ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে ঢাকার মগবাজারের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে সোমবার (২২ আগস্ট)। ২০১৬ সালের এই দিনে তাঁকে ধরে যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরপর থেকে তার আর খোঁজ মিলেনি। পরিবারের সদস্যদের অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না। তাঁকে ধরে নিয়ে গুম করার এই দিনটিকে স্মরণ করে তাঁর ছোট ভাই সালমান আল-আযামী ভাইকে ফেরত চেয়ে লিখেছেন আমার দেশ-এ। অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য হুবহু লেখাটি তুলে ধলা হলো:
তাঁর অপরাধ কি ছিল? আজ থেকে ঠিক ছয় বছর আগে আমার প্রিয় ভাইটিকে তারা জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গেল। এরপর আর কোন হদিস নেই। আমাদের মা অপেক্ষা করতে করতে বিদায় নিলেন এই দুনিয়া থেকে। তাঁর সন্তানরা অপেক্ষা করছে কবে বাবাকে দেখবে। কিন্তু মানুষের অন্তরের কান্না যাদের পাষাণ হৃদয়কে গলাতে পারেনা, তাদের কাছে আর কি আশা করা যায়? প্রতিটি মুহূর্তে অনেক প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরপাক খায়- তিনি কি বেঁচে আছেন? কেমন আছেন? কোথায় আছেন? কি করছেন? সম্প্রতি নেত্র নিউজের একটি প্রতিবেদনে জানতে পারলাম ডিজিএফআই এর অধীনে কচুক্ষেতে আয়নাঘর নামক এক গোপন বন্দীশালায় তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে। ঐ অভিশপ্ত যায়গা থেকে মুক্তি পাওয়া দুজনের মধ্যে একজন তাঁকে স্বচক্ষে দেখেছেন। তারা এও বলেন যে সেখানে বন্দীদের উপর অকথ্য নির্যাতন করা হয় এবং তাদের আর্তনাদের আওয়াজ সর্বক্ষণ পাওয়া যায়। শুনে আঁতকে উঠলাম! আমার ভাইয়ের সাথে তারা কেমন আচরণ করে? মানুষ কেন এত নিষ্ঠুর হতে পারে আমার বুঝে আসেনা? তাদের মনের মধ্যে কি কোন মায়া নেই? এত মানুষের কষ্ট তাদের বুকে আঘাত করেনা? তাদের নিজেদের পরিবার নেই? তারা বোঝেনা বিনা কারণে পরিবার থেকে দুরে রাখা কত গর্হিত একটি কাজ? তারা কি মুসলমান? আল্লাহ্কে ভয় করে? পরকালে বিশ্বাস করে? তারপরও কিভাবে নির্বিকার থাকে? কিভাবে পারে আমার ভাই ও ব্যারিস্টার আরমানসহ শত শত পরিবারকে প্রিয়জন হারানোর এই ব্যথা দিতে?
