স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচনসহ সকল নির্বাচনেই মূলত প্রশাসন এবং পুলিশ প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে মূল ভুমিকায় থাকে প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন। প্রশাসন ক্যাডার হচ্ছে একটি বহুমাত্রিক সার্ভিস। সচিবালয় থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত একটি চেইন অব কমান্ডে প্রশাসন ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। মাঠ প্রশাসনের সর্বোচ্চস্তরে থাকেন বিভাগীয় কমিশনার। তাঁর অধীনে জেলা প্রশাসকগণ কাজ করেন। আর জেলা প্রশাসক তাঁর অধীনস্থ উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং এ্যাসিল্যান্ডদের মাধ্যমে পুরো জেলা নিয়ন্ত্রণ করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এবং সহকারি কমিশনার (এ্যাসিল্যান্ড), রাজস্ব সম্মেলন, সমন্বয় সভাসহ অন্যান্য মিটিংয়ে মাসে অন্তত: ২-৩ বার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আসতে হয়। এসব মিটিং গুলোতে সাধারণত জেলা প্রশাসক সভাপতিত্ব করেন। এছাড়াও কোন উধ্বতন কর্মকর্তা জেলায় পরিদর্শনে এলেও মাঠ প্রশাসনের উল্লেখিত কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকতে হয়।
ইলেকশনের তখনো প্রায় দুইমাস বাকী। জেলা প্রশাসক মিটিংয়ে আগত ইউএনওদের তাঁর খাস কামরায় নিয়ে নির্বাচন পরিকল্পনা লিখিত আকারে জানাতে বলেন। পরিকল্পনা বলতে তিনি আসলে কি বোঝাচ্ছেন তা আমাদের বোধগম্য ছিল না। কারন, জেলা প্রশাসক জানতেন আমি অন্যায্য কিছু করার লোক নই। ইউএনওদের সাথে জেলা প্রশাসকদের একান্ত আলাপচারিতায় সাধারণত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণ উপস্থিতি থাকতেন সচরাচর। তবে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জেলা প্রশাসকদের সাথে এই মিটিং গুলোতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের রাখা হতো না।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছিল জেলা প্রশাসক এভাবেই আমাদের নিয়ে বারংবার খাস কামরায় যাচ্ছিলেন। তিনি আমাদের নির্দেশ দিলেন প্রতিটা কেন্দ্র পরিদর্শন করতে। ভোটকেন্দ্র থেকে ফলাফলসহ প্রিসাইডিং অফিসারদের আসার ক্ষেত্রে কোন রিস্ক থাকলে তা এসেস করতে বলতেন। আমাদের মধ্যে দু/একজন ইউএনও অতি উৎসাহী হয়ে কাজ করছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের প্রতি এতটাই অনুরক্ত যে, জেলা প্রশাসককে গোপন বুদ্ধি দেয়ার জন্য এমনকি আমাদের আড়ালে কথা বলতেন। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছিল, মাঠের পরিস্থিতি ততই বেগতিক হচ্ছিল। আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম উধ্বতন কতৃপক্ষ অন্যায্য কিছু করার দিকে আগাচ্ছেন। যদিও ড. কামাল হোসেন এবং বিএনপি নেতারা তখনো আশাবাদী কথাবার্তা বলছিলেন। তবে এটা অনস্বীকার্য্য যে প্রশাসনের ভেতরে কি হতে যাচ্ছে তারা সেটা আঁচ করতে পারেননি!
