ডক্টর তুহিন মালিক
এক.
আবহমানকাল ধরে ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি করা এ দেশের ধর্মীয় উৎসবের একটি চিরায়ত অংশ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় ওয়াজিব এই ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট সব রীতিনীতি-আচার-রেওয়াজ-প্রথা নিঃসন্দেহে বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু হঠাৎই আচমকা নানা অজুহাতে নানাপ্রকার বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নানা গুজব, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বুননের গাঁথুনিতে সরকার জনগণের প্রতিপক্ষের জায়গায় চলে যাচ্ছে। মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের এই সূক্ষ্ম কিন্তু মারাত্মক নাজুক জায়গায় সরকার কেন এভাবে বারবার আঘাত করতে চাচ্ছে তা বোধগম্য নয়! নিত্যনতুন পদ্ধতিতে কোরবানি করার যে বিধিবিধান জুড়ে দেয়া হচ্ছে, সেটা আবার একেবারেই হাস্যকর। এটা আসলে কোনোভাবে বাস্তবায়নযোগ্যও নয়। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা পবিত্র ঈদের দিন বিশৃঙ্খলা ও মারাত্মক জনদুর্ভোগে পড়ে সরকারকে দোষারোপ করবে নিঃসন্দেহে।
দুই.
এমনিতেই গত কয়েক বছরে ভারত থেকে গরু আসছে না। ভারত বিরোধীরা মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, গোমাতা হত্যা মহাপাপ বলে বিজেপি সরকার বাংলাদেশে গরু পাঠাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও প্রতি বছরের মতো এবারো ভারত গরুর গোশত রফতানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এ দেশে গোহত্যাকে বিভিন্ন বাহানায় নিয়ন্ত্রণ করে কাউকে খুশি করা হচ্ছে কিনা বলেও আলোচনা হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত হবে এ বিষয়ে জনগণের সামনে নিজেদের স্বচ্ছ রাখা। মানুষের সন্দেহগুলো কাকতলীয়ভাবে মিলে গেলে সরকারই বেশি বিপদে পড়বে বৈকি।
তিন.
কোরবানীর পশু কোরবানির জন্য যে স্পট নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, সেই স্পটগুলোতে কমপক্ষে এক থেকে দেড় হাজার পশু কোরবানি দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সহস্রাধিক মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সিরিয়াল পাওয়ার জন্য ঈদের দিন ধৈর্য ধরে কিভাবে থাকবে? এই স্পটগুলোতে একসাথে এত কসাই, পানি, রক্ত-বর্জ্য নিষ্কাশন, গোশত আনা-নেয়ার পর্যাপ্ত যানবাহন কোথা থেকে আসবে? সনাতন পদ্ধতিতে যেভাবে জবাই ও চামড়া ছাড়ানো হয়, তাতে একটি গরুর জন্য কমপক্ষে দেড় থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। এমনিতেই জীবন্ত পশুর হাটে আবর্জনার স্তূপে টেকা দায়, তার ওপর হাজারো পশু একসাথে জবাই হলে রক্ত-ভুঁড়ি-কাদা-পানির বন্যা বয়ে যাবে। হাজারো পশু কোরবানির জন্য গড়ে প্রতি স্পটে অন্তত পাঁচ থেকে সাত হাজার লোক আসবে। সাথে ফকির-মিসকিনসহ আরো দ্বিগুণ লোক আসবে গোশত নেয়ার জন্য। জনতাকে সুশৃঙ্খল রাখতে ব্যাপক নিরাপত্তাবাহিনীর সতর্কাবস্থার মাঝে গোশতপ্রত্যাশীদের ঠেলাঠেলিতে আল্লাহ না করুক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে এর দায় কে নেবে? চামড়াসন্ত্রাসীরা এ সুযোগে ক্ষমতার দাপটে কখন কার ওপর গুলি চালিয়ে বসবে বলা মুশকিল!
চার.
ছোটবেলায় আমরা বছরের কোরবানির এই দিনগুলোর জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতাম। কবে হাট বসবে, কোন হাটে কী রকমের গরু আসছে? লালী-ভুট্টি-মীরকাদিমের গরুর দিকে সার্বক্ষণিক নজর থাকত। হাট থেকে লাঠি হাতে রাস্তা দিয়ে গরু হাঁটিয়ে নিয়ে আসার মজাই আলাদা। আমাদের পুরান ঢাকায় রাস্তার ওপর সারিবদ্ধভাবে রাখা গরুর বর্ণিল মালায় সাজিয়ে আদর-যতœ-খাওয়ানো-আহ্লাদের পুরো দায়িত্ব আমাদের যুদ্ধ করেই পেতে হতো। ঈদের নামাজ পড়েই কোরবানির পশু জবাইয়ের আত্মত্যাগের অপূর্ব মহিমায় গোটা পরিবারকে সাথে নিয়ে উদযাপন করার চিরাচরিত এক অনন্য রেওয়াজ এটা। হইচই ছোটাছুটি আর গৃহিণীদের ব্যস্ততার মাঝে নানা পদের গোশত রান্নার রসনায় ভরপুর গোটা মহল্লা। এগুলো কি আমাদের শত শত বছরের সুমহান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়?
পাঁচ.
ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হয়ে গেলে গরুর গোশতের দামও বেশ বেড়ে গেছে। মন্ত্রীরা আশ্বাস দিয়ে বলছেন, দেশে এত বেশি গরু আছে যে, আমাদের এখন থেকে বিদেশে গরু রফতানি করা লাগবে। তবে বাস্তবতা একেবারেই উল্টো। কোরবানির পশুস্বল্পতার কারণে মানুষ আশঙ্কা করছে এবার হয়তো চড়া মূল্যেও পশু পাওয়া যাবে না। মিয়ানমার থেকে কিছু গরু আসছে বটে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। আসলে গোমাতা হত্যা নয়, ভারত চাইছে বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের বিকাশ রুখতে। তারা নিজেরা গোমাতা হত্যা করে গোশত রফতানিতে বিশ্বের এক নম্বরে রয়েছে, কিন্তু অন্যদের হাতে গোমাতা হত্যা হোক তারা সেটা কেন চাচ্ছে না? অথচ বাংলাদেশের কোরবানির পশুর বাজারে ভারতের ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল গরু-বাণিজ্য রয়েছে।
ছয়.
এ বছর কোরবানির পশু আমদানি না হওয়া থেকে শুরু করে হাট সঙ্কোচন ও পশু জবাইয়ের নিত্যনতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার প্রকারান্তরে পদে পদে কোরবানিতে বাধা সৃষ্টি করছে বলে মানুষের মনে যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে, তা সরকারকেই স্পষ্ট করতে হবে। নতুবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভুল বুঝবে। কোরবানির মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হবে। মানুষ এমনিতেই চরমভাবে কোণঠাসা হয়ে আছে। তার ওপর এ ধরনের নিত্যনতুন বিধিনিষেধ মানুষকে আরো বেশি সংক্ষুব্ধ করে তুলবে।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
e-mail: [email protected]
Discussion about this post