কাজী নজরুল ইসলাম
তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ।
৬ তারিখ প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ক্ষমতা ছাড়েন প্রেসিডেন্ট এরশাদ।
এদিকে, দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট করে তার অধীনে ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার’ ব্যবস্থাপনায় তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আন্দোলনরত সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যমত পোষণ করেছিল।
সেই নির্বাচনকালীন সরকার ‘তত্বাবধায়ক সরকার’ নামে পরিচিতি পায়। সেবারের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
কিন্তু সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ‘তত্বাবধায়ক সরকার’ সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করতে গড়িমসি করে বিএনপি। প্রতিবাদে রাজপথের আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে উঠে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।
জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে রাজপথ কাঁপাতে থাকে আওয়ামী লীগ। তারপরও বেগম খালেদা জিয়া নিজের অধীনেই নির্বাচন দেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের ওই নির্বাচন বিএনপি ও কয়েকটি ছোট দল ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল বর্জন করে।
ফলে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৭৮টিতে জিতে পুনরায় সরকার গঠন করে বিএনপি। কিন্তু তীব্র আন্দোলনের মুখে সংসদে তত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করে ৩০ মার্চ সংসদ ভেঙে দেয়া হয় এবং খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন।
অতপর সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা।
২০০১ সালে সংবিধান মোতাবেক সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। ২০০১ সালের ওই নির্বাচনে জিতে পুনরায় ক্ষমতায় আসেন বেগম খালেদা জিয়া।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনকালীন সময়ে সংবিধান মোতাবেক তত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রসঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ রাজপথে এসময় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে।
উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীন বেগম খালেদা জিয়া প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করেছিলেন। এতে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বভার পড়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের ওপর।
কিন্তু অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি না করলে দায়িত্ব পড়তো বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন এর ওপর।
শেখ হাসিনা অভিযোগ করলেন, বিচারপতি কে এম হাসান বিএনপির দলীয় ব্যক্তি। অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধির কারসাজি করে তাকে উদ্দেশ্যমুলকভাবে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হচ্ছে।
অর্থাৎ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচন মানেননি। এমনকি খালেদা জিয়ার পছন্দের ব্যক্তি অযুহাতে ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানের অধীনেও নির্বাচন মানেনি।
এছাড়া তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রথমে মানলেও বিএনপি মনোনিত প্রেসিডেন্ট হওয়ায় পরে ইয়াজউদ্দিন আহমেদের অধীনেও নির্বাচন মেনে নেননি তিনি। পরবর্তীতে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনেছেন শেখ হাসিনা।
অথচ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আজীবনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছেন শেখ হাসিনা।
২০১৪ সালে শেখ হাসিনা নিজের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু নিজের অধীনেই নির্বাচন করে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠন করেন তিনি। পরবর্তীতে সংসদ ভেঙেও দেননি।
অর্থাৎ নিজেই শাসক, নিজেই নির্বাচক; জনগণ কিছু নয়। জেনারেল এরশাদের মতো শেখ হাসিনাও ‘নির্বাচিত স্বৈরশাসক’।
বেগম খালেদা জিয়া বা তার নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া শেখ হাসিনা আবারো নিজের অধীনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে সবাইকে আহ্বান করছেন।
তত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থাপনা বাতিল করে অনুগত পুলিশ, র্যা ব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর বন্দুকের মুখে জনগণকে জিম্মি করে তিনি আজীবনের জন্য প্রধানমন্ত্রী থাকতে চাচ্ছেন।
জনগণের ভোট নয়, বন্দুকের নলই শেখ হাসিনার ক্ষমতার উৎস!