নবুয়্যুতের দশম বছরে অর্থাৎ আমাদের প্রিয় নবীর বয়স যখন পঞ্চাশ বছর তখন এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। একদিন রাত্রে যখন কা’বায় রাসূলুল্লাহ সা. শুয়ে ছিলেন, তখন তাঁর নিকট তিনজন ফেরেশতা আসেন। তাঁদের মধ্যে প্রথম জন জিজ্ঞেস করেন, “ইনি এই সবের মধ্যে কে?” মধ্যজন উত্তরে বলেনঃ “ইনি এসবের মধ্যে উত্তম।” তখন সর্বশেষজন বলেনঃ “তা হলে তাঁকে নিয়ে চলো।” ঐ রাত্রে এটুকুই ঘটলো। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁদেরকে দেখতে পেলেন না, কিন্তু শুনতে পেয়েছেন।
দ্বিতীয় রাত্রে আবার ঐ তিনজন ফেরেশতা আসলেন। ঘটনাক্রমে রাসূলুল্লাহ সা. ঐ সময়েও শুয়ে ছিলেন। ঐ রাত্রে তাঁরা কোনো আলাপ আলোচনা করেন নাই। তাঁরা নবীকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে যমযম কূপের নিকট শায়িত করেন এবং জিবরাঈল আ. তাঁর গলা থেকে বুক পর্যন্ত বিদীর্ণ করে দেন এবং বক্ষ ও পেটের সমস্ত জিনিস বের করে নিয়ে জমজমের পানি দ্বারা ধুয়ে নেন।
যখন খুব পরিষ্কার হয়ে যায় তখন তাঁর কাছে একটা সোনার থালা আনা হয় যাতে বড় একটি সোনার পেয়ালা ছিল। ওটা ছিল হিকমত ও ঈমানে পরিপূর্ণ। ওটা দ্বারা তাঁর বক্ষ ও গলার শিরাগুলিকে পূর্ণ করে দেন। তারপর বক্ষকে শেলাই করে দেওয়া হয়। এরপর মুহাম্মদ সা. পূর্ণ জাগ্রত ও চেতনা ফিরে পান। এরপরের বর্ণনা আমরা তাঁর নিজের মুখেই শুনি যা বায়হাকিতে বর্ণিত হয়েছে।
“আমি উঠে বসলাম কিন্তু কাউকেও দেখতে পেলাম না। তবে জানোয়ারের মত একটা কি দেখলাম এবং গভীরভাবে দেখতেই থাকলাম। অতঃপর মসজিদ হতে বেরিয়ে দেখতে পেলাম যে, একটা বিস্ময়কর জন্তু দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের জন্তগুলির মধ্যে খচ্চরের সঙ্গে ওর কিছুটা সাদৃশ্য ছিল। ওর কান দুটি ছিল উপরের দিকে উত্থিত ও দোদুল্যমান। ওর নাম হচ্ছে বুরাক। আমার পূর্ববর্তী নবীরাও এরই ওপর সওয়ার হয়ে এসেছেন। আমি ওরই উপর সওয়ার হয়ে চলতেই রয়েছি এমন সময় আমার ডান দিক থেকে একজন ডাক দিয়ে বললো, “হে মুহাম্মদ সা.! আমার দিকে তাকাও, আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো।” কিন্তু আমি না জবাব দিলাম, না দাঁড়ালাম। এরপর কিছু দূর গিয়েছি এমন সময় বাম দিক থেকেও ডাকের শব্দ আসলো। কিন্তু এখানেও আমি থামলাম না এবং জবাবও দিলাম না। আবার কিছু দূর অগ্রসর হয়ে দেখি যে, একটি স্ত্রীলোক দুনিয়ার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেও আমাকে বললো, “আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। কিন্তু আমি তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করলাম না এবং থামলামও না।”
এরপর আমি বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছালাম, জিব্রাঈল আমাকে দুটি পাত্র দিলেন, একটি ছিল দুধের পাত্র অন্যটি মদের। আমি দুধ পছন্দ করেছিলেন। অতঃপর হযরত জিবরাঈল আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার চেহারায় চিন্তারভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে কেন?”
