অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আফগানিস্তানের পশ্চিমা সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে তালেবানের জয়ে হতাশ হয়ে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যতন চালাচ্ছে ভারতীয় হিন্দুবাদী সরকার। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো সে দেশের মুসলিমদেরকে তালেবানের হয়ে সাফাই গাওয়া বা তাদের মুখপাত্র হিসেবে দেখানোর অনুষ্ঠান প্রচার করছে।
এছাড়া ভারতের হিন্দুবাদীরা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ইসলামবিদ্বেষ সৃষ্ট করার জন্য নতুন আরেকটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে তালেবানকে। হ্যাশট্যাগ ‘পাকিস্তানে চলে যাও’ এর মতো হ্যাশট্যাগ ‘আফগানিস্তানে চলে যাও’ কথাটি এখন ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা।
এক টিভি শোতে বিজেপি সরকারের একজন সরকারী কর্মকর্তা বলেছেন যে, আফগানিস্তানে যা ঘটেছে, তা থেকে ভারতের শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং ইসলামী মৌলবাদকে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
কবি ও সংস্কারক হুসেন হায়দরি আল জাজিরাকে বলেন, ‘তালেবান বা তালেবানী শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবে উভয় পক্ষের জনগণের শব্দভান্ডারে গাঁথা হচ্ছে যারা বিজেপি পন্থী বা বিরোধী হতে পারে। যেভাবে পাকিস্তানি বা জিহাদি বা সন্ত্রাসবাদী তকমা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপবাদ হিসেবে গেঁথে দেয়া হয়েছিল, সেভাবেই এটি করা হচ্ছে।’
তালেবানরা কাবুল দখল করার কিছুদিন পরেই বিজেপি’র রাজনীতিবিদ রাম মাধব ১৯২১ সালের ব্রিটিশ ও অভিজাত হিন্দুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মোপলা বা মালাবার বিদ্রোহকে ‘তালেবানী মানসিকতার’ প্রথম প্রকাশ হিসেবে উল্লেখ করেন, যা কেরালার রাজ্য সরকার স্তিমিত করার চেষ্টা করেছিল।
ভারতের মিডিয়াগুলি বলছে যে, মধ্যপ্রদেশের মুসলমানরা মহররমের মিছিলে পাকিস্তানপন্থী স্লোগান তুলেছিল। রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এই প্রতিবেদনগুলিতে মন্তব্য করে বলেন যে, তালেবানী মানসিকতা সহ্য করবেন না। তার মন্তব্যের দুই দিন পর, তদন্তকারী শীর্ষস্থানীয় ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ প্রাথমিক’ বিজেপি পন্থী মিডিয়ার দাবিগুলিকে নাকচ করে দেয়।
এদিকে, আসামের উত্তর—পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের ইসলামিক পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ এবং স্থানীয় সাংবাদিকসহ ১৫ জন মুসলিমকে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে তালেবানকে সমর্থন করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন বা ইউএপিএ—এর অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যেটির উছিলায় কয়েক ডজন মুসলিম এবং অন্যান্য সরকার সমালোচককে কারাগারে পাঠিয়েছে বিজেপি।
লক্ষ্নৌ শহরের প্রখ্যাত কবি মুনাওয়ার রানা বিজেপির রোষানলে পড়েন, যখন তিনি বলেন যে, সময়ের সাথে সাথে চরিত্রগুলি পরিবর্তিত হয় এবং উদাহরণ হিসেবে রামায়ণ রচনার পর দেবতা হয়ে ওঠা বাল্মিকির উল্লেখ করেন যিনি আগে ডাকাত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘একজন ভারতীয় বা একজন মুসলিম হয়ে আমরা কখন কোন সন্ত্রাসীকে সমর্থন করেছি? তালেবানের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? কিন্তু যদি পৃথিবীর কোথাও বিস্ফোরণ হয় এবং কোনো মুসলিম জড়িত থাকে, তাহলে আমাদের এর জন্য দায়ী করা হবে।’
উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিবিদ শফিকুর রহমান বার্ককে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের সংগ্রামের তুলনা করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এখন তারা (আফগানিস্তান) যুক্তরাষ্ট্রের দখলে ছিল, আগে ছিল রাশিয়া, তারাও (তালেবান) স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং তাদের দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিল।’ যাইহোক, বার্ক এবং আরও দুজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়েছে, যারা একই রাতে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু যখন ভারতের বিজেপি নেতাগণ এবং মুখপাত্ররা তালেবানকে ‘সন্ত্রাসীবাদী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তখন কাতারে তাদের রাষ্ট্রদূত মঙ্গলবার দোহায় তালেবানদের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাই রানার মতো বার্কও বলেছেন যে, উত্তর প্রদেশ জাতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য, তাই ভোটারদের মেরুকরণ করতে বিজেপি তার বক্তব্যকে ভুলভাবে প্রচার করছে।
বার্ক বলেন, ‘দেওবন্দকে সন্ত্রাসের কেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং সেখানে ঘৃণার রাজনীতিকে আরও এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে কেন্দ্র স্থাপন করে উত্তরপ্রদেশের সরকার মুসলিম বিরোধী নীতি তৈরিতে ব্যস্ত। দেওবন্দকে এমনভাবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য কী করেছে? এটি একটি ইসলামিক প্রতিষ্ঠান যেখানে আলেমরা পড়াশোনা করেন, তাতে কি অন্যায়?
তিনি বলেন, ‘এটি একটি ঘৃণার নীতি যা তারা মনে করে যে তাদের নির্বাচনে জয় এনে দেবে।’
ভারতের মুসলিদের উপর ঘৃণামূলক হামলাসহ প্রকাশ্যে হত্যা এবং তাদের ব্যবসা—বানিজ্যকে টার্গেট করা ভারতে নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ভারতে ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাবলিগী জামাতকে দায়ী করা হয়েছিল।
২০২০ সালের প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) ভারতকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ বলে অভিহিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জাতীয় সরকার সংখ্যালঘুদের এবং তাদের উপাসনালয়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত রাখার অনুমতি দিয়েছে, এবং ঘৃণাপূর্ণ বক্তৃতা এবং সহিংসতায় উস্কানি দিতেও জড়িত ও সহ্য করে।’
অনেক ভারতীয় মুসলিম বলেছেন যে, যখনই যেকোনও স্থানে মুসলিদের সাথে জড়িত কোনো সন্ত্রাস—সম্পর্কিত ঘটনা ঘটে. তখনই তাদের যাচাই করা হয় এবং সমাজ এই কাজের নিন্দা করবে বলে আশা করা হয়। কিন্তু উল্টোটা কখনই বিবেচনায় নেয়া হয় না। অর্থাৎ, বিদেশে মুসলিমদের দ্বারা ভাল, মানবিক কাজের জন্য ভারতীয় মুসলমানদের কখনোই দায়ী করা হয় না, অথবা ভারতীয় মুসলিমদের এই ধরনের কাজগুলি ভারতের মিডিয়ার জন্য সংবাদ হয়ে ওঠে না।
Discussion about this post