বছর দেড়েক আগে ছিটমহল বিনিময় হয়ে যাওয়ার পরে কোচবিহার থেকে ফিরছিলাম এক সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে। কোচবিহার থেকে শিলিগুড়ি আসতে রাস্তায় তিস্তা নদী পেরতে হয়। তিস্তা সেতু পেরনোর সময়ে ওই সিনিয়র সাংবাদিক বলেছিলেন, “ছিটমহলের সমস্যাটা মিটল, কিন্তু এই নদীটা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যে কবে বোঝাপড়া হবে, কে জানে!”
তিস্তার জলবন্টন নিয়ে ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে সেই বোঝাপড়া এখনও হয় নি। যে বোঝাপড়ার পথে প্রধান আপত্তি তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী।
কদিন আগেও কলকাতার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এ বি পি আনন্দকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মিজ. ব্যানার্জী জানিয়েছেন তাঁর আপত্তির মূল কারণটা কী।
“তিস্তা নিয়ে আমার রাজ্যের স্বার্থে যা করার, আমি তাই করব। ওরা আমাদের না জানিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো সব করে, একবার জানাবার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করে না। হয়তো সব কিছু সেরেও নিয়েছে। সব কিছু সেরে নিয়ে যদি আমাকে বলো স্ট্যাম্প মারার জন্য, আমি বলব সরি,” সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন মিজ. ব্যানার্জী।
তিনি আরও বলেছিলেন যে বাংলাদেশকে তিনি খুবই ভালবাসেন, যতটা সম্ভব সাহায্য বাংলাদেশকে তিনি করবেন রাজ্যকে বাঁচিয়ে।
“আমি তো শুনছি ২৫শে মে নাকি ঢাকায় তিস্তা নিয়ে চুক্তি সই হবে,” জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
মিজ. ব্যানার্জী বলছিলেন যে তাঁর রাজ্যের কৃষকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে জলবন্টনে সম্মতি দিতে পারবেন না। কিন্তু শুধুই কি তাই? না কি ঘরোয়া রাজনীতি রয়েছে এর পেছনে? অথবা অন্য কোনও কারণ?
এই প্রশ্নের উত্তরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একাধিক বিশ্লেষক বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ ব্যাখ্যা করছিলেন যে তিনি মমতা ব্যানার্জীর তিস্তা নিয়ে আপত্তিটা কীভাবে দেখেন।
“মমতা ব্যানার্জীর আপত্তিটা হচ্ছে তিস্তা চুক্তি হলে পশ্চিমবঙ্গ জলের প্রাপ্য ভাগটা পাবে কী না। তিস্তা অববাহিকার ওপরের দিক থেকে সেই পরিমাণ জল নিশ্চিত করা যাবে কী না। বাংলাদেশকে যে পরিমাণ জল দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা তখনই সম্ভব যদি পাহাড়ী এলাকায়, সিকিমে, জল বেশি থাকে। সেটা কিন্তু নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের যেটা করা উচিত, তা হল পশ্চিমবঙ্গকে এটা বোঝানো যে তিস্তা চুক্তি হলে এ রাজ্যের খুব একটা স্বার্থহানি ঘটবে না। স্বার্থহানি ঘটলে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে মমতা ব্যানার্জী অসুবিধায় পড়বেন, এটা স্বাভাবিক,” বলছিলেন অধ্যাপক নন্দ।
বিশ্লেষকদের কেউ আবার বলছেন যে তিস্তার জল কী হিসাবে দুদেশের মধ্যে ভাগ হবে, তার জন্য যা পরিসংখ্যান দরকার, অভাব আছে সেখানেই। যদিও কিছু তথ্যানুসন্ধান করা হয়েছে ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে।
কলকাতার মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক ড. শ্রীরাধা দত্ত বলছিলেন, “যে তিস্তা চুক্তি হতে চলেছিল, তখন জলপ্রবাহের সঠিক পরিমাণ আমাদের তখন জানা ছিল না। সবসময়েই নদীর জলপ্রবাহের ক্ষেত্রে ৩০ বছরের একটা গড় হিসাব করা হয়। যে হিসাব এখন আছে, সেটা অনেক পুরনো। সেই সময়কার হিসাব নিয়ে এখন এগতে যাওয়া সমীচীন নয়। জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে, পরিবেশগত বিষয় রয়েছে, জলপ্রবাহে বদল ঘটেছে। তাই পুরনো নথি বা হিসাবের ওপরে ভিত্তি করে চুক্তি সই করা বোধহয় ঠিক হত না।”
তিনি আরও বলছিলেন যে কেন্দ্রীয় সরকার আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করেছে। কিন্তু তা এখনও জনসমক্ষে আনা হয় নি।