আমি তখন পথের ঘটনা তিনটির কথা বর্ণনা করলাম। তিনি তখন বলতে শুরু করলেনঃ “প্রথম লোকটি ছিল ইয়াহূদী। যদি আপনি তার কথার উত্তর দিতেন এবং সেখানে দাঁড়াতেন তবে আপনার উম্মত ইয়াহুদী হয়ে যেতো। দ্বিতীয় আহ্বানকারী ছিল খৃষ্টান। যদি আপনি সেখানে থেমে তার সাথে কথা বলতেন তবে আপনার উম্মত খৃস্টান হয়ে যেতো। আর ঐ স্ত্রী লোকটি ছিল দুনিয়া। যদি আপনি সেখানে থেমে তার সাথে কথা বলতেন তবে আপনার উম্মত আখেরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে হতো।”
অতঃপর আমি এবং হযরত জিবরাঈল বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করলাম এবং দু’জনই দু’রাকাত করে নামায আদায় করলাম। (বাইতুল মুকাদ্দাস হজরত ইব্রাহিম আ.-এর যুগ হতে নবীদের কেন্দ্রস্থল ছিল। আর একারনেই সব নবী সা.-এর সাথে মহানবীকে একত্রিত করা হয়। এবং মহানবী সা. সকল নবীকে সাথে নিয়ে নামাজে ইমামতি করেন।)
তারপর আমাদের সামনে মি’রাজ (আরোহণের সিঁড়ি) হাজির করা হলো। দুনিয়া এইরূপ সুন্দর জিনিস আর কখনো দেখে নাই। তোমরা কি দেখ না যে, মরণান্মুখ ব্যক্তির চক্ষু মরণের সময় আকাশের দিকে উঠে থাকে? এটা দেখে বিস্মিত হয়েই সে ঐরূপ করে থাকে। আমরা দু’জন ওপরে উঠে গেলাম। আমি ইসমাঈল নামক ফেরেস্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি দুনিয়ার আকাশের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। তার অধীনে সত্তর হাজার ফেরেশতা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রত্যেক ফেরেশতার সঙ্গীয় ফেরেশতাদের সংখ্যা হলো এক লাখ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমার প্রতিপালকের সৈন্যদেরকে শুধুমাত্র তিনিই জানেন।”
হযরত জিবরাঈল আ. আকাশের দরজা খুলতে বললে জিজ্ঞেস করা হলো, “কে?” তিনি উত্তর দিলেন, “জিবরাঈল (আঃ)।” প্রশ্ন করা হলো, “আর কে আছেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হযরত মুহাম্মদ সা.।” পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো আপনাকে কি তাঁর নিকট পাঠান হয়েছিল?” তিনি জবাব দিলেনঃ “হ্যাঁ”
অতঃপর ১ম আসমানে প্রবেশ করলাম। সেখানে আমি হযরত আদমকে আ.-কে দেখলাম। জিবরাঈল আদম আ.-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন, “ইনি আপনার পিতা হযরত আদম আ.। তাঁকে সালাম দিন।” হযরত আদম আ. সালামের জবাব দেন এবং মারহাবা বলে অভ্যর্থনা জানান ও বলেন, “আপনি আমার খুবই উত্তম ছেলে। কিছু দূর গিয়ে দেখি যে, একটি ঝুড়ি রাখা আছে এবং তাতে অত্যন্ত উত্তম ভাজা গোশত রয়েছে আর এক দিকে রয়েছে আর একটি ঝুড়ি। তাতে আছে পঁচা দুর্গন্ধময় ভাজা গোশত।
এমন কতকগুলি লোককে দেখলাম যারা উত্তম গোশতের কাছেও যাচ্ছে না এবং ঐ পচা দুর্গন্ধময় ভাজা গোশত খেয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হে জিবরাঈল! এই লোকগুলি কারা?” উত্তরে তিনি বলেন, “এরা হলো আপনার উম্মতের ঐ সব লোক যারা হালাল কে ছেড়ে হারামের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে।”
