১৯৯৪ সালে জামায়াত পড়েছে মহাবিপদে। একদিকে বিএনপির স্বৈরাচারী আচরণ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেয়ারটেকার আন্দোলন। কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন যতটা না আওয়ামী লীগের তার চাইতে বেশি জামায়াতের।
প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের হাতে থেকেছে। জামায়াতের সংকট হলো, কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতির উদ্ভাবক হলেও আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পেছনেই পড়ে থাকতে বাধ্য হবে। রাজনৈতিক ও আদর্শিক দিক থেকে জামায়াতের জন্য এ অবস্থান মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আন্দোলনে জামায়াত যত বলিষ্ঠ ভূমিকাই পালন করুক, জনগণ জামায়াতকে আওয়ামী লীগের লেজুড় বলেই ধারণা করবে।
এই বিষয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //ভারতবিরোধী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর যে ইমেজ রয়েছে তা দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জামায়াতের মতো একটি ইসলামী দলকে আওয়ামী লীগের মতো ইসলামবিরোধী দলের নেতৃত্বে আন্দোলন করতে দেখলে কিছু লোক এ ভুল ধারণাও করতে পারে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ হয়ত ১৯৭৫-পূর্ব আওয়ামী লীগের মতো ইসলামের দুশমন নয়।//
১৯৯০ সালে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী যুগপৎভাবে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা কায়েমের দাবিতে আন্দোলন করলেও সে আন্দোলন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত ছিল না। বিএনপি ইসলামী দল না হলেও জনগণের নিকট ইসলামবিরোধী হিসেবে গণ্য নয়। তাই বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোনো আন্দোলনে জামায়াতের শরিক হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //ঐ সময় মানসিক দিক দিয়ে আমি এত বেশি পেরেশান ছিলাম, সে কথা মনে হলে এখনও বেদনাবোধ করি। রাজনৈতিক আন্দোলনে কোনো সময় আমি এমন কঠিন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। যেহেতু কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু জামায়াতের সৃষ্টি, সেহেতু আওয়ামী লীগ এ দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে জামায়াতের পক্ষে নিশ্চুপ থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর জামায়াত আন্দোলনে শরিক না হলে রাজনৈতিক ময়দান থেকে চিরবিদায় নিতে বাধ্য হবে।//
এ মহাসংকট থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও সংসদে জামায়াতের পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আলাদাভাবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত। তাঁকে সংগঠনের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি যেন কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে খালেদা জিয়াকে বুঝিয়ে বলেন।
শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জামায়াতের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে জাতীয় সংসদনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তাঁর দফতরে একান্তে সাক্ষাৎ করে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, //১৯৯০ সালে এরশাদের আমলে কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আপনার সাথে মিলে যুগপৎ আন্দোলন করেছি। আন্দোলন সফল হয়েছিল বলেই কেয়ারটেকার সরকার কায়েম হয়েছে এবং সংসদ নির্বাচন আমাদের দাবি অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নির্বাচনে আপনি সর্বোচ্চসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়েছেন। কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন না হলে আপনি কিছুতেই এত আসনে বিজয়ী হতে সক্ষম হতেন না। কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতির বদৌলতেই আপনার উত্থান। আমরা আশা করেছিলাম, নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে আপনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে সংসদে বিল উত্থাপন করে এ চমৎকার পদ্ধতিটি সংবিধানে সংযোজনের ব্যবস্থা করবেন। আমরা ‘৯১ সালেই বিল জমা দিয়েছি। অন্যান্য বিরোধী দলও এ উদ্দেশ্যে বিল জমা দিয়েছে।
কিন্তু সংসদে এ বিষয়টি আলোচনার কোনো ব্যবস্থা এ পর্যন্ত হলো না। বাধ্য হয়ে সংসদের বাইরে সকল বিরোধী দল এর পক্ষে দাবি জানিয়ে আসছে। জনগণ এ বিষয়ে অবহিত যে, বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা দাবি করছে আর সরকারি দল এ দাবিকে অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করে চলেছে।
মাগুরা জেলার মুহাম্মদপুর আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা ঘোষণা করেছে যে, এ সরকারের পরিচালনায় আর কোনো নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না। তারা এখন কেয়ারটেকার সরকার সংবিধানে সংযোজনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, এমনকি সংসদ বয়কট করারও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।//
নিজামী সাহেব বলেন, //কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু ছাড়া আওয়ামী লীগের নিকট অন্য কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই। জনগণকে আকৃষ্ট করার মতো কোনো কর্মসূচিও তাদের হাতে আছে বলে মনে হয় না। কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের দাবি মেনে নিয়ে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায়, বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল এ দাবিতে একমত হওয়ায় এবং এর ভিত্তিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ দাবি বিশাল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ দাবিতে আবার আন্দোলন হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুলসংখ্যায় সাড়া দেবে বলে ধারণা করা যায়।
আমরা নিশ্চিত যে, কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন হলে আগামী নির্বাচনে আপনি আরো বেশি আসনে বিজয়ী হবেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কিছুতেই অধিকাংশ আসন পাবে না। তাই আপনি এ জনপ্রিয় ইস্যু আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেবেন না। আপনি স্বয়ং উদ্যোগ নিয়ে এটাকে সংবিধানে সংযোজনের ব্যবস্থা করুন। এত বড় একটা হাতিয়ার হাতছাড়া করবেন না।