ইন্সটিটিউট অফ ফরেন পলিসি স্টাডিজের ভিজিটিং প্রফেসর ও কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জয়ন্ত রায়ের কথায় যথেষ্ট তথ্য আর পরিসংখ্যান না থাকলে চুক্তি করা হলেও সেটা কোনও দেশের পক্ষেই ফলপ্রসূ হবে না।
তার কথায়, “গঙ্গার জলবন্টন চুক্তি হওয়ার সময়ে আমাদের হাতে প্রচুর তথ্য পরিসংখ্যান ছিল। কিন্তু তিস্তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। খুবই কম তথ্য রয়েছে তিস্তার জলপ্রবাহ নিয়ে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে তিস্তার জলপ্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ। এই অবস্থায় জল বণ্টন হলেও কারও যে লাভ হবে, তা মনে হয় না। শতকরা ৫০ ভাগ জলও যদি আমরা দিয়ে দিই, তাতে যে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে, তা মনে হয় না। যেটা করা উচিত, তা হল দুই দেশের প্রতিনিধি – নদী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পর্যালোচনা করা। তাতেই সমস্যা মিটতে পারে।”
অধ্যাপক রায়ের পরামর্শ, উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু মজে যাওয়া নদী বা খাল যদি সংস্কার করা যায়, নতুন করে কিছু খাল খনন করা যায়, তাহলে তিস্তায় জলের প্রবাহ অনেক বাড়বে। জলের অভাব হবে না আর।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী বলছিলেন তিস্তা সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারের উচিত হবে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সিকিমকেও এই আলোচনায় যুক্ত করা উচিত।
“তিস্তা নদী সিকিম পাহাড় থেকে নেমে এসে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে যায়। এটাই হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল যে তিস্তার জল বণ্টনে পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমকে যুক্ত করা। যদি আগাম আলোচনা হয়, তাহলে সমস্যা মিটতে দেরী হওয়ার কথা নয়। এটাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন। একটা কথা তো ঠিক, এ রাজ্যে যে সরকারই থাকুক, এখানকার কৃষকদের স্বার্থ তো তারা দেখবেই,” বলছিলেন সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী।
কিন্তু শুধুই কি উত্তরবঙ্গের বিপুল সংখ্যক কৃষকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই মমতা ব্যানার্জীর এই তিস্তা জলবন্টন নিয়ে বিরোধিতা, যার জেরে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সম্পর্কে একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে?
কথা বলেছিলাম বিবিসি-র প্রাক্তন সহকর্মী ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে।
মি. ভৌমিক বলছিলেন, “মমতা ব্যানার্জী তিস্তা সহ বেশ কিছু ইস্যুতে যে ভূমিকা রাখছেন, তাতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সার্বিক উন্নতি স্বত্বেও দুই বাংলার বোঝাপড়ায় একটা ক্ষত থেকে যাচ্ছে। মিজ. ব্যানার্জীর বিরোধিতাটা রাজনৈতিক কারণে। এটা কি দিল্লিকে চাপে রাখার জন্য না কি বাংলাদেশে তার কোনও সমীকরণ আছে যে কারণে উনি চান না শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ লাভবান হোক – এগুলো উনিই জানেন, আমি জানি না। কিন্তু এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না কারও যে মমতা ব্যানার্জীর এই ভূমিকাটা দুই বাংলার সম্পর্কের জন্য ভাল হচ্ছে না।”
কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে কি ভারত সরকারের যে বিদেশনীতি – বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, তার সঙ্গে কোথাও আপোষ করতে হচ্ছে – যেখানে ভারত-বন্ধু বলে পরিচিত শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তার জলবন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না বলে সেদেশে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন?
অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরীর মতে, “পশ্চিমবঙ্গের আর ভারতের রাজনীতির যে পারস্পরিক টানাপড়েন বা বিরোধ, সেটাও তিস্তার জলবন্টনের ওপরে বা সার্বিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা। অন্যদিকে এটাও ঘটনা যে, ইদানীং কালে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন ভারতের বহু দাবি বাংলাদেশ মিটিয়েছে, কিন্তু বিনিময়ে তারা যে তখনই কিছু চেয়েছে, তাও নয়। আরও যেটা নজর করার দরকার, বাংলাদেশে ২০১৮-র শেষে নির্বাচন হওয়ার কথা। স্বাভাবিকভাবে সেই নির্বাচনের আগে শাসক আওয়ামী লীগ চাইবে যে ভারতের দিক থেকে তারা একটা বিশেষ সহযোগিতা তারা পায়। এই স্পর্শকাতর বিষয়টারও ওপরেও ভারত সরকারের নজর দেওয়া উচিত।”
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক ড. শ্রীরাধা দত্ত বলছিলেন, “দিল্লি বা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন, সবার সঙ্গেই আওয়ামী লীগ খুব ভাল সম্পর্ক রাখতে পারে কারণ ওদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা আমাদের সঙ্গে মিলে যায়। আমি নিশ্চিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও সেটা জানেন এবং কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার আগে নিশ্চয়ই তিনি এটা মাথায় রাখেন। সমস্যাটা হচ্ছে রাজ্য আর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে যে মনোমালিন্য চলছে, তার জন্যই মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টাকে অন্য চোখে দেখছেন।”
অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ ব্যাখ্যা করছিলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা পশ্চিমবঙ্গের কাছে খুব জরুরী।
“এটা ঠিকই যে তিস্তার জলবন্টন চুক্তি হলে শেখ হাসিনার সরকারের রাজনৈতিকভাবে সুবিধা হবে। কিন্তু যদি শেখ হাসিনার সরকার না থাকে, যদি অন্য কেউ আসে, বিশেষত যাদের পেছনে জামাতের মতো একটা শক্তি থাকবে, তাতে মারাত্মক অবস্থা হবে পশ্চিমবঙ্গের। সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী যদি ওখানে আক্রান্ত হয়, তারা এরাজ্যে এসে আশ্রয় নেবে। তাই মমতা ব্যানার্জীর রাজনৈতিকভাবে ঠিক হবে না বিষয়টার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানো। তবে মমতা ব্যানার্জীর কিছু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে, সেটাও আমাদের বুঝতে হবে,” বলছিলেন অধ্যাপক নন্দ।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করছিলেন, “এরাজ্যে যে ২৭% মুসলমান ভোট, তার একটা বিরাট অংশ কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্ক। আবার এটাও ঠিক যে এই ভোট ব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে পছন্দ করে না। মমতা ব্যানার্জীকে তাই খুব ব্যাল্যান্স করে এমনভাবে চলতে হয় যাতে ওই মুসলমান ভোট ব্যাঙ্ক কোনোভাবেই চটে না যায়।
বিবিসি-র প্রাক্তন সহকর্মী সুবীর ভৌমিকের কথায়, এই পরিস্থিতিতে যদি মমতা ব্যানার্জী তিস্তা জলবন্টন চুক্তিতে দ্রুত সায় দেন, তাহলে দুই বাংলার কাছেই তিনি প্রশংসিত হবেন – সেই সুযোগ তার আছে।
“বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি করে ভারতের রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদী কতটা লাভবান হবেন জানি না। কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর কিন্তু সেই ক্রেডিটটা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আজ যদি এই তিস্তা চুক্তি না হয় এবং বাংলাদেশে শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে টানাটানি হয় এবং কোনও ইসলামিক শক্তি যদি সেদেশে ক্ষমতায় আসে, তাহলে কি মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-আর এস এসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে যেভাবে আটকানোর চেষ্টা করছেন, তাতে তিনি সফল হবেন?” প্রশ্ন সুবীর ভৌমিকের।
মমতা ব্যানার্জীর আপত্তি সম্প্রতি আবারও প্রকাশ্যে আসায় ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে তারা সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। তাই তিস্তা চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই এগোনো হবে। কিছু সূত্র বলছে, সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
এখন দেখার মমতা ব্যানার্জী যে তথ্য দিয়েছিলেন টেলিভিশন সাক্ষাতকারে, সেই অনুযায়ী ২৫শে মে ঢাকায় তিস্তার জলবন্টন চুক্তি হয়, কী না!
সূত্র: বিবিসি বাংলা
Discussion about this post