এম আই খান
রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠিকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠি। যারা একটি রাষ্ট্রে শত শত বছর অবস্থান করার পরও সে রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হারিয়েছে শুধুমাত্র সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ জনগোষ্ঠির ধর্মান্ধ গোয়ার্তুমিতে। আরাকান রাজ্যের ইতিহাস ছাড়াও ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আরাকানের মুসলিম প্রধান এলাকাগুলো থেকে প্রায় ডজন খানেক মুসলিম রাজনীতিক এমপি নির্বাচিত হয়ে দেশটির পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বছরের পর বছর, এমনকি মন্ত্রী হিসেবেও বার্মার মন্ত্রনালয় পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু, সাম্প্রদায়িক এ মগ গোষ্ঠির সীমাহীন মিথ্যাচারের কারণে আজ ফিকে হয়ে এসেছে সে ইতিহাস। যাইহোক, ইতিহাস নিয়ে আমি এখানে কথা বলতে চাই না। সাম্প্রতিক কিছু ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
গত বছরের আদলে এ বছরেও জাতিগত নির্মূল অভিযানের অংশ হিসেবে মিয়নমার সরকারের সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর বর্বর আক্রমণে বাড়ি-ঘর, ভিটে-মাটির মায়া ছেড়ে দলে দলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি বেঁচে থাকার তাগিদে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জাতিসংঘ বলেছে, গত ২ সপ্তাহে ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিক পালিয়েছে এসেছে। মগের মুল্লুকে এসব রোহিঙ্গাদের ওপর যে অমানবিক নিপীড়ন চালানো তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ও টুইটারের কল্যাণে অনেকেই তা দেখে থাকবেন। এত বেশি নির্মম নির্যাতন এ সভ্যযূগে আর কোথাও ঘটেছে কিনা তাও বলা মুশকিল। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে জাতিসংঘের মায়ানমার বিষয়ক মানবাধিকার বিশেষ প্রতিনিধি ইয়াংহি লি বলেছেন, ‘সম্ভবত ইতোমধ্যে ১ হাজার বা তারও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছে।’এদের বেশির ভাগ সংখ্যালঘু মুসলমান- যা মায়ানমারের সরকারি হিসেবের তুলনায় দ্বিগুণ। বর্বর বর্মী সেনাবাহিনী শুধু গণহত্যা চালিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, আগুন লাগিয়ে ভষ্মিভুত করেছে গ্রামের পর গ্রাম। নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে রোহিঙ্গা অসহায় নারীদের। যার রোমহর্ষক বর্ণনার ভিডিও অনেকেই দেখে থাকবেন। নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় প্রবল স্রোতের কবলে পড়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই শিশু।
এহেন অবস্থায় জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বেশ কিছু রাষ্ট্র প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের থাকার জায়গা দেয়ার অনুরোধ করেছেন। এদের মধ্যে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া অন্যতম। এমনকি তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এ আহ্বানও জানিয়েছেন যে, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিন, খরচ আমরা দেব’। কথাও রেখেছে তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্যরাও। তারা সাধ্যমত ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ৭০ লাখ ডলার সহায়তা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৫৭ কোটি ১২ লাখ টাকা।
শরণার্থী সমস্যা বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যা। বিশেষ করে ইরাক, লেবানন ও সিরিয়ার যুদ্ধের পর এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার অধিকাংশ ভুক্তভোগী মুসলমান। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের দেশের জনগণকেও ভারত শরণার্থী হিসেবে স্থান দিয়েছিল। শরণার্থী হিসেবে সাধারণত পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সুবিধাজনক প্রতিবেশী দেশই স্থান দিয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, গত কয়েক বছরে শুধুমাত্র তুরস্ক প্রায় ৩০ লক্ষ শরণার্থীকে স্থান দিয়েছে। যার প্রায় ২৭ লক্ষই সিরিয়ার নাগরিক। এছাড়াও তুরস্ক হয়ে লক্ষাধিক শরণার্থী ইউরোপিয়ান অন্যান্য দেশেও প্রবেশ করেছে। আশ্রয়হীন এসব ভাগ্যাহত মানুষের জন্য ইউরোপিয়ান অনেক দেশ উদার মানসিকতারও পরিচয় দিয়েছে।
গত আট মাসে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। এরদোগান সরাসরি বলেছেন, মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এরদোগানের মতো এতোটা জোরালো অভিযোগ অন্য কোনো রাষ্ট্র প্রধান করেননি। শুধু বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তুরস্ক। মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা সচক্ষে দেখতে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোগান গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসেন। ঘুরে দেখেন এদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাস্তব অবস্থা। আর যাই হোক, রোহিঙ্গাদের জন্য তুরস্কের মতো আর অন্য কোনো দেশ সাহায্যে নিয়ে এগিয়ে আসেনি এটাই এখন পর্যন্ত সর্বাধিক সত্য কথা।
কিন্তু, মায়ানমারের সংখ্যালঘূ এই মুসলিম জনগোষ্ঠি রক্ষায় বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারপন্থী অনেকেই তুরস্কের এই অবস্থানকে ভালোভাবে নেয়নি। এমিনি এরদোগানের তাৎপর্যপূর্ণ এই সফরকে কটাক্ষ করে তারা অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন যে, পারলে লাখ খানেক রোহিঙ্গা জাহাজে করে তুরস্কে নিয়ে যান! বর্তমান সরকারের একজন পরিচিত এমপি মোহাম্মদ এ আরাফাত তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন-“ রোহিঙ্গাদের জন্য তুরস্কের ফার্স্টলেডির মমতা আছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। কথার পাশাপাশি কাজেও তিনি তা প্রমাণ করবেন, এই আমাদের প্রত্যাশা। যে গুডউইল নিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, আশা করি তার প্রমাণ হিসাবে ফিরে যাবার সময়ে অন্তত এক লক্ষ রোহিঙ্গাকে তিনি সাথে করে তুরস্কে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন।” এ পোস্টের অনুসরণে আওয়ামীপন্থী অনেকেই এই দাবী তুলতে শুরু করেছেন। কিন্তু এ দাবী কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলছে গুঞ্জন।
প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের এই দুর্ভোগের জন্য কি তুরস্ক দায়ী? নাকি তারা এ সঙ্কট তৈরী করেছে? শুধু মানবাধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার ভূমিকা পালন করা কি তাদের অপরাধ হয়েছে? এটা ঠিক যে, ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে এত বিপুল জনগোষ্ঠিকে স্থান দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া অন্য একটি দেশের জনগণকে কেনইবা বাংলাদেশ জায়গা দিবে? সেজন্য সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপ সৃষ্টির জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ততদিনে যে খাদ্য ও অন্যান্য সুবিধা দরকার তা জাতিসংঘসহ যেসব রাষ্ট্র মানবিক সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের থেকে সেই সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। মানবিক সহায়তার জন্য এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে তা অনন্য। তাই বলে সহায়তাকারী উদার অন্যান্য দেশগুলোকে এভাবে বলা যায় না যে, জাহাজ ভর্তি করে এসব আদম সন্তানকে আপনাদের দেশে নিয়ে যান। অবশ্য মালয়েশিয়া রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমানে মালয়েশিয়াতেও অবস্থান করছে ভাগ্যাহত ১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান।
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
Discussion about this post