আপনি জানেন, এ ইস্যুটি জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্টি। এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করলে জামায়াত তাতে শরিক হতে বাধ্য হবে। জামায়াত কিছুতেই আপনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে আন্দোলনে যেতে চায় না। আপনি আমাদেরকে আওয়ামী লীগের দিকে ঠেলে দেবেন না। আমাদেরকে আপনার রাজনৈতিক দুশমনে পরিণত করবেন না।
আওয়ামী লীগ সংসদ বয়কটের ঘোষণা দেবে বলে মনে হচ্ছে। এর আগেই যদি কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে বলে আপনি ঘোষণা দেন, তাহলে সংসদের আগামী অধিবেশনে আমরা যোগদান করব। তখন আওয়ামী লীগও সংসদে যেতে বাধ্য হবে। আপনি এ সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগ আপনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আর কোনো জনপ্রিয় ইস্যুই পাবে না। আমি বড় আশা নিয়ে আপনার নিকট হাজির হয়েছি।//
নিজামী সাহেবের দীর্ঘ যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনলেও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর পূর্বসিদ্ধান্তে অটল থেকেছিলেন। তিনি বেশি কিছু বলেননি। নিজামী সাহেবের কোনো যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টাও করেননি। অত্যন্ত দাম্ভিকতার সুরে আঙুল উচিয়ে নিজ মুখের দিকে ইশারা করে উচ্চারণ করেছিলেন, “এ মুখ দিয়ে ‘কেয়ারটেকার সরকার’ উচ্চারণ হবে না।”
শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //হতাশা ও দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজামী সাহেব আমাকে যখন রিপোর্ট দিয়েছিলেন তখন আমার পেরেশানি আরো বেড়ে গিয়েছিল। আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে ভেবেছিলাম, বেগম জিয়া এত বড় ভুল সিদ্ধান্ত কেমন করে নিলেন? কার কুপরামর্শে তিনি কেয়ারটেকার সরকার ফর্মুলাকে শিশুসুলভ বলে ধারণায় পৌঁছালেন? এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন কীভাবে?//
১৯৯৪-এর জুনের প্রথম সপ্তাহে সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছিল। অধিবেশন শুরুর আগের দিন বেগম জিয়া এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বিরোধী দলসমূহকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘জনগণ আপনাদেরকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে আপনারা রাজপথে কেন আন্দোলন করবেন? যা বলার সংসদেই বলুন, তবে কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কে সংসদে কোনো আলোচনা হবে না।’
খালেদা জিয়ার এই কথা বিরোধী দলকে রাজপথে আন্দোলন করতে বাধ্য করেছিলো। সকল বিরোধী দলও সংসদ বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে আশা করা হয়েছিল যে, স্বাভাবিক নিয়মেই বিএনপি সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করবে এবং বিরোধী দল সংসদে স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্ব পালন করবে।
সরকার যদি নিজেই কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিত, তাহলে গণতন্ত্র স্বাভাবিক গতিতেই অগ্রসর হতো। সরকারের অপ্রত্যাশিত ও স্বৈরাচারী ভূমিকার ফলে বিএনপির বিরুদ্ধে চরম রাজনৈতিক বৈরীভাব সৃষ্টি হলো। যে কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি কায়েমের দাবি বিএনপিসহ সকল দল মেনে নিয়েছিল, সে দাবিতে আবার আন্দোলন করতে সরকার বাধ্য করলো।
এতে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে বিএনপিকে সমর্থন করলো, অথচ বিএনপিই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করলো। এ আন্দোলন না হলে বিএনপি সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই সরকারের পদত্যাগ করার দাবি উঠত না।
এ দাবির কারণে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে গেল। নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ দান করাই গণতন্ত্রের দাবি। ১৯৮৮ সালে উল্লেখযোগ্য সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করা সত্ত্বেও স্বৈরশাসক এরশাদ নির্বাচন করেছে। আর নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল বিহীন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে কলুষিত করেছে।
এ অস্বাভাবিক নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার গঠন করার দুসপ্তাহের মধ্যেই সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি সংযোজন করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের ১৩ নং সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইন প্রণীত হয়। এ আইন অনুযায়ীই যথাক্রমে ১৯৯৬ সালের ১৫ই জুন এবং ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর ৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অনেক কারণেই আওয়ামী লীগ সংসদে বেশি আসন পেয়েছে এবং এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থনে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ১৯৯১ সালে কেয়ারটেকার সরকার ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে গঠিত।
১৯৯৬ সালের কেয়ারটেকার সরকার ছিল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকার। আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায় ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ব্যাকফুটে চলে যায়। নির্বাচনী পরিবেশ আওয়ামী লীগের অনুকূলে চলে গেছে। বিএনপির জনপ্রিয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার পরও ১১৬ আসনে বিজয়ী হয়েছে।
শেখ হাসিনা নির্বাচনের পূর্বে ওমরাহ করে হিজাব অবস্থায় তাসবীহ হাতে নিয়ে দেশে ফিরে এসে গোটা নির্বাচনী অভিযানে দুই হাত জোড় করে জনগণের নিকট দলের অতীত সকল ভুলের জন্য ও ইসলাম বিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। জনগণ তাদেরকে সুযোগ দিয়েছে। ১৪৬ টি আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এরশাদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
এভাবে কেয়ারটেকার বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়, জনপ্রিয়তা পায় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সবশেষ সংবিধানে অন্তুর্ভুক্ত হয়।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Discussion about this post