শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে বহু নির্দেশনা রয়েছে। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ পূর্ণ করা হবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো; আর আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে’ (সুরা-৬২ জুমুআহ, আয়াত: ১০)। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ফরজ ইবাদতগুলোর পরেই হালাল উপার্জন ফরজ দায়িত্ব’ (তিরমিজি)। ‘হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে তা সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রম দ্বারা অর্জন করা হয়’ (মুসলিম)।
শ্রমিকের অধিকার ও শ্রমগ্রহীতার কর্তব্য সম্পর্কে হাদিস শরিফে আছে, ‘শ্রমিকেরা তোমাদেরই ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা যার ভাইকে তার দায়িত্বে রেখেছেন, সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করাবে; তাকে এমন কষ্টের কাজ দেবে না যা তার সাধ্যের বাইরে, কোনো কাজ কঠিন হলে সে কাজে তাকে সাহায্য করবে’ (মুসলিম, মিশকাত)। হজরত শুআইব (আ.) হজরত মুসা (আ.)–কে কাজে নিয়োগ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘আর আমি আপনাকে কষ্টে ফেলতে চাই না; ইনশা আল্লাহ! আপনি আমাকে কল্যাণকামী রূপে পাবেন’ (সুরা-২৮ কছাছ, আয়াত: ২৭)।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক লোক এসে নবীজি (সা.)–এর কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি কিছুই নেই?’ সে বলল, ‘আমার একটি কম্বল আছে।’ নবীজি বললেন, ‘যাও কম্বলটি নিয়ে এসো।’ কম্বল নিয়ে এলে নবীজি (সা.) তা নিলামে বিক্রয় করলেন দুই দিরহাম মূল্যে। এক দিরহাম তাকে দিয়ে দিলেন পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করতে আর এক দিরহাম দিয়ে কুড়াল কিনে নবীজি (সা.) নিজ হাতে তাতে হাতল লাগিয়ে দিলেন; আর ওই লোককে কাঠ কেটে উপার্জন করার নির্দেশ দিলেন। (বুখারি ও মুসলিম)।
সব নবীই কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা উপার্জন করেছেন। দ্বিতীয় আদম হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি বা সুতারের কাজ করেছেন। হজরত ইদ্রিছ (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হজরত সুলাইমান (আ.)–এর পিতা নবী ও সম্রাট হজরত দাউদ (আ.) লৌহশিল্প বা কামারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমনকি নবী হজরত শুআইব (আ.)–এর খামারে হজরত মুসা (আ.) ৮-১০ বছর চাকরি করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)ও মা খাদিজা (রা.)–এর কোম্পানিতে চাকরি করেছেন দীর্ঘকাল।
রমজান মাস রহমতের ও ইবাদতের জন্য বিশেষায়িত। এ মাসে মালিক বা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো শ্রমিকের প্রতি রহম করা, তাঁর কাজের চাপ কমিয়ে দিয়ে তাঁকে ইবাদতে সহায়তা করা। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমাদান মাসে তার কাজের লোকের কাজ কমিয়ে সহজ করে দিল, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসাব সহজ করে দেবেন’ (বুখারি)। পারিশ্রমিকের ব্যাপারে হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমরা শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করো তার ঘাম শুকানোর আগেই’ (বায়হাকি, মিশকাত)। যাঁরা শ্রমিকের মজুরি আদায়ে টালবাহানা করেন, তাঁদের ব্যাপারে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সামর্থ্যবান পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করা জুলুম বা অবিচার’ (বুখারি)। ‘হাশরের দিনে জুলুম অন্ধকার রূপে আবির্ভূত হবে’ (মুসলিম)। হাদিসে কুদসিতে আছে: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তাদের বিরুদ্ধে থাকব, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে, মানুষকে বিক্রি করে এবং ওই ব্যক্তি যে কাউকে কাজে নিয়োগ করল, অতঃপর সে তার কাজ পুরোটা করল; কিন্তু সে তার ন্যায্য মজুরি দিল না’ (বুখারি)। হাদিস শরিফে আছে, ‘যদি কেউ কারও ন্যায্য পাওনা অস্বীকার করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেন’ (মুসলিম)।
ইসলামি বিধানমতে, নিম্নতম মজুরি হলো শ্রমিকের মৌলিক অধিকারগুলো, তথা ‘খোরপোষ-বাসস্থান এবং শিক্ষা ও চিকিৎসা’ (বুখারি ও মুসলিম)। ক্ষতিগ্রস্ত বা অক্ষম শ্রমিক ও তার পরিবারের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা সম্পদ রেখে যাবে, তা তাদের উত্তরাধিকারীরা পাবে আর যারা অসহায় পরিবার-পরিজন রেখে যাবে, তা আমাদের (সরকার ও মালিকপক্ষের) দায়িত্বে’ (বুখারি, মুসলিম ও বায়হাকি)।
যে শ্রমিক আপন কর্তব্য পালনের পাশাপাশি আল্লাহর ইবাদত করেন, তাঁদের বিষয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যারা মালিকের হক (দায়িত্ব) আদায় করার পাশাপাশি আল্লাহর হক (ইবাদত)ও পালন করে, তারা দ্বিগুণ সওয়াব পাবে।’ (বুখারি ও মুসলিম; মিশকাত)।
লেখক: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
Discussion about this post