মনে পড়ে ২২শে আগস্ট ২০১৬ এর সেই ভয়াবহ দিনের কথা। হঠাৎ ফোন আসল যে সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের ৩০/৪০ জনের একটি দল আমাদের বাসায় আক্রমণ করে, ত্রাস সৃষ্টি করে, বাড়ীর কেয়ারটেকারকে মারধোর করে, আম্মা ও ভাবীকে হুমকি দিয়ে, ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে তালাশ করে, অবশেষে আমার চতুর্থ ভাই সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে চোখ বেধে ধরে নিয়ে যায়। ফোনে ভাবীর সেই আর্তনাদ এখনও আমার কানে বাজে। আম্মাতো কথাই বলতে পারছিলেননা। এরপর কত প্রচেষ্টা, কত লোকের কাছে ধরনা দেয়া, কত যায়গায় ছোটাছুটি করা – কোন কিছুতে কোন লাভ হলোনা। পুলিশ সাধারণ ডায়েরী পর্যন্ত নিলোনা। পরিবারের মুখপাত্র হিসেবে আমি বিশ্বের বড় বড় পত্রিকা, রেডিও ও টিভিতে কত সাক্ষাৎকার দিলাম। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথে কত কথা বললাম। এ দেশের এম পি ও মন্ত্রীদের কাছে চিঠি লিখলাম। শেখ হাসিনার ভাগ্নি যিনি এখানকার সংসদ সদস্য, তাঁর কাছে চিঠি লিখলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলনা। ভাইটিকে ফিরে না পাওয়ার ব্যথা আমরা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। কেউ আমাদের কথা শোনেনা। কারো কাছে আমাদের কান্না পৌছেনা। কারো বিবেকে নাড়া দেয়না।
আমার এই ভাইটি ছিলেন আব্বা-আম্মার একমাত্র হাতের লাঠি। আমাদের কাউকে ওরা দেশে যেতে দেয়না, তাই তাঁর একার উপর দায়িত্ব পড়ে আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মার দেখাশুনা করার। খুব সুন্দরভাবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। আব্বা জেলে যাওয়ার পর থেকে আম্মাকে কিভাবে সামলেছেন তা আমরা সবাই জানি। তাঁর ত্রিশ বছরের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবনের অবসান হয় অপমান ও লাঞ্ছনামূলক বরখাস্তের মাধ্যমে যার কোন কারণ পর্যন্ত ওরা দেখায়নি। কিন্তু এতে তিনি দমে যাননি। চেষ্টা করেছেন স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে। ওরা তাও করতে দিলোনা। এরপর পুরো সময় নিয়োজিত করলেন আব্বা-আম্মার সেবায়। আব্বার ইন্তেকালের পর ছয় ভাইয়ের দায়িত্ব তিনি একা পালন করলেন, কারণ ওরা আমাদের দেশে যেতে দেয়না। এরপর আম্মাকে আগলে রাখলেন। কিন্তু আম্মার সামনে দিয়েই তাঁকে ওরা নিয়ে গেল। সাড়ে তিন বছরের আকিফা আর দেড় বছরের আফিফের ভীত চেহারা ওদের একটুও হৃদয় কাঁপলোনা। নিয়ে গেল ভাইটিকে সবার চোখের সামনে দিয়ে। এরপর প্রায় তিন বছর আম্মা বেঁচে ছিলেন । অপেক্ষা করতেন কবে তাঁর প্রিয় সন্তান মায়ের কোলে ফিরে আসবে। আমাদের সাথে কথা বলার সময় তাঁর ডুকরে কেঁদে ওঠার মুহূর্তগুলি মনে পড়লে ভীষণ মুষড়ে পড়ি। আম্মা বলতেন, “আমার কবর বোধ হয় তোমরা কেউ দিতে পারবেনা।” আমরা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করতাম এবং আশা প্রকাশ করতাম যে তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু তা আর হলোনা। আম্মা তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে আল্লাহ্র কাছে চলে গেলেন। এমন হতভাগা মা দুনিয়ায় কয়জন আছে যে ছয়টি সন্তান থাকার পরও মৃত্যুর সময় কাউকে কাছে পেলেননা – কেউ তাদের মাটি পর্যন্ত দিতে পারলনা!
জানিনা ওরা আম্মার ইন্তেকালের খবর তাঁকে দিয়েছিল কিনা বা কিভাবে দিয়েছিল। আমরা সব ভাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি, কিন্তু জানিনা তিনি কিভাবে এ সংবাদ সহ্য করলেন। তিনিতো কাঁদার জন্য কোন কাঁধও পেলেন না।
মাসখানেক আগে তাঁর বড় মেয়ের যমজ দুটো ফুটফুটে ছেলে ঘুরে গেল আমাদের বাসা। ওরা ভীষণ আদুরে ও চঞ্চল। ওরা কি ওদের নানার কোলে উঠবেনা? নিজের নানাকে দেখেনি, আমাকেই তারা নানা বলে আপন করে নিয়েছিল। তাঁর বড় ছেলে তাঁর মতোই সুপুরুষ হয়ে গড়ে উঠেছে মাশা আল্লাহ্। সম্প্রতি তাঁর মেজ মেয়ে অনার্স পরীক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছে। সন্তানদের সাফল্যে অংশীদার হওয়ার অধিকার তিনি পেলেন না। কিন্তু বেশী চিন্তা হয় ছোট দুজন নিয়ে। ওরা বাবা বাবা করে, কিন্তু বাবাকে আর পায়না। এত ছোট বয়সে কচি মনে ওদের যে আঘাত লেগেছে, তা তিনি ফিরে না আসলে কিভাবে ঠিক হবে?
মনে পড়ে ১৯৮৪ সালের কথা যখন তাঁর সাথে চট্টগ্রাম ও মাইনিমুখে কত চমৎকার তিনটি সপ্তাহ কাটিয়েছিলা। দেশে যতদিন ছিলাম, তিনি যখন যেই সেনানিবাসে ছিলেন, সবখানে গিয়েছি। নিজের চোখে দেখেছি অফিসার ও সিপাহী নির্বিশেষে সবাই তাঁকে কত ভালবাসত। তাঁর আচরণে সবাই কত মুগ্ধ ছিল। তাঁর মতো অফিসারের সান্নিধ্য পাওয়ায় তারা নিজেদের ধন্য মনে করত। কিন্তু আজ কেউ তাঁর কথা বলেনা। কারো সাহস নেই প্রতিবাদ করার। কেউ নেই বলার যে তাঁর মতো ব্রিলিয়ান্ট অফিসারের সাথে এমন আচরণ আমাদের সেনাবাহিনীর সাথে অসদাচরণের সমকক্ষ
প্রশ্ন হচ্ছে ওরা কেন তাঁকে নিয়ে গেল? ওরাতো জানত তিনি কেমন ছিলেন। আমার আব্বাকে ওরা অন্যায়ভাবে নিয়ে গেল। কোন অপরাধ প্রমাণ ছাড়াই ৯০ বছরের সাজা দিল। তারপর সেখানেই তাঁর মৃত্যু হল। এতেও ওদের সাধ মিটলোনা? শুধুমাত্র গোলাম আযমের সন্তান হওয়ার অপরাধে তাঁকে তারা এভাবে নিয়ে গেল, অথচ তিনি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। একটি রাষ্ট্র নিজের সেনাবাহিনীর এত ব্রিলিয়ান্ট একজন অফিসারের সাথে কিভাবে এমন আচরণ করতে পারে? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এই দেশে আর কতদিন চলবে?
জানিনা এই প্রতীক্ষায় আমাদের আর কতদিন থাকতে হবে, কতদিন সন্তানরা বাবার অপেক্ষায় প্রহর গুনবে, ছোট্ট শিশুরা কবে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে, যমজ দুই নাতী কবে ওদের নানার আদর পাবে। এর কোন জবাব কেউ কি আমাদের দিতে পারবে? মানুষের মৃত্যু হলে তাঁকে কবর দিয়ে দোয়া করা যায়। জেলে থাকলে তাঁর সাথে দেখা করা যায়। কিন্তু এ কেমন এক পরিস্থিতি যেখানে বেঁচে আছে কিনা তা জানারও উপায় নেই? এ কেমন অবিচার? আর কতদিন চলবে এই অপেক্ষার পালা?
আয়নাঘর নিয়ে নেত্র নিউজের প্রতিবেদনকে ধন্যবাদ জানাই। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাও গুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। এগুলো আমাদের আশাবাদী করলেও যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের ভাইকে ফেরত না পাব ততদিন আমাদের দুর্দশার কোন পরিবর্তন হবেনা। আমাদের যাওয়ার যায়গা একটাই, তাই মহান প্রভুর কাছেই আমরা হাত পাতি, মাথা নত করি, আর্জি করি। মহান রব যেন আমার এই ভাইটিকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন ও তিনিসহ গুম হওয়া সকল পরিবারের প্রিয়জনদের তাদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
Discussion about this post