মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস নির্যাতনের প্রতিবাদ হয়েছে বিশ্বের কমপক্ষে দুটি মহাদেশে। এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন স্থানে মুসলিমরা সোমবার বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে নৃশংস নির্যাতন চালাচ্ছে তার প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমে আসেন।
বিক্ষোভ হয়েছে চেচনিয়া, ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের বাইরে, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় সহ বিভিন্ন স্থানে। এ ছাড়া সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, জাতিসংঘ, মাল্টা ভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহ বিভিন্ন সংগঠন।
বিক্ষোভ সমাবেশে যেসব ব্যানার বা পোস্টার ব্যবহার করা হয়েছে তাতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। তার মুখে রক্ত মেখে দিয়ে বিকৃত করা হয়েছে। এসব বিক্ষোভে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ও মিয়ানমারের কার্যত মূল নেত্রী অং সান সুচির ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যিনি ক্ষমতায় আসার আগে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সবার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধেয়। কিন্তু তার দেশে এখন যা ঘটছে তাতে তিনি নিশ্চুপ।
চেচনিয়ায় কয়েক হাজার মানুষ রাজপথে বিক্ষোভ করেছে সোমবার। এ বিক্ষোভে বরাদ্দ দিয়েছে সেদেশের সরকার। চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সময় কাদিরভ রাশিয়া সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। এক্ষেত্রে তিনি ক্রেমলিনকে বড় ধরনের হুমকি দেন। মিয়ানমারের হত্যাকাণ্ডকে তিনি তুলনা করেন হলোকাস্টের সঙ্গে।
কাদিরভ র্যালির আগে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, যারা এইসব অপরাধ সংঘটিত করছে সেইসব শয়তানদের যদি সমর্থন দেয় রাশিয়া তাহলে আমি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবো।
ওদিকে বিক্ষোভ হয়েছে ক্যানবেরায়। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের বাইরে বিক্ষোভ মিছিল করেন বিপুল সংখ্যক মানুষ।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় বিক্ষোভকারীরা আগুনে পুড়িয়ে দেয় অং সান সুচির ছবি। সেখানে মিয়ানমার দূতাবাসে ছুড়ে মারে গ্যাসোলিন বোমা। ইন্দোনেশিয়ার বিক্ষোভের আয়োজক ফরিদা। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা করা হচ্ছে। আর বাকি বিশ্ব রয়েছে নীরব।
ওদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। তারা এসব গণহত্যার তদন্ত দাবি করেছেন। সোমবার যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন বিক্ষোভ হচ্ছে তখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন তার অগ্রজ অং সান সুচিকে। সুচির কাছ থেকে তিনি এই সহিংসতার নিন্দা দাবি করেছেন।
কেউ কেউ দাবি করছেন, নোবেল কমিটি কি প্রকাশ্যে অং সান সুচির সমালোচনা করবে অথবা তার নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেবে! ১৯৯১ সালে সুচিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিউর ইয়াংহি লি আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি সুচিকে পরামর্শ দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যেন সুচি পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেন এমনটা চান ইয়াংহি লি। তিনি বিবিসিকে সোমবার বলেন, কোনো একটি সরকারের কাছ থেকে প্রত্যেকের নিরাপত্তার জন্য আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি।
ওদিকে মাল্টা ভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ক একটি গ্রুপ ভূমধ্যসাগরে তিন বছর ধরে শরর্থীদের উদ্ধার কাজে লিপ্ত। তারা সোমবার তাদের ওই কাজ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তারা বলেছে, বঙ্গোপসাগরে বিপদের মুখে পড়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে তাদের উদ্ধারকারী জাহাজ ফিনিক্স পাঠাবে।
উল্লেখ্য, ২৫ শে আগস্ট মিয়ানমারের পুলিশ ও সেনা পোস্টে উগ্রপন্থি রোহিঙ্গারা হামলা চালায়। এতে উভয় পক্ষে মোট ৮৯ জন নিহত হয়। এর মধ্যে সেনা বা পুলিশ সদস্য ১২ জন। বাকিদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। এর প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী ও তাদেরকে সমর্থনকারী বিভিন্ন গ্রুপ নৃশংস নির্যাতন শুরু করেছে রাখাইনে। এমন কোনো অপরাধ নেই যা সেখানে ঘটানো হচ্ছে না।
মানবাধিকার গ্রুপগুলো বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের অভিযানকে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের হাতে ধর্ষিত হচ্ছে অসংখ্য নারী। শুধু তা-ই নয়। ধর্ষণ শেষে উলঙ্গ করে হত্যা করা হচ্ছে। লাশ পড়ে থাকছে এখানে ওখানে। গুলি করে হত্যা করছে যেকোনো বয়সী মানুষকে। পুড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এর ফলে নীরব থাকতে পারেন নি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সবচেয়ে কনিষ্ঠ মালালা ইউসুফজাই। তিনি সোমবার টুইটে বলেছেন, কয়েক বছর ধরে এই ভয়াবহ ও লজ্জাজনক ঘটনার নিন্দা বার বার জানিয়ে আসছি আমি। এখনও আমার অগ্রজ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচি একই রকম নিন্দা জানাবেন এমনটা আশা করে অপেক্ষায় আছি।
গত বছর মালালা ইউসুফজাই, ডেসমন্ড টিটু ও আরো ১১ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। তাতে এই গণহত্যার বিষয়ে সতর্ক করা হয়। কোনো কোনো সমালোচক অং সান সুচিকে দায়ী করে তার নোবেল পুরস্কার বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তিনি জীবনের বড় একটি অংশ রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে গৃহবন্দি ছিলেন। এর ব্যাপ্তি ১৫ বছর। ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হওয়ার পর ওই নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে সেনাবাহিনী। তারপর তিনি অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে মুক্তি পেয়েছেন। ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে তাকে বানানো হয়েছে স্টেট কাউন্সেলর। এখনও তিনি আইনের অধীনে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। কার্যত মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষার মতো মন্ত্রণালয় চালায় সেনাবাহিনী। ফলে কার্যত বলা যায়, অং সান সুচির ক্ষমতা খুবই সীমিত। তিনি যদি রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে মুখ খোলেন, নিন্দা জানান, তাহলে তার পরিণতি আগের মতোই হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু সত্যিকার একজন মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ মানুষ এমন নৃশংসতায় সেই ভয়ে নিজেকে গুটিশুঁটি মেরে রাখতে পারেন না।
সূত্র: মানবজমিন
Discussion about this post