ফেসবুকে প্রায় তিন হাজারের বেশি বন্ধু রোমান সানার। কিন্তু মেয়ে বন্ধু মাত্র ত্রিশ জন। প্রতিদিন অনেক অনুরোধ পান। ইচ্ছে করেই সেসব এড়িয়ে চলেন। তারপরও কেউ মুঠোফোনে, কেউ মেসেঞ্জারে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন রোমান সানাকে। তবে এসব নিয়ে ভাবেন না বাংলাদেশে সেরা তিরন্দাজ।
তাঁর ভাবনায় আন্তর্জাতিক আর্চারিতে আরও ভালো কিছু করা। গত বছর হল্যান্ডে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে উঠে নিশ্চিত করেন টোকিও অলিম্পিকের টিকিট। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম তিরন্দাজ হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন রোমান। ওই প্রতিযোগিতায় জেতেন ব্রোঞ্জ, যা বিশ্বমানের কোনো আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের প্রথম কোনো পদক।
২০১৪ সালে ব্যাংককে এশিয়া কাপ স্টেজ ওয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে জেতেন সোনা। ২০১৭ সালে কিরগিজস্তানে আন্তর্জাতিক আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপেও সোনা জয়। ২০১৮ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ ও বিকেএসপিতে দক্ষিণ এশিয়ান আর্চারিতে জেতেন রুপা। গত বছরটা ছিল বড় সাফল্যে মোড়ানো। ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গীতে ইসলামিক সলিডারিটি আর্চারিতে রুপা, মার্চে ব্যাংককে এশিয়া কাপ আর্চারিতেও রুপা। এরপর জুনে নেদারল্যান্ডসে গড়েন ইতিহাস। বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে উঠে ব্রোঞ্জ জিতে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার লক্ষ্য পূরণ। সেপ্টেম্বরে ফিলিপাইনে এশিয়া কাপ র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে জেতেন সোনা। ডিসেম্বরে নেপালে এসএ গেমসের আর্চারিতে দশ সোনার সব কটিই জেতে বাংলাদেশ। ব্যক্তিগত, দলীয় ও মিশ্র দলগতে রোমান সানার তিনটি সোনা। বিশ্ব আর্চারির সর্বোচ্চ সংস্থা গত বছরের বর্ষসেরা চমক হিসেবে বেছে নিয়েছে রোমানকে। দেশেও রোমানের তারকাখ্যাতি বেড়ে চলেছে।
মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ রোমান বলেন, ‘মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না যে এতটা খ্যাতি পেয়েছি। এত দূর এসেছি। আমি কল্পনাও করিনি এত মানুষ আমাকে চিনবে।’ ফিলিপাইন থেকে ফেরার পর গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি খুলনার কয়রায়। সেখানে রোমানকে নিয়ে রীতিমতো মিছিল বের করে এলাকাবাসী। এরপর এলাকাবাসী তাঁকে দেয় সংবর্ধনা। সেদিনের ঘটনা মনে করে রোমান বলছিলেন, ‘গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখি আমাকে এক নজর দেখার জন্য সবাই অস্থির হয়ে আছে। অনেক দূরের গ্রাম থেকে লোকজন আমাকে দেখতে এসেছিল। এসব দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমার জন্য ওরা এসেছে।’
সিটি গ্রুপ বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এই প্রতিষ্ঠানের ‘তীর গো ফর গোল্ড’ কর্মসূচির অন্যতম নায়ক রোমান। এরই মধ্যে তীরের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছেন রোমান, টেলিভিশনে যেটা নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে লাগানো ডিজিটাল পর্দায় দেখানো হয় রোমানের এই বিজ্ঞাপন। গ্রিন ঢাকা ও ঢাকার চাকা বাসের গায়ে লাগানো হয়েছে রোমানের বিজ্ঞাপনের পোস্টার। রাজধানীর বিভিন্ন বাস স্টপেজেও চোখে পড়ে এসব বিজ্ঞাপন।
তীরের বিজ্ঞাপনের শুটিং হয়েছিল এফডিসিতে। চিত্রনায়ক রিয়াজ সেদিন রোমানের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। রোমান বলছিলেন, ‘আমরা এফডিসিতে শুটিং করার সময় হঠাৎ নায়ক রিয়াজ এলেন আমাদের ফ্লোরে। আমি তাকে আগেও দেখেছি। কিন্তু আমার সঙ্গে আসা অন্য খেলোয়াড়েরা দেখেনি। ওরা খুব আগ্রহ নিয়ে রিয়াজের সঙ্গে ছবি তুললেন। কিন্তু আমি এক জায়গা বসে আছি। হঠাৎ রিয়াজ এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, তোমাকে আমি চিনি। তুমি আমাদের দেশের গর্ব। অনেক দূরে এগিয়ে যাও, এটাই আমার চাওয়া। এরপর বললেন, এসো তোমার সঙ্গে একটা ছবি তুলি।’ রোমান এতে খুবই রোমাঞ্চিত ছিলেন। তাঁর কথা, ‘ছোট বেলা থেকে যার সিনেমা দেখে বড় হয়েছি সেই রিয়াজ আমার সামনে। আমাকে চেনেন। আমার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলেন। আমি তা কল্পনাও করতে পারছিলাম না।’
তরুণী ভক্তদের প্রসঙ্গ উঠতেই হেসে বলেন, ‘অনেকে বাড়িতে আসে। ফেসবুকে কথা বলার চেষ্টা করে। আমি ৩০ জন পরিচিত মেয়েকে বন্ধু তালিকায় রেখেছি। অপরিচিত মেয়েকে বন্ধু করি না। কিন্তু তারপরও অনেকে বলে, আপনাকে বিয়ে করতে চাই। তখন কি যে লজ্জা লাগে! পরে আর তাদের সঙ্গে কথা বলি না।’
রোমানের সব মনোযোগ আসলে খেলার ওপর। নেদারল্যান্ডসে ব্রোঞ্জ জেতার মুহূর্তের ভিডিওটা ফেসবুকে কয়েক লাখ দর্শক দেখেছে। এশিয়া কাপের সোনা জয়ের ভিডিও দেখেছে প্রায় আশি হাজারের মতো। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের ওপর তৈরি রোমানের সচেতনতামূলক ভিডিও বার্তা প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মতো দর্শক দেখেছে। মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ রোমানের এখন একটাই স্বপ্ন, ‘অলিম্পিকে বাংলাদেশের প্রথম পদক জিততে চাই।’ অবশ্য করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে যাওয়া টোকিও অলিম্পিক শেষ পর্যন্ত হবে কি না তা নিয়েই রয়েছে সংশয়।