আরো কিছু দূর অগ্রসর হয়ে দেখি যে, কতকগুলি লোকের ঠোঁট উটের মত। ফেরেস্তারা তাদের মুখ ফেড়ে ফেড়ে ঐ গোশত তাদের মখের মধ্যে ভরে দিচ্ছেন। যা তাদের অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তারা ভীষণ চীৎকার করছে এবং মহান আল্লাহর সামনে মিনতি করতে রয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ “এরা কারা?” জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “এরা আপনার উম্মতের ঐসব লোক যারা ইয়াতীমদের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতো। যারা ইয়াতীমদের মাল অন্যায়ভাবে খায় তারা নিজেদের পেটের মধ্যে আগুন ভরে দিচ্ছে এবং অবশ্য অবশ্যই তারা জাহান্নামের জ্বলন্ত অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করবে।”
আরো কিছু দূর গিয়ে দেখি যে, কতকগুলি স্ত্রী লোক নিজেদের বুকের ভরে লটকানো রয়েছে এবং হায়! হায়! করতে আছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “এরা হচ্ছে আপনার উম্মতের ব্যভিচারিণী স্ত্রীলোক।”
আর একটু অগ্রসর হয়ে দেখি যে, কতকগুলি লোকের পেট বড় বড় ঘরের মত। যখন উঠতে চাচ্ছে তখন পড়ে যাচ্ছে এবং বার বার বলতে আছেঃ “হে আল্লাহ! কিয়ামত যেন সংঘটিত না হয়।” আর তারা হা-হুতাশ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জবাবে হযরত জিবরাঈল আ. বললেন, এরা হচ্ছে আপনার উম্মতের ঐ সব লোক যারা সুদ খেতো। সুদখোররা ঐ লোকদের মতই দাঁড়াবে যাদেরকে শয়তান পাগল করে রেখেছে।
আরো কিছু দূর গিয়ে দেখি যে, কতকগুলি লোকের পার্শ্বদেশের গোশত কেটে কেটে ফেরেশতাগণ তাদেরকে খাওয়াচ্ছেন। আর তাদেরকে তারা বলতে আছেন, “যেমন তোমরা তোমাদের জীবদ্দশায় তোমাদের ভাইদের গোশত খেতে তেমনই এখনো খেতে থাকো।” আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে জিবরাঈল! এরা কারা? উত্তরে তিনি বললেনঃ “এরা হচ্ছে আপনার উম্মতের ঐ সব লোক যারা অপরের দোষ অন্বেষণ করে বেড়াতো।”
এরপর আমরা দ্বিতীয় আকাশে আরোহণ করলাম। সেখানে আমি একজন অত্যন্ত সুদর্শন লোককে দেখলাম। তিনি সুদর্শন লোকদের মধ্যে ঐ মর্যাদাই রাখেন যেমন মর্যাদা রয়েছে চন্দ্রের তারকারাজির উপর। জিজ্ঞেস করলামঃ ইনি কে? জবাবে হযরত জিবরাঈল আ. বললেন, “ইনি হলেন আপনার ভাই ইউসুফ আ.” তাঁর সাথে তাঁর কওমের কিছু লোক রয়েছে। আমি তাদেরকে সালাম করলাম এবং তারা আমার সালামের জবাব দিলেন।
তারপর আমরা তৃতীয় আকাশে আরোহণ করলাম। আকাশের দরজা খুলে দেয়া হলো। সেখানে আমি হযরত ইয়াহইয়া আ. ও হযরত যাকারিয়াকে আ. দেখলাম। তাদের সাথে তাঁদের কওমের কিছু লোক ছিল। আমি তাদেরকে সালাম করলাম এবং তারা আমার সালামের উত্তর দিলেন।
এরপর আমরা চতুর্থ আকাশে উঠলাম। সেখানে হযরত ইদ্রীসকে আ. দেখলাম। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আমি তাকে সালাম করলাম। তিনি আমার সালামের জবাব দিলেন।
অতঃপর আমরা পঞ্চম আকাশে আরোহণ করলাম। সেখানে ছিলেন হযরত হারুন আ.। তাঁর শ্মশ্রুর অর্ধেকটা সাদা ছিল এবং অর্ধেকটা কালো ছিল। তাঁর শ্মশ্রু ছিল অত্যন্ত লম্বা, তা প্রায় নাভী পর্যন্ত লটকে গিয়েছিল। আমার প্রশ্নের উত্তরে হযরত জিবরাঈল আ. বললেন, “ইনি হচ্ছেন তাঁর কওমের মধ্যে হৃদয়বান ব্যক্তি হযরত হারুন ইবনু ইমরান আ.। তাঁর সাথে তাঁর কওমের একদল লোক ছিল। তারাও আমার সালামের উত্তর দেন।