নির্বাচনের মাস খানেক আগে থেকেই শুরু হল কেন্দ্র ভিত্তিক প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারি প্রিজাইডিং অফিসারসহ অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরির কাজ। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক নির্দেশ দিয়েছিলেন এই তালিকা তৈরীতে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সাহায্য নিতে। আমি আর রিস্ক নেয়ার সাহস করছিলাম না। ভয় ছিল পাছে যদি আমাকে নিয়ে আবার কোন রকমের সন্দেহয় তৈরি হয়! এমনিতেই জেলা প্রশাসক খুব অবিশ্বাস করছিলেন অধিনস্থ কর্মকর্তাদের। নির্বাচনী কর্মকর্তা অর্থাৎ কেন্দ্র ভিত্তিক প্রিজাইডিং ও সহকারি প্রিজাইডিং অফিসারের তালিকা তৈরির কাজটি আমি বাধ্য হয়েই আওয়ামী লীগের স্থানীয় উপজেলা সেক্রেটারির নিকট হস্থান্তর করি। কারন, জেলা প্রশাসক স্পেসিক্যালি বলেছিলেন, তালিকাটি তাঁকে দিয়ে তৈরি করাতে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছিল স্থানীয় এমপি জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করেছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারিকে দিয়ে প্রিজাইডিং ও সহকারি প্রিজাইডিং অফিসারের তালিকাটি তৈরি করার জন্য। এই তালিকায় মূলত: স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিরাই পিজাইডিং ও সহকারি প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কারন প্রতিটি কেন্দ্র প্রিজাইডিং অফিসারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ব্যালট পেপার ও ও ব্যালট বাক্স আগেরদিন তাঁকেই বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণেই থাকে। অপরদিকে স্থানীয় থানার ওসি নিজেও এ তালিকা ভ্যাটিং করে দিয়েছিলেন তাঁর উধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশে। অর্থাৎ উপজেলা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারির মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তৈরি করা প্রিজাইডিং ও সহকারি প্রিজাইডিং অফিসারের তালিকা নির্ভরযোগ্য কি না সেটা নিশ্চিত করা হয় স্থানীয় ওসির মাধ্যমে। এই তালিকা তৈরির করজ করতে গিয়ে আমার আর বুঝতে বাকী রইল না আওয়ামী লীগ সরকার আসলে কি করতে যাচ্ছে!
আমার উপজেলার অধিনস্থ থানায় ওসি সাহেব ব্যক্তিগতভবে ভাল লোক ছিলেন। নির্বাচনী কর্মকর্তার তালিকায় ত্রুটি আছে কিনা সেটা যদিও তিনি পরীক্ষা করছিলেন, তবে একাজ গুলো যে তিনি উর্ধতন কতৃপক্ষের নির্দেশে করছেন সেটাও আমাকে জানান। এমনকি একদিন তিনি উপজেলার সকল ইউনিয়নে বিএনপির কোন কোন নেতা নির্বাচনে ভুমিকা রাখতে পারেন তার একটি তালিকা নিয়ে আমার অফিসে আসলেন। তিনি জানালেন, উপরের নির্দেশ রয়েছে। এই তালিকা ধরে সবাইকে এরেষ্ট করতে হবে। আমি বলেছিলাম, যেভাবে আপনার উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ চাইবে, সেভাবেই কাজ করতে হবে। তিনিও আমার কথার সাথে একমত পোষণ করে বলেছিলেন, কাজটা খুবই খারাপ করতেছি। কিন্তু আমার ত কিছুই করার নেই। আমি হচ্ছি শুধু উপরের হুকুম তামিল কার মালিক। এই তালিকা ধরে গ্রেফতারে পুলিশ বাণিজ্য করছিল যা অনেকেই জানেন। বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের শরীক দলের যাকেই সামনে পাচ্ছিল, পুলিশ তাঁকে ধরছিল তখন। পুলিশের ছিল পোয়াবার। এই উছিলায় তারাও কিছু টাকা পয়সা কামিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে গ্রেফতার এড়াতে অনেক নিরীহ মানুষ তখন