেন এক কবি। তিনি মিয়ানমারের জন্য রোহিঙ্গাদের অবদানের কথা উল্লেখ করে সেখানকার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে বলছেন, ‘তোমরাও তো ছিলে দক্ষিণ চীনে- তাতারখড়্গতলে দলিত, মথিত আর ছিন্নভিন্ন;/ছড়িয়ে কি পড়নি তাই এখানে সেখানে?/অবিশ্বাস? সুধাও না দালাই লামাকে।/ কাকে তুমি বলছ ‘বহিরাগত,’/ হে বুদ্ধ ভাবো বিদ্যজ্ঞানে।’
এ দেশের অন্য এক কবি লিখেছেন কবিতায়- ‘মিয়ানমারে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ/ গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, আগুনে আগুন,/ক্ষুধার আগুনে পাকস্থলী জ্বলে, রোহিঙ্গাসন্তান।/…আজও আবার নাফ নদীর রক্তাক্ত জলে ভাসে লাশ/ পশুরা হত্যা করেছে নিরীহ মানুষেরে, এই লাশ মানুষেরই।’ কবির জিজ্ঞাসা, ‘ধর্ম বলে- জীব হত্যা মহাপাপ, তাহলে এ কেমন ধর্মের বাণী? কোথায় ধর্মের পুরোহিত?’
বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথে মা-বাবাকে মিয়ানমার সেনা হত্যা করেছে- এমন এক রোহিঙ্গা কিশোরী ছোট ভাইকে নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আজ আশ্রয় প্রার্থী। সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে সে বলছে, ‘এখানে তবুও আকাশ দেখতে পারি/যে আকাশটা মিয়ানমারে হেলে পড়েছে;/সেখানে আকাশটা, রক্তপিপাসুদের দখলে রক্তবর্ণ ও অগ্নিকুণ্ডলী নিয়ে কাঁপছে।/সেই সাথে অনিশ্চিত জীবনটা নিয়ে আমিও কাঁপছি।
রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ-নিপীড়ন, বসতি নির্মূল তথা এই মর্মান্তিক জাতিগত নিধনের তাণ্ডব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে ত্বরিত প্রভাব ফেলেছে, এর ছাপ লেগেছে সাহিত্য-সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক- এমনকি বিনোদন জগতেও। বাংলাদেশের ঢালিউডের শিল্পী-কুশলীরা একযোগে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করেছেন বর্মি বর্বরতার। তারা অং সান সু চির তীব্র সমালোচনা করে তাকে ধিক্কার দিয়েছেন। ভারতের বলিউড ও টালিউডের শিল্পীরা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জানাবেন বলে মনে হয় না। এর কারণ, মিয়ানমার সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে দিল্লির অনৈতিক অবস্থান।
তবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ চলচ্চিত্রাঙ্গন হলিউডের অ্যাঞ্জেলিনা জোলিসহ বিখ্যাত শিল্পীরা মিয়ানমারের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে মুখ খুলছেন। কারণ, মার্কিন গণতন্ত্রের স্বাধীনতা সেখানে বিদ্যমান রয়েছে। তা ছাড়া নিকট অতীতে কোনো কোনো অভিনেতা রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন। যেমন- হলিউডের অভিনেতা ম্যাট ডিলন ২০১৫ সালে রোহিঙ্গা জনপদ ঘুরে এসেছেন। তিনি জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা আশা করেন রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার বিষয়ে।
পুনশ্চ : বাংলাদেশে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল নেমেছিল। এখন আবার সেই শরণার্থীর স্রোত ছুটে এসেছে মিয়ানমারের আরাকান থেকে। আমরা দেখছি, অন্তত চার লাখ অসহায় রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এরা স্বজনহারা, সর্বস্বহারা উদ্বাস্তু। ভিনদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মতো আরো অসংখ্য রোহিঙ্গা সব হারিয়ে মিয়ানমারের ভেতরেই বিভিন্ন অঞ্চলে পথেঘাটে পড়ে আছে। এ ধরনের শরণার্থীরা Internally Displaced Persons বা IDP হিসেবে অভিহিত। এই রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের কথা আমরা ক’জন জানি? তাদের সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা মিলবে নিম্নের তথ্য থেকে।
এবার ২৫ আগস্ট শুরু হলো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্মি সেনাবাহিনীর নারকীয় অপারেশন। এর পর থেকে দেশটির পশ্চিম উপকূলীয় রাখাইন প্রদেশে চলছে অবিরাম জাতিগত নিধনযজ্ঞ। এমন এক চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মাঝে মিয়ানমার ঘুরে এসেছেন বাংলাদেশের একজন মেডিক্যাল ছাত্রী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে সাকিয়া হক সবে শেষ করেছেন এমবিবিএস। তার আট দিনের সফর-অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন একটি পত্রিকায়। তিনি মিয়ানমারে মান্দালে প্রদেশের প্রাচীন শহর বাগানেও গিয়েছেন। এটি রাখাইন রাজ্য থেকে বেশ দূরে। সাকিয়া বলেছেন, (বাগান শহরের পথের পাশে) অনেক মানুষ হাত পেতে বসে আছে। তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। ‘ওরা কারা’? ট্যাক্সিচালক বলল, ‘ওরা রোহিঙ্গা; আমাদের দেশের মানুষ মনে করে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের বোঝা আমরা বহন করে চলেছি। আমাদের দেশের মানুষ রোহিঙ্গাদের এ দেশের নাগরিকই মনে করে না। তাই মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দিতে চায় না।’
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post