২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় জামায়াত।
সেসময় এই ব্যাপার নিয়ে বাম পাড়া ও মিডিয়া পাড়ায় জামায়াতের ব্যাপক সমালোচনা হয়। তারা বলতে চেয়েছে বহু রাষ্ট্র শুধুমাত্র ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে বিপুল অর্থ আয় করেছে। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহার করতে দিলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে।
জামায়াত যেসব পয়েন্টে এই ট্রান্সশিপমেন্টের বিরোধীতা করেছে তা হলো,
১। ভারত তাদের বিদ্রোহীদের দমন করতে বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে। বাংলাদেশ বাফার স্টেটে পরিণত হবে। ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত হবে।
২। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ভারতকে সুবিধা দিতে গিয়ে দেশের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এমনিতেই জাহাজ খালাস করতে ৬ দিনের জট থাকে। ভারতের মালামালের অতিরিক্ত চাপ দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। বিশেষ করে পোষাক খাতে আমরা আমাদের প্রতিযোগীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়বো।
৩। ভারতীয় মাদকের বিস্তার ও চোরাচালানের অবাধ সুযোগ তৈরি হবে।
৪। বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ভারতের প্রশ্রয়ে আবারো চাঙ্গা হবে।
৫। বন্দরের নিরাপত্তার নামে ভারত বন্দর ও আমাদের নিয়ন্ত্রিত সমুদ্র তাদের দখলে রাখবে।
জামায়াত সবগুলো বিভাগীয় শহরে বিশাল সমাবেশ করে। মানুষকে সচেতন করে। অনেকক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক নেতাদের বুঝাতে সক্ষম হয়। যেমন চট্টগ্রাম বন্দর যাতে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ না দেওয়া হয় এজন্য চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনকে রাজি করায়। মহিউদ্দিন ২০১০ সালে এই বিষয়ে কথা বলে।
কিন্তু জামায়াতের কথায় তো আর আওয়ামীলীগ বসে থাকবে না। থাকেও নি। ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইনের অধীনে ২০১০ সালে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ‘ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট পণ্যের কাস্টমস ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১০’ শীর্ষক ওই বিধিমালায় ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
বিধিমালায় বলা হয়, সড়ক বা রেলপথে প্রতি টিইইউ কনটেইনারের ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি প্রযোজ্য হবে। সড়কপথে কাভার্ড ভ্যান বা কাভার্ড ট্রাকে পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি হবে ১ হাজার টাকা। আর নন-কনটেইনার জাহাজ বা রেলপথে পরিবহনের জন্য প্রতি টন বাল্ক পণ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট ফি হবে ১ হাজার টাকা। এছাড়া ট্রান্সশিপমেন্ট বা ট্রানজিট পণ্যের জন্য বিমা কাভারেজ বাধ্যতামূলক বলা হয়। আর কনটেইনার স্ক্যানিং চার্জ শুল্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্ধারিত হবে।
কিন্তু ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার মামা বাড়ির আবদার করে। তারা কোনো ট্রান্সশিপমেন্ট ফি রাজি নেই। বাংলাদেশের জাহাজ যেভাবে শুল্ক আদায় করে তারা সেভাবেই ট্যাক্স দেবে বলে জানায়। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় বিষয়টি ঝুলে যায়।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনা করে ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে আলোচনা পিছিয়েছে বিষয়টা এমন নয়, বরং সে এই ব্যাপারটাকে পূঁজি করে রাখে যাতে বেকায়দা অবস্থা থেকে সে মুক্তি পেতে পারে।
২০১৬ সালে পিআইডব্লিউটিটির আওতায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার শুরু করে ভারত। এতে বন্দর থেকে আখাউড়া দিয়ে ভারতে যায় পণ্যবাহী ট্রাক। সে বছর প্রতি টনে মাত্র ১৩০ টাকা মাশুল নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতি টনে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ১০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা ও সিকিউরিটি চার্জ ১০০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কনটেইনারে (২৫ টন) ট্রান্সশিপমেন্ট ফি পড়বে ৫০০ টাকা। আর চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নির্ধারিত মাশুলেও প্রতি কনটেইনারের ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ৫০০ টাকা। ২০১০ সালের নির্ধারিত ফি থেকে কমিয়ে প্রায় বিনামূল্যে করে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ২০২৩ সালে ২৪ এপ্রিল দেওয়া রাজস্ব বোর্ডের নতুন আদেশ অনুযায়ী, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি প্রতি মেট্রিক টনের জন্য ২০ টাকা, অথচ ২০১০ সালে এটি ছিল ১০০০ টাকা। এছাড়া ডকুমেন্ট প্রক্রিয়াকরণ ফি প্রতি চালানোর জন্য ৩০ টাকা, সিকিউরিটি চার্জ প্রতি টন ১০০ টাকা, এসকর্ট চার্জ প্রতি কন্টেইনার বা ট্রাক ৮৫ টাকা, বিবিধ প্রশাসনিক চার্জ ১০০ টাকা। যাও একেবারেই নামমাত্র।
২৫ টন করে পণ্য বহনকারী ২০ ফুটের (টিইইউ) প্রতিটি কনটেইনারের জন্য মাত্র ৫০০ টাকা হারে ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ দিতে হবে ভারতকে। যদিও ২০১০ সালে এ হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০১০-এর নির্ধারিত চার্জের তুলনায় বর্তমানে ২০ ভাগের এক ভাগ ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ ধার্য হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নামমাত্র মূল্যে বন্দর ও ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের আয় তো হবেই না বরং এই ট্রানজিট সুবিধা দিতে গিতে যে অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা করতে হবে তার খরচও উঠবে না।
হাসিনা ভারতের মামাবাড়ির আবদার এতদিন কেয়ার করে নি। এখন এসে আবদার মেনে নিচ্ছে কারণ আমেরিকা তার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য হাসিনা ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। আর এই জন্যই ভারতকে বিনামূল্যে ট্রানজিট ও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে।
এদিকে ভারত স্থায়ীভাবে বন্দর ব্যবহার ও ট্রানজিট সুবিধা পেলেও বাংলাদেশের দাবির বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ভারতকে স্থায়ীভাবে বন্দর ব্যবহার ও শত শত কিলোমিটার ট্রানজিট সুবিধা দিচ্ছে ৮ টি রুটে। পক্ষান্তরে মাত্র একটি রুটে ৩৪ কিলোমিটার সড়ক ভারত স্থায়ীভাবে ব্যবহার করতে দেয় না। তাদের ইচ্ছেনুযায়ী ও অল্প কিছু নির্দিষ্ট পণ্যে শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়।
২০১০ সালের মার খাওয়ার আগের জামায়াত আর ২০২৩ সালের মার খাওয়ার পরের জামায়াত এক নয়। তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ভারতের এই আগ্রাসী অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার মতো, জনমত গঠন করার মতো কেউ অবশিষ্ট রইলো না। উল্লেখ্য ২০০৯ সালে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে জামায়াতের দূর্বার আন্দোলন ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে এই বাঁধ থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছিল।
আজকে যদি জামায়াত নেতারা সক্রিয় থাকতেন তবে ভারত বিনামূল্যে আমাদের বন্দর নিয়ে যেতে পারতো না। আফসোস! ছবিতে থাকা সামনের সারির প্রত্যেকে হয় কবরে নয়তো কারাগারে!
Discussion about this post