পুলিশকে টাকা দিতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ওসি সাহেবের একদিনের কথা আমার চির ষ্মরণীয় হয়ে থাকেব। তিনি আমার সামনে মোবাইল ফোনে তাঁর অধীনস্থ সহকর্মীকে বলছিলেন, “দেখ তোমাদেরও পরিবার রয়েছে। এত অন্যায় করার আগে একটু ভেবে দেখ”। এখানে সমস্যা হচ্ছিল মাঠ প্রশাসনের প্রতিটি অফিসারই তখন কঠিণ গোয়েন্দা নজাদারিতে ছিলেন। প্রতিদিনই অফিসার তোলে নেয়া হচ্ছিল মাঠ প্রশাসন থেকে। বিশেষ করে যাকে অবিশ্বস্থ মনে করা হত, বা যার অতীত পর্যালোচনা করে সরকারের মনে হত এদের দিয়ে নির্বাচনে সরকারি ফর্মূলা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না, তাঁকেই মাঠ প্রশাসন থেকে সরিয়ে নেয়া হত। ওসি সাহেব সতর্ক ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যাতে কেউ অভিযোগ না করেন সে দিকে। এজন্যই তাঁর অধিনস্থকে নরম সূরে বলছিলেন বলে মনে হয় তখন। প্রায় প্রতি রাতেই ওসি সাহেব হুট করেই আমার বাসায় চলে আসতেন তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে। বেশিরভাগ সময় আমি শুধু চুপ করে শুনতাম। এখানে বলে রাখা ভাল, ওসি সাহেবর খবর আমার মাধ্যমে নিতেন পুলিশ সুপার। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পুলিশ সুপার এ খবর নেয়ার চেষ্টা করতেন। আবার ওসির মাধ্যমে আমার খবর নিতেন জেলা প্রশাসক। সেই ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের হয়ে ওসির মাধ্যমে খবর সংগ্রহ করতেন পুলিশ সুপার। আমরা দুইজন এ বিষয়ে খুবই সতর্ক ছিলাম এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলাম।
এদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছিল, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে উত্তেজনাও বাড়তেছিল। বিএনপি যেখানেই নির্বাচনী প্রচারণার জন্য মিটিং বা মিছিলের কর্মসূচি দিচ্ছিল, আওয়ামী লীগও একই জায়গায় কর্মসূচি দিতে শুরু করে। এক্ষেত্রে বিএনপি প্রার্থী আমার নিকট অভিযোগ করেন। এবিষয়ে করনীয় জানতে উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু রিটানিং অফিসারের নিকট থেকে কোন সদুত্তর পাইনি। এমনকি একদিন নির্বাচনী প্রচারণার সময় বিএনপি প্রার্থী প্রচন্ড আক্রমনের শিকার হন। এক্ষেত্রেও ওসি সাহেব ঘটনাস্থলে ফোর্স পাঠাননি। সন্ধ্যায় ওসি সাহেব আমার বাসায় এসে সব খুলে বললেন। এমনকি আওয়ামী লীগ থানার সামনেই বিএনপি প্রার্থী ও তাঁর কর্মীদের ওপর আক্রমণ করতে চেয়েছিল। ওসি তাতে বাধা দেন। এতে দূরে গিয়ে তারা আক্রমণ করে। এবিষয়ে ওসির ভাষ্য হচ্ছে, উধ্বতন কতৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল নির্লিপ্ত থাকতে। এভাবেই স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেয়ে নির্বাচনের মাঠ থেকে নিজেদের ভোটের আগেই ঘুটিয়ে নেয়।
ইউএনও সাহেব বিজিবি’র ভুমিকা সম্পর্কেও আলোকপাত করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে অনেককে আশাবাদি হতে দেখছিলাম। তারা বলছিলেন, বিজিবি নামলে হয়ত: পরিস্থিতি ঘুরে দাড়াবে! নির্বাচনের ১০-১২ দিন আগে উপজেলায় আগত বিজিবি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার (মেজর) আমার সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করেন। তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। আমি অবশ্য একটু কৌশল অবলম্বন করি। তাঁর কাছে কোন তথ্য আছে কি না সেটা বরং জানতে চাইলাম। এতে মনে হল, তারা অনেক তথ্য যোগাড় করেই এসেছেন। যেদিন বিজিবি আসে উপজেলায়, সেদিনই ওই বাহিনীর এক ব্রিগেডিয়ার ডিপ্লয়মেন্ট দেখতে আসেন। তিনি এসেই আমাদের (উপজেলা প্রশাসন) সকলকে নিয়ে বৈঠক করেন। তাঁর সাথে বৈঠকটি এযাবতকালে জীবেরন সেরা বৈঠকই বলা চলে। তিনি বেশ খোলামেলাভাবেই বলছিলেন, আগামী ১০ বছর বিএনপি’র কোন সুযোগ নেই। এরপর দেশের গতি প্রকৃতি যেদিকে যাবে, সে অনুযায়ী রাজনীতি আগাবে। বিএনপি’র বিগত সরকারের সময়ে অযোগ্যতার অভিযোগ করেন। এজন্য তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের তিরস্কার করলেন বেশ খোলামেলা ভাবে। বৈঠকে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলনে, বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা গুলো তারেক রহমানের প্রতিদিনের কার্যক্রম যোগাড় করে। এমনকি তাঁর বাসার অভ্যন্তরে কি হয়, তাও তারা মনিটর করে। আমার তখন বুঝতে বাকি রইলনা বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা বলতে কোন দেশের কথা বুঝাচ্ছেন ব্রিগেডিয়ার সাহেব। এ কথাগুলো তিনি বলছিলেন, নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য লন্ডনে যাদের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয় তাদের গ্রেফতার প্রসঙ্গ টেনে। মিটিং শেষে বের হয়ে তিনি সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে আবারো ক্ষমতায় আনার জন্য সৈনিকদের সহযোগিতা চাইলেন। তিনি সৈনিকদের মনে করিয়ে দিলেন, শেখ হাসিনার সরকার তাদের জন্য কি কি করেছে। আমি পাশে দাড়িয়ে যথারীতি শুনছিলাম এবং চেহারায় যেন কোন রকমের অভিব্যক্তি না আসে সেদিকে নিজের প্রতি লক্ষ্য রাখছিলাম। এর দুদিন পর এলাকায় বিএনপি’র কাদের গ্রেফতার করা দরকার বিজিবির স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার আমার কাছে জানতে চাইলেন। তখন আমি এ বিষয়ে ওসি সাহেবের সাথে কথা বলার জন্য তাঁকে পরামর্শ দেই। ওসি আমার সাথে পরামর্শ করে তালিকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। তখন আমি বিজিবি কমান্ডারকে অনুরোধ করি পুলিশের সঙ্গে একসাথে মুভ করতে। ইতোমধ্যে আমার কাছে খবর আসল বিজিবি’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডার আওয়ামী লীগের এমপি’র সাথে দেখা করেছেন। এবং এমপি’র পক্ষ থেকে তাঁকে ২০ লক্ষ টাকা দেয়ার খবরও পাওয়া যায় তখন। নির্বাচনের পর বিশ্বাসযোগ্য সূত্র গুলো থেকে জানতে পারি এই টাকার ভাগ তাঁর উর্ধ্বতন কতৃপক্ষকেও দেয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, ওই কমান্ডার আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত্ব নিয়েই তিনি এখানে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন।
নির্বাচনের সেনাবাহিনীর ভুমিকা সম্পর্কে উপজেলা নির্বাহী ওফিসারের অভিজ্ঞতাও তোলে ধরেন। তাঁর বর্ণনায় বলা হয়, নির্বাচনের পূর্বে ঢাকা সহ সারা দেশই ছিল গুজবের শহর। বিশেষত সেনাবাহিনী নিয়ে গুজব ছিল বেশি। আর্মি চীফ প্রকাশ্যে কিছু না বলায় গুজব ডালপালা মেলছিল বেশ। এ সময় খবর পেলাম সেনা সদর দফতরে এইচ টি ঈমাম সাহেব গিয়েছেন। আর্মি অফিসারদের সাথে মিটিং করেছেন। এ ব্যাপারে বিশ্বস্থ সূত্রে জানতে পারলাম, কিছু অফিসার মিটিংয়ে সেনাবাহিনীকে দুষ্কর্মে না জড়ানোর বিষয়টি তুলেছিলেন। বিডিআর হত্যাকান্ডের সঠিক বিচার কেন হচ্ছে না সেটা তারা তখন তারেক সিদ্দিকীর (শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা) কাছে জানতে চান। এদিকে বিশ্বস্থ সূত্রটি জানায়, জেনারেল আকবর একমাত্র ব্যক্তি যিনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় সরাসরি অবস্থান নেন। শেখ হাসিনাকে আনা ব্যতিত কম্প্রমাইজ করতে রাজি হননি। যই হউক, নির্ধারিত দিনে সেনাবাহিনী আমার উপজেলায় এসে পৌছায়। সেনাবাহিনীর যেই কর্মকর্তা আসার আগে থেকেই আমার সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন, তিনি ফোনে বলছিলেন যে, হেডকোয়ার্টার থেকে সিগন্যাল না আসলে তারা রওয়ানা দিবেন না। এর তিন দিন পর তারা যখন আসলেন তখন আসলে পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। তখন পরিস্থিতি পুরোপুরি আওয়ামী লীগ ও পুলিশের নিয়ন্ত্রনে চলে গিয়েছিল। কারন ইতোমধ্যে বিএনপি’র প্রভাবশালী নেতারা হয় জেলে ঢুকে গেছেন, নতুবা নিজের জীবন রক্ষার তাগিদে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। নির্ধারিত সময়ে আর্মিকে মাঠে না নামিয়ে নির্বাচনের ৪-৫ দিন আগে নামানো একটা কৌশল ছিল বলে আমার মনে হয়েছে তখন। যাতে তারা কার্যকর কোন ভুমিকা না রাখতে পারে সে ব্যবস্থা করেই সেনাবাহিনী মাঠে নামানো হয়। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায়, আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না। কারন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলা হয়েছিল কোন গোপনীয় তথ্য সেনাবাহিনীর সাথে শেয়ার করা যাবে না।
একদিন বিএনপি প্রার্থী আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি আর্মির কামান্ডারেরর সাথে কথা বলতে চান। আমি তখন আর্মি কমান্ডারের নাম্বার দেই যোগাযোগ করার জন্য। কিছুক্ষনের মধ্যেই আর্মির কমান্ডার ফোন করে আমাকে জানান যে, তাঁর উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ তাঁকে বলেছেন, কেউ তাদের কাছে আসলে তাদেরকে ইউ এন ও’র কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিতে।এটা শোনার পর যা কিছু বোঝার সেটা আর বাকী থাকল না। এখানে জানিয়ে রাখা ভাল, আর্মির এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে আমি এও খবর পেয়েছিলাম, জেলায় অবস্থানরত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা টাকা খেয়েছেন। এ বিষয়টি পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের মুখেও শুনেছিলাম! তবে আমার উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা টাকা খাননি, সেটা আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম।
আরো পড়ুন: রাতেই পূর্ণ ব্যালট বাক্স, তিন সিটিতে ভোটের নামে যা হচ্ছে
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব গোয়েন্দা সংস্থা গুলোর ভুমিকা নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, বলে রাখা ভলো, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই গোয়েন্দা সংস্থা গুলোতে নিজের দলীয় চিন্তায় বিশ্বাসী লোকদের নিয়োগ দিয়ে আসছিল। এর ফলে, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) সেনা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি), ক্রিমিমিনাল ইনিভেষ্টিগেশন বিভাগ (সিআইডি) থেকে শুরু করে সব গোয়েন্দা বিভাগ গুলো নিয়ে সরকারকে আর বেশি ভাবতে হয়নি নির্বাচনের আগে। নির্বাচনের ৪দিন আগে সকল গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, আর্মি, বিজিবি, র্যাব-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের নিয়ে আমার রুমে মিটিং হয়। মিটিংয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের দিন কোন বাহিনীর অবস্থান কোথায় থাকবে এবং কার কি ধরনের ভুমিকা থাকবে। পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার জানতে পারলাম তারা প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মোবাইল টিম মোতায়েন করবে এবং এই টিমের কাজ কি সেটা শুধু তারা জানবে। তাদের সাথে কোন ম্যাজিষ্ট্রেট বা অন্য কোন বাহিনীর সহযোগিতা লাগবে না বলে জানাল। তখন বুঝতে আর বাকী রইল না, এ টিম সীল মারার কাজটি তদারকি করবে। মিটিংয়ে প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান নিয়ে কথা বলছিলেন। তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে পেশাদার খুনির ভুমিকা পালন করছি! বিজিবি, আর্মি এবং এনএসআই’র অফিসারগণ চুপ করে শুধু শুনছিলেন। তবে ডিজিএফআই’র অফিসার টুকটাক কথা বলছিলেন। এতে আমার মনে হয়েছিল, পুরো সেনাবাহিনী পুলিশের অধিনে চাকুরি করার দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচনের মাঠে এসেছে! একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শুধু বলে যাচ্ছিলেন, আর বাকী সবাই শুধু এতে সায় দিয়ে জি জি করছিলেন। তবে, আমার উপজেলার এসি ল্যান্ড কিছু মতামত দেয়ার চেষ্টা করছিলেন তখন। কিন্তু তাঁর মতামত কেউ শোনেননি। যাই হউক সকল বিষয়াদি আবারো প্রয়োজনবোধে আমার সাথে যোগাযোগ করবে জানিয়ে অফিসাররা সকলে বিদায় নেন।
নির্বাচনের আগ মূহুর্তের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব বলেন, নির্বাচনের ঠিক দু’দিন আগে জেলা প্রাশসক এবং পুলিশ সুপারের সাথে আমার এবং ওসি সাহেবের মিটিং ডাকা হয়। আমি আঁচ করছিলাম আমার নির্লিপ্ততা জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারকে খুব ভাবাচ্ছিল। আবার অন্যান্য ওসিদের চেয়ে আমার ওসিও একটু ব্যতিক্রম ছিলেন। আমরা দু’জনই নির্বাচনে অবৈধ টাকা পয়সা থেকে দূরে ছিলাম। যা আমাদের প্রতি সন্দেহ তৈরির যথেষ্ট কারন হয়ে দাড়িয়েছিল তখন। পরে জানতে পারলাম ডিজিএফআই প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে ইউএনও (আমি) এবং ওসি কম সক্রিয়। তাই এ মিটিং ডাকা হয়েছে। মিটিংয়ে যাওয়ার আগে আমি আর ওসি সাহেব নিজেদের মাঝে আলোচনা করে গিয়েছিলাম। ওসি বলছিলেন, মিটিংয়ে তিনি-ই বলবেন, এ পর্যন্ত কি করা হয়েছে। ওই মিটিংয়ে বলা হল, আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়। তখন আগের রাতে সীল মারার জন্য ব্যবস্থা করতে ডিসি এবং এসপি’র পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হল। মিটিং থেকে বের হয়েই আমি ও ওসি সাহেব স্থানীয় আওয়ামী লীগের এমপি’র সাথে যোগাযোগ করি। তিনি রানিং এমপি এবং নির্বাচনে প্রার্থী। তাঁকে কোন একটি গোপন জায়গায় আসতে অনুরোধ করি।
এমপি সাহেব তাঁর ভাইকে নিয়ে আসেন। তিনি এবং তাঁর ভাইসহ আমাদের মিটিং হয়। মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরের দিন নির্ধারিত কেন্দ্র গুলোর প্রিজাইডিং অফিসারদের ডেকে টাকা ধরিয়ে দেয়া হয়, এবং বলা হল রাতের মধ্যেই ৩০% সীল মেরে ফেলতে হবে। এ বিষয়টি মনিটর করে জানানোর দায়িত্ব নেন ওসি সাহেব। নির্বাচনের দিন ভোর হওয়ার আগেই মধ্যরাতে ওসি সাহেব আমাকে জানান, ৩ জন প্রিজাইডিং অফিসার সীল মারছেন না। সেই কেন্দ্র গুলোতে লোক পাঠাই কেন সীল মারলেন না, সেটা জানতে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে লোক পৌছানর আগেই ওই ৩ জন প্রিজাইডিং অফিসার সীল মারা শুরু করে দিয়েছেন। মধ্য রাতে বিএনপি’র স্থানীয় এক নেতা ফোন করেন। তিনি জানান, তাদের কেন্দ্রে রাতেই সীল মারছে প্রিজাইডিং অফিসারের সহযোগিতায়। তিনি অনুরোধ করলেন এ ব্যাপারে যেন ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি দেখছি বলে, আমি ফোন রেখে দেই। এই প্রথম কোন অন্যায় শোনার পরও ব্যবস্থা নিতে না পারার যন্ত্রণা আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দিচ্ছিল।
মনের কষ্টে নির্বাচনের আগের রাতটি ছটফট করতে থাকি। ভোরের দিকে ঘুমানোর চেষ্টা করি। ভোট তখনো শুরু হয়নি তখনো। একজন মহিলা প্রিজাইডিং অফিসার ফোন করলেন। তাঁর ফোনে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফোন রিসিভ করতেই জানালেন, সীল মারতে না দিলে, তাঁর গায়ে হাত তোলার হুমকি দিয়েছেন এমপি’র ছেলে। তৎক্ষণাৎ রওয়ানা দেই সেই কেন্দ্রে। সেনাবাহিনীকেও অনুরোধ করি সেখানে যেতে। মহিলাকে সাহস যুগিয়ে আশ্বস্থ করে ফিরে আসি। নির্বাচনের দিন এই চেহারা কাউকে দেখাতে চাচ্ছিলাম না। তাই সেখান থেকে আবারো বাসায় ফিরে আসি। দিনের বেলায় উপজেলার কর্মকর্তারা অনুরোধ করেন অফিসে অন্তত হাজির থাকতে। তারা অনুরোধ করেন সকালের নাস্তা অন্তত তাদের সাথে যেন খাই। দুপুরে ১২টা থেকেই প্রিজাইডিং অফিসাররা আপডেট জানিয়ে ফোন দিথে শুরু করেন। প্রায় সবাই জানান, ১২টার মধ্যে তাদের কেন্দ্র গুলোতে ৮৫-৯০% ভোট কাস্ট হয়ে গেছে। পরবর্তী করণীয় জানতে চান তারা। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখন। উপায় না পেয়ে, দুপুরের খাবার ও জোহরের নামাজের বিরতি দেয়ার জন্য বলি সবাইকে। দুপুরের পর অবশ্য আর কোন ভোটার তেমন যায়নি কেন্দ্রে। ততক্ষণে ভোটাররাও জেনে গেছে ভোটের নামে কি ঘটছে। কিছু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অতিরিক্ত তেলবাজি করতে গিয়ে নিজের প্রভাবিত কেন্দ্র গুলোতে ১০০% ভোট কাস্ট করে ফেলেন। সন্ধ্যায় ভোট গণনার রেজাল্ট মিলিয়ে দেখি ৯৬% ভোট কাস্ট হয়ে গেছে। অত:পর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নানা ক্যারিকেচার করে কাস্টিং হিসাব ৮৩%-এ নামিয়ে নিয়ে আসি।
নির্বাচন পরবর্তী অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, নির্বাচন শেষ হলে ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তা তাঁর ইন্সপেক্টরকে নিয়ে আমার অফিস রুমে আসেন। তিনি আমার সামনে আক্ষেপ করছিলেন। দীর্ঘ একটা নি:শ্বাস ছেড়ে বললেন, ইউ এন ও সাহেব এটা কি গয়ে গেল নির্বাচনের নামে! আমি তখন উত্তরে বলেছিলাম, যদি প্রফেশনাল হয়ে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করতম, তখন তো আপনারাই আমার নামে রিপোর্ট দিতেন। তিনি তখন হেসে বলছিলেন, আমরা যাও একটু এসব নিয়ে বলছি, আমাদের সিনিয়ররা এনিয়ে টু শব্দ করতেও রাজি নন। আমার তখন বুঝতে বাকি ছিল না, গত ১০ বছরে সেনাবাহিনীর মেরুদন্ড কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! ডিজিএফআই-এর কর্মকর্তা খুব সোহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আমার নিকট থেকে বিদায় নিলেন। কেন জানি মনে হচ্ছিল তিনি আমার মনের কষ্ট গুলো অনুভব করতে পেরেছিলেন। এবং আমার প্রতি খুব সহানুভুতিশীল ছিলেন। হতে পারে আমার নামে নির্লিপ্ততার রিপোর্ট দিয়ে তিনি অপরাধবোধে ভুগছিলেন।
ডিজিএফআই-এর অফিসার চলে যাওয়ার পর এমপি সাহেবের ভাই আসেন আমার অফিসে। তিনিও একই আলাপ শুরু করেন। বললেন, এত ভোটের কি দরকার ছিল! এটা খুবই দৃষ্টিকটু লাগবে মানