আওয়ামীলীগের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এটা ছিল বাঙালি জাতির জন্য ট্রাজেডি। এর ২৬৭ বছর আগেই একই দিনে আরেকটি ট্রাজেডি ঘটে মুর্শিদাবাদে। এদিন বাংলা পলাশীর যুদ্ধ জিতে বাংলা দখলে নেয় ইংরেজরা। সেই থেকে আমাদের জিল্লতি শুরু। আজ আওয়ামী লীগ গঠনের প্রক্রিয়া ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করবো।
আওয়ামী লীগ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ছাত্রলীগ গঠন। তাই প্রথমে সেই বিষয়টিই সামনে আনি। ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর দেশে একটিই ছিল উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল। আর সেটা মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের বাংলা অংশের দুই শীর্ষ নেতা হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। নাজিমুদ্দিন ছিলেন ঢাকার নেতা আর সোহরাওয়ার্দি কলকাতার নেতা। হিন্দুস্থান ভাগ হলে কলকাতা ভারতের অংশে পড়ে। ফলশ্রুতিতে জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দি ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। ঢাকায় তার প্রভাব তেমনটা ছিল না।
যেহেতু তিনি ছিলেন বাঙালি তাই তিনি বাংলায় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। সেজন্য তিনি তার অনুগত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কলকাতার ছাত্রদের একটা অংশকে ঢাকায় অবস্থান নিতে বলেন। বাংলায় তথা উপমহাদেশে মুসলিমদের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির গোড়া পত্তন করেন জিন্নাহ।
১৯৩২ সালে ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত করে মুসলিম লীগ। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নির্দেশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন ‘অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ’ গঠন করেন। বাংলায় নাম ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর এবং জিন্নাহর নেতৃত্বে বাংলায় মুসলিম লীগের বিস্তার ঘটলে ছাত্ররা মুসলিম লীগ নেতাদের অনুগামী হয়ে ওঠে। কলকাতায় ইস্পাহানি ও ঢাকায় খাজাদের ভবনগুলি ছাত্রদের ওপর মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ মুসলিম স্টুডেন্টস লীগই পূর্ববাংলার মুসলিম ছাত্রদের ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করে। ঢাকার নবাব ছিলেন সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক। মুসলিম স্টুডেন্টস লীগই পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক যোগদান নিশ্চিত করেছিল।
স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। এর নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। শেখ মুজিবরা ছাত্রদের ওপর থেকে শাহ আজিজের প্রভাব কাটাতে চেয়েছেন। তাই তারা এই দল ভেঙে আরেকটি ছাত্রসংগঠন করার কথা ভাবছিল। এখানে আদর্শের কোনো ইস্যু ছিল না। বরং সোহরাওয়ার্দি ও খাজা নাজিমুদ্দের দন্দ্ব কাজ করেছে। অন্যদিকে তখন কমিউনিস্টদের ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। বাংলায় ছাত্রদের মধ্যে এর ভালো বিস্তার হয়েছিল। তারাও চেয়েছে আরেকটি সংগঠন করতে। বামরা আগে থেকেই সংগঠিত হতে চেষ্টা করেছিল। এদের গুরু ছিল লাল মাওলানা হামিদ খান ভাসানী ও কলকাতার আবুল হাশিম।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলিম লীগের বামধারার কর্মীদের উদ্যোগে ঢাকায় ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। এ সংগঠনের আহ্বায়ক মনোনীত হয় ঢাকার মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় কর্মী কামরুদ্দিন আহমদ। এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। তারা মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন এবং এ দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিচর্চার চিন্তা করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পরবর্তী কাজ কী হবে তা আলোচনার জন্য কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে সমবেত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী), কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রমুখ। তারা পাকিস্তানে বাম সমাজতন্ত্রী রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার জন্য উপযুক্ত সংগঠন তৈরি করা দরকার বলে একমত হন। ঢাকায় এসে তারা কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ, তসন্দুক আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, নূরুদ্দীন আহমদ, আবদুল ওদুদ, হাজেরা মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং রাজনৈতিক কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য একটি সম্মেলন আয়োজনের ব্যাপারে একমত হন।
ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি বাম সংগঠন তখনো ছিল। কিন্তু কমিউনিস্টদের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে মুসলমান ছাত্ররা তাতে যোগ দিতে চাইতেন না।
মুসলমান ছাত্ররা অনেকেই এত দিন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এর সভাপতি শামসুল হুদা চৌধুরী রেডিও পাকিস্তানে চাকরি নেন। সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের অনুসারী ছিলেন। কাউন্সিল সভার মাধ্যমে এই সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা তেমন ছিল না। কারণ বেশিরভাগই ছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের অনুসারী। কলকাতার মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের অনুসারী তরুণ ও ছাত্ররা নতুন একটি ছাত্রসংগঠন তৈরির কথা ভাবলেন। এই উদ্দেশ্যে তারা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে একটি ছাত্র-কর্মী সভা ডাকেন।
ঘটনাচক্রে ওই দিন ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক নাজমুল করিম সেখানে উপস্থিত হলে তাকে সভাপতি করে সভার কাজ শুরু হয়। সবাই একমত হয়ে সেদিন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার মানে আগের দলের অল বেঙ্গল নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করেছে মাত্র। দুই দলেরই কমন নাম মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। রাজশাহী থেকে আসা নইমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যের একটি অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়িয়ে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে প্রথম কমিটির অন্যতম সদস্য অলি আহাদের ভাষ্য হলো, শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকায় ছিলেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সাংগঠনিক কমিটিতে তাহার অন্তর্ভুক্তি তিনি সানন্দেই গ্রহণ করিবেন এবং তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা অনীহা প্রকাশ না করিয়া বরং সংগঠনকে দৃঢ় ও মজবুত করার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিলেন উল্লেখ্য যে অধুনা অনেকেই শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা। বলিয়া প্রচার করিতেছেন ইহা ইতিহাসের বিকৃতি মাত্র। ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের তরুণ কর্মীরা মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ করেছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিস করা হলো এখানেই। শেখ মুজিব কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে এখানেই থাকতেন। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে : ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভেতর আমি প্রায় সব জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমুদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সবকিছুই আমাকেই করতে হতো। নতুন একটি ছাত্র সংগঠন তৈরির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে ১৯৪৮ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আবেদন শিরোনামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করা হয়। অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির ১৪ সদস্যের নামে প্রকাশিত প্রচারপত্রে ধারণা দেওয়া হয়, ছাত্রসংগঠনে কোনো অছাত্র থাকতে পারবে না এবং ছাত্রসংগঠন দলীয় রাজনীতিতে অংশ নেবে না।”
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করার সময় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ মুসলিম শব্দটি সংগঠনের নামের সঙ্গে ব্যবহার করার বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম’ শব্দটি রাখার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, ওই মুহূর্তে এটা রাখা দরকার। তা না হলে মুসলিম লীগ সরকার তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবে। এ জন্য কেউ কেউ শেখ মুজিবকে সাম্প্রদায়িক বানানোরও চেষ্টা করেছেন। যদিও শেখ মুজিব এটা কৌশল হিসেবেই নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার মত ছিল : এখনো সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই যায়-আসে না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হলো পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।”
এভাবে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানে শুরু থেকেই এলাকাগত দ্বন্দ্ব ও বামাদর্শের লোকেরা জাতিকে বিভক্ত করতে থাকে। এর প্রাথমিক কার্যক্রম হিসেবে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ ভেঙে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন হয়। সারাদেশে বাঙালির স্বার্থ দেখা ও মুসলিমদের উম্মাহ চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহী করে তোলে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগে উগ্র জাতিবাদী ও কমিউনিস্টদের সম্মিলন হতে থাকে।
ছাত্রলীগ ভেঙে সফলতা পাওয়ায় মুসলিম লীগের বড় নেতারা এবার নিজেরাই মুসলিম লীগ ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করে। অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম ও হামিদ খান ভাসানী এবার মুসলিম লীগ ভাঙার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। ১৯২৪ সালে মুসলিম উম্মাহর আবেগের স্থান ও উম্মাহ চেতনার কেন্দ্রবিন্দু তুর্কি খিলাফত ভেঙ্গে যায়। ১৯৪৭ সালে আবার একই চেতনার ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান গঠিত হয়। কিন্তু ক্ষমতাবাদী, জাতিবাদী ও কমিউনিস্টদের প্ররোচনায় সেই উম্মাহ চেতনার বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। এই বিকৃতির অগ্রনায়ক ছিল সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম ও হামিদ খান ভাসানী। আর তাদের পাইলট প্রজেক্ট ছিল ছাত্রলীগ।
Discussion about this post