তারপর আমরা আরোহণ করলাম ষষ্ঠ আকাশে। সেখানে আমার সাক্ষাৎ হলো হযরত মুসা ইবনু ইমরানের আ. সঙ্গে। আমি হযরত জিবরাঈলকে আ. জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, ইনি হচ্ছেন হযরত মুসা ইবনু ইমরান আ.। তার পার্শ্বেও তার কওমের কিছু লোক ছিল। তিনিও আমার সালামের জবাব দিলেন।
তারপর আমরা সপ্তম আকাশে উঠলাম। সেখানে আমি আমার পিতা হযরত ইবরাহীম খলীল আ.-কে দেখলাম। তিনি স্বীয় পৃষ্ঠ বায়তুল মা’মুরে লাগিয়ে দিয়ে বসে রয়েছেন। জিজ্ঞেস করে আমি তাঁর নামও জানতে পারলাম। আমি সালাম করলাম এবং তিনি জবাব দিলেন। আমি আমার উম্মতকে দু’ভাগে বিভক্ত দেখলাম। অর্ধেকের কাপড় ছিল বকের মত সাদা এবং বাকী অর্ধেকের কাপড় ছিল অত্যন্ত কালো। আমি বায়তুল মামুরে গেলাম।
সাদা পোশাকযুক্ত লোকগুলি সবাই আমার সাথে গেল এবং কালো পোশাকধারী লোকদেরকে আমার সাথে যেতে দেওয়া হলো না। আমরা সবাই সেখানে নামায পড়লাম। তারপর সবাই সেখান হতে বেরিয়ে আসলাম। এই বায়তুল মামুরেই প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা নামায পড়ে থাকেন। কিন্তু যারা একদিন নামায পড়েছেন তাঁদের পালা কিয়ামত পর্যন্ত আসবে না। অতঃপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় উঠিয়ে নেয়া হলো। যার প্রত্যেকটি পাতা এতো বড় যে, আমার সমস্ত উম্মতকে ঢেকে ফেলবে।” তাতে একটি নহর প্রবাহিত ছিল যার নাম সালসাবীল। এর থেকে দু’টি প্রস্রবণ বের হয়েছে। একটি হলো নহরে কাওসার এবং আর একটি নহরে রহমত। আমি তাতে গোসল করলাম। আমার পূর্বাপর সমস্ত পাপ মোচন হয়ে গেল।
এরপর আমাকে জান্নাতের দিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আমি একটি হুর দেখলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কার? উত্তরে সে বললো, “আমি হলাম হযরত যায়েদ ইবনু হারেসার। সেখানে আমি নষ্ট না হওয়া পানি, স্বাদ পরিবর্তন না হওয়া দুধ, নেশাহীন সুস্বাদু শরবত এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মধুর নহর দেখলাম। সেখানে ডালিম ফল বড় বড় বালতির সমান ছিল। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাঁর সৎবান্দাদের জন্যে ঐ সব নিয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছেন যা কোন চক্ষু দর্শন করে নাই, কোন কর্ণ শ্রবণ করে নাই এবং কোন অন্তরে কল্পনাও জাগে নাই।
অতঃপর আমার সামনে জাহান্নাম পেশ করা হলো, যেখানে ছিল আল্লাহ তাআলার ক্রোধ, তার শাস্তি এবং তাঁর অসন্তুষ্টি। যদি তাতে পাথর ও লোহ নিক্ষেপ করা হয় তবে ওগুলিকেও খেয়ে ফেলবে। এরপর আমার সামনে থেকে ওটা বন্ধ করে দেওয়া হলো।
আবার আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছিয়ে দেয়া হলো এবং ওটা আমাকে ঢেকে ফেললো (সিদরাতুল মুনতাহা হলো একটি রহস্যময় বরই গাছ। যা সপ্তাকাশে অবস্থিত)। সেখানে আমার ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হলো। আর আমাকে বলা হলো, “তোমার জন্যে প্রত্যেক ভাল কাজের বিনিময়ে দশটি পূণ্য রইলো। তুমি যখন কোন ভাল কাজের ইচ্ছা করবে, অথচ তা পালন করবে না, তথাপি একটি পূণ্য লিখা হবে। আর যদি করেও ফেল তবে দশটি পূর্ণ লিপিবদ্ধ হবে। পক্ষান্তরে যদি কোন খারাপ কাজের ইচ্ছা কর, কিন্তু তা না কর তবে একটিও পাপ লিখা হবে না। আর যদি করে বস তবে মাত্র একটি পাপ লিখা হবে।”
আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে রাসূল সা.-এর কাছে নির্দেশ করা হয়, যাতে তাঁর উম্মতের উপর প্রত্যহ দিনরাত্রে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়। যখন তিনি সেখান হতে নেমে আসেন তখন হযরত মূসা আ. তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে আপনি কি হুকুম প্রাপ্ত হলেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “দিন রাত্রে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায।” হযরত মূসা আ. এ হুকুম শুনে বললেন, “এটা আপনার উম্মতের ক্ষমতার বাইরে। আপনি ফিরে যান এবং কমানোর জন্যে প্রার্থনা করুন।” তাঁর একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা. জিবরাঈলের আ.-এর দিকে পরামর্শ চাওয়ার দৃষ্টিতে তাকান এবং তিনি ইঙ্গিতে সম্মতি দান করেন।
তিনি পুনরায় আল্লাহ তাআলার নিকট গমন করেন এবং স্বস্থানে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেন, “হে আল্লাহ! হালকা করে দিন। এটা পালন করা আমার উম্মতের সাধ্য হবে না।” আল্লাহ তাআলা তখন দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ফিরে আসলেন। হযরত মূসা আ. আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “কি হলো?” জবাবে তিনি বললেনঃ “দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন।” একথা শুনে হযরত মূসা আ. তাঁকে বললেন, “যান, আরো কমিয়ে আনুন।” এভাবে কমিয়ে পাঁচে নামানো হলো।
শেষে যখন পাঁচ ওয়াক্ত বাকী থাকলো তখন ফেরেশতার মাধ্যমে ঘোষণা করা হলো, “আমার ফরজ পূর্ণ হয়ে গেল এবং আমি আমার বান্দার উপর হাল্কা করলাম। তাকে প্রত্যেক সৎ কাজের বিনিময়ে দশটি পূণ্য দান করা হবে।” এর পরেও হযরত মুসা আ. আমাকে আল্লাহ তাআলার নিকট ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমি বললাম, এখন আমাকে আবারও যেতে লজ্জা লাগছে। এরপর আমি আবার কাবায় ফিরে এলাম।”
পরদিন সকালে হযরত মুহাম্মদ সা. মক্কার জনগণের সামনে এই সব বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তিনি গত রাত্রে বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছেছেন, তাঁকে আকাশ সমূহে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তিনি এটা, ওটা দেখেছেন। তখন আবু জাহেল ইবনু হিশাম বলতে শুরু করে, “আরে দেখো, বিস্ময়কর কথা শুনো! আমরা উটকে মেরে পিটে দীর্ঘ এক মাসে বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে থাকি। আবার ফিরে আসতেও এক মাস লেগে যায়, আর এ বলছে যে, সে দু’মাসের পথ এক রাত্রেই অতিক্রম করেছে!”
রাসূলুল্লাহ সা. তখন তাকে বললেন, “শোন, যাওয়ার সময় আমি তোমাদের যাত্রীদলকে (মক্কার ব্যবসায়ীদল) অমুক জায়গায় দেখেছিলাম। অমুক রয়েছে অমুক রঙ এর উটের উপর এবং তার কাছে রয়েছে এইসব আসবাবপত্র।” আবু জেহেল তখন বললো, খবর তো তুমি দিলে, দেখা যাক, কি হয়?”
তখন তাদের মধ্যে একজন বললো, “আমি বায়তুল মুকাদ্দাসের অবস্থা তোমাদের চাইতে বেশী জানি। মুকাদ্দাসের ইমারত, ওর আকৃতি, পাহাড় হতে ওটা কাছাকাছি হওয়া ইত্যাদি সবই আমার জানা আছে। সুতরাং আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, মুহাম্মদ আমাকে বাইতুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে বলুন। ওটা কেমন দেখতে?
আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহর সা.-এর সামনে বায়তুল মুকাদ্দাসকে হাজির করে দিলেন। তিনি এর গঠনাকৃতি এই প্রকারের, ওর আকার এইরূপ এবং ওটা পাহাড় থেকে এই পরিমাণ নিকটে রয়েছে ইত্যাদি সব বলে দিতে লাগলেন। ঐ লোকটি একথা শুনে বললো, “নিশ্চয়ই আপনি সত্য কথাই বলছেন।” অতঃপর সে কাফিরদের সমাবেশের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো, “মুহাম্মদ নিজের কথায় সত্যবাদী।”
এই ঘটনা যখনই কেউ শুনেছে তখন সে বিস্ময়বোধ করেছে ও প্রথমেই বিশ্বাস করতে চায়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন আবু বকর রা.। তিনি শোনামাত্রই বিশ্বাস করলেন নবী সা.-এর কথা। এজন্য তিনি সিদ্দিক উপাধি লাভ করেন।
আর এই ঘটনা মিরাজের ঘটনা নামে পরিচিত। মিরাজ মানে হলো আরোহন করা। ইসলামী পরিভাষায় নবীজি সা.-এর উর্ধাকাশে আরোহন করাকে মিরাজ বলে। অনেকে এটাকে আত্মিক ও স্বপ্নে ভ্রমণ বলে থাকেন ও বিশ্বাস করেন। তবে আল্লাহর রাসূল সা. এমনটা বলেননি। যখন মক্কার মুশরিকরা এই বর্ণনা নিয়ে হাসাহাসি ও ইয়ার্কি করা শুরু করলো তখনো রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহ চাইলে বহু দূরত্বের পথ মুহূর্তেই পাড়ি দেওয়া যায়। যদি বিষয়টা শারীরিক ভ্রমণ না হয়ে আত্মিক হতো তবে অবশ্যই মুশরিকদের জবাবে রাসূল সা. তা বলতেন। কারণ তারা দূরত্বে বিষয়টাকেই হাইলাইট করে ইয়ার্কি করেছিল। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতে বিশ্বাস হলো মহানবী সা. শারিরীকভাবেই মসজিদুল আকসা ও আকাশে ভ্রমণ করেছিলেন।
মিরাজের ঘটনা নিয়ে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা বানী ইসরাঈলের ১ম আয়াত নাজিল করেছেন। সেখানে তিনি বলেন, //পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি। যাতে আমি তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।//
মিরাজের রাতে নবী করিম সা. ও তাঁর উম্মতের জন্য কয়েকটি জিনিস প্রদান করা হয়—
প্রথমত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; যা প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছিল।
দ্বিতীয়ত, তাঁর উম্মতের যেসব ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, আল্লাহ তাঁর পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন।
তৃতীয়ত, সূরা আল-বাকারার শেষাংশ।
চতুর্থত, সূরা বনি ইসরাইলের ১৪ দফা নির্দেশনা। মহানবী (সা.) মেরাজ থেকে ফিরে আসার পর সুরা বনি ইসরাইলের মাধ্যমে ১৪টি দফা মানুষের সামনে পেশ করেন। বর্তমান সময়ে ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ সংস্কারে এই ১৪ দফা বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কারও শরিক না করা, ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করা, ৩. আত্মীয়স্বজন, এতিম ও মুসাফিরের হক মেনে চলা, ৪. অপচয় না করা, ৫. অভাবগ্রস্ত ও প্রার্থীকে বঞ্চিত না করা, ৬. হাত গুটিয়ে না রেখে সব সময় কিছু দান করা, ৭. অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা না করা, ৮. দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা না করা, ৯. ব্যভিচারের নিকটবর্তী না হওয়া, ১০. এতিমের সম্পদের ধারেকাছে না যাওয়া, ১১. যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তা অনুসন্ধান করা, ১২. মেপে দেওয়ার সময় সঠিক ওজন পরিমাপ করা, ১৩. প্রতিশ্রুতি পালন করা, ১৪. পৃথিবীতে দম্ভভরে চলাফেরা না করা।
Discussion about this post