– হাসান রূহী
শহীদ আবরার ফাহাদ। দেশের জন্য কথা বলায় যাকে এদেশেরই আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা একদল ঘাতক রাতের আঁধারে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আবরারের মুখে ছিল দাড়ি। পরনের প্যান্ট ছিল টাখনুর ওপরে। তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে শুধু এই কারণে যে, সে ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অত্যন্ত যৌক্তিক কিছু প্রশ্ন উপস্থাপন করেছে।
রাষ্ট্রের অত্যন্ত এই মেধাবী সন্তানকে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের কোনো সংস্থা বা মানুষ রাষ্ট্রের স্বার্থেই রাষ্ট্রবিরোধী দালালদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। এ ব্যর্থতা যেমন রাষ্ট্রের, তেমনই রাষ্ট্রের জনগণের।
গত কয়েকদিনে ফেসবুকে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরারের সহপাঠী বন্ধুদের কান্নার বেশকিছু ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ছবিগুলো দেখলে নিজেকে ধরে রাখা যায় না। ওদের বুকফাঁটা আর্তনাদ যেন নিমিষেই হৃদয়ের মাঝে বেদনার তুফান সৃষ্টি করে। এ বেদনার অনুভূতি আসলেই পুরোটা প্রকাশ করা যায় না।
কিন্তু, মনের কোনে প্রশ্ন উঁকি দেয়- হায়েনার ছোবলে পড়ে যখন এরচেয়েও হাজারগুন বেশি বেদনায় মেঝেতে পড়ে আবরার কাতরাচ্ছিল, তখন কোথায় ছিল আবরারের এই সহপাঠী বন্ধুরা? তারা কি আবরারকে বাঁচাতে একটুও এগিয়ে যেতে পেরেছিল? একটুও কি সাহস সঞ্চার করে তার পাশে দাঁড়াতে পেরেছিল? তাকে বাঁচাতে আদৌ কি কোনো কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল?
আমি জানিনা এই প্রশ্নগুলোর জবাব আবরারের সহপাঠীদের কাছে আছে কিনা। না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, যে প্রজন্ম জনৈক গোঁফারু প্রফেসরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেঞ্চ (গর্ত) খুঁড়ে কিংবা খাটের তলায় আশ্রয় নিয়ে থাকার গল্প পড়ে পড়ে বড় হয়েছে, তারা কিভাবে আবরারের মত সাহসী তরুণকে বাঁচাতে নিজেদের বুক পেতে দেবে!
আবরারের বন্ধুরা কে কতটুকু করেছে কিংবা করতে পেরেছে তা আমাদের কাছে অস্পষ্ট। কিন্তু কি কি তারা করতে পারে তা পর্যালোচনা হতেই পারে। তাতে ভবিষ্যতে এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য কোনো দেশপ্রেমিক তরুণের জীবন বাঁচাতে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো।
- আবরারকে যখন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা খুঁজছিল তখন আবরার ক্যাম্পাসেই ছিল না। আজ যারা আর্তনাদ করে এই তথ্য দিচ্ছেন যে, উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন ইসকনের সক্রিয় সদস্য অমিত সাহা তাকে খুঁজেছিল। তারা বুয়েটে ছাত্রলীগের নৃশংসতার ইতিহাস সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত আছেন। তারা পারতেন যেকোনো ভাবে যে কোনো মূল্যে আবরারের কাছে এই তথ্য পৌঁছে দিয়ে তাকে সতর্ক করতে। আপাতত তাকে ক্যাম্পাসে না ফিরে, কিংবা কিভাবে ফিরলে ভালো হয় সে ব্যাপারে তাকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা যেত।
- আবরারকে যখন গভীর রাতে তার কক্ষ থেকে অস্বাভাবিকভাবে ডেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আবরার নিশ্চয়ই ওই কক্ষে একা ছিলেন না। তার রুমমেটরাও এই ঘটনা দেখে নিশ্চয়ই তার ব্যাচের ছাত্রদের এই খবর জানিয়েছেন। যা তার সহপাঠীদের বক্তব্যেই প্রমাণিত হয়। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথেই ওই ব্যাচের সকল ছাত্র এক হতে পারতেন। একে অপরকে ডেকে সংঘবদ্ধ হতে পারতেন। একত্রে গিয়ে তারা দানবদের কাছে আবরারকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধটুকু করতে পারতেন।
- যদি অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হয় যে সেখানে সংঘবদ্ধ হয়ে গিয়েও কোনো সুবিধা করা যাবে না। উল্টো অসুবিধায় পড়া লাগতে পারে। তাহলে তারা এক এক করে ভাগ করে নিয়ে কয়েকজন মিলে হলের প্রভোস্ট, হাউস টিউটর, প্রক্টর, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য, এমনকি ভিসিকেও ফোন করে জানাতে পারতেন। এখন যেভাবে তারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন, আমার বিশ্বাস এসব জায়গায় তারা যদি এর সিকিভাগ আবেগ উজাড় করেও কাঁদতে পারতেন তাতেও হায়েনারা পিছু হটতে বাধ্য হতো।
- ধরেই নিলাম সীমাহীন দলীয়করণের প্রভাবে ওসব জায়গায় তারা ফোন করেও কোনো সুবিধা করতে পারলেন না। ছাত্রদের অভিভাবকের বেশ ধরে যারা শিক্ষকের আসনে আসীন তারা সবাই তাদের মাথা হায়েনার দলের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। নীল মৃত্যু হয়েছে তাদের বিবেকের। তারপরেও তার সহপাঠীরা অন্তত ৯৯৯ এ ফোন করতে পারতেন। লাশ হয়ে কফিনে না চড়ে শিবির হয়ে মাজলুম হয়ে জালিমের কারাগারেও তো সে আশ্রয় পেতে পারতো! যেমনটা আশ্রয় পেয়েছিল শিবিরের বর্তমান সেক্রেটারী জেনারেল সিরাজুল ইসলাম। যাকে হলের রান্নাঘরে নিয়ে মাথায় হেলমেট পরিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে ২ পা ১ হাত ভেঙে দিয়েছিল বর্বর ছাত্রলীগ। তাকে সেখান থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে ঠিক, কিন্তু ওই মূমূর্ষ অবস্থাতেই তার নামে মিথ্যা মামলা সাজাতে একটুও হাত কাঁপেনি তাদের।
বিশ্বাস করুন দুই একটি আঘাতে কিংবা দুই এক মিনিটেই আবরারের মৃত্যু হয়নি। ঘন্টার পর ঘন্টা পিটিয়ে অবশ করে ফেলা হয়েছে তাকে। ধীরে ধীরে মৃত্যু গ্রাস করেছে তাকে। ভিডিওতে শুনলাম, আবরার সেই অন্তিম মূহুর্তে কালেমা পড়ে শহীদ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর তার বন্ধুরা নাকি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক সেদিক ছুটছিল।
আমি আবরারের বন্ধুদের হেয় করতে চাচ্ছি না। তাদের অপারগতাকে হেলার চোখে দেখছি না। কিন্তু বিপদ যত বড়ই হোক তাকে মোকাবেলার সাহস যদি আমাদের না থাকে তবে আগামী দিনে এমন শত শত ঘটনা দেখার জন্য দেশের তরুণ সমাজকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
আপনারা হয়তো বলতে পারেন- কেন সেদিন আবরারের বন্ধুরা কোনো কিছুই করতে পারেনি? এর উত্তরে আমি যা বলবো তা শুনলে আপনার মন আরও খারাপ হতে পারে।
প্রথম কথা হলো আবরারের বন্ধুরা তাকে জুলুম থেকে বাঁচাতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। তার বিশেষগুলো হচ্ছে- আবরারের বন্ধুরাও কেউ কেউ ওইসব সন্ত্রাসীদের পায়ে তেল মেখে হলে জায়গা পেয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ওই বর্বরদের দলে নিজের নাম লিখিয়েছে। কারণ, ওখানে নাম থাকলে ভবিষ্যতে সরকারি চাকরিতে নিজের স্থান করে নেয়া সহজ হয়ে যায়। তাদের অনেকেই এই ঘটনার আগ পর্যন্ত মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, শিবির হলে তাকে নির্মমভাবে পেটানো যায়। হাত ভাঙা যায়, পা ভাঙা যায়, কোমর ভাঙা যায়। এমনকি মেরে পুলিশেও দেয়া যায়। শিবির হলে বুয়েটের মত ক্যাম্পাসে তাঁর বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। আর এসব বিশ্বাস মনের মধ্যে জমা রেখে কিভাবে আবরারের মত শিক্ষার্থীর জীবন বাঁচাতে তারা এগিয়ে আসবে?
দ্বিতীয় কথা হলো- গত প্রায় ১০ বছর যাবত এই প্রজন্ম দেশে যে পরিমাণ অবিচার দেখে দেখে বড় হয়েছে, তাতে তারা সত্যের পক্ষে ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে বুক পেতে রুখে দাঁড়াবার কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি। অনুশীলন করতে পারেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রসফায়ার, গুম-খুনের রাজনীতি তরুণ প্রজন্মকে ভীরু করে তুলেছে দিন দিন। ফলে অন্যায়ের শিকার হয়ে, জুলুমের শিকার হয়ে তারা আজ যতটা ডুঁকরে কাঁদতে পারে, জালিমের বিরুদ্ধে ততটা হুঙ্কার দিতে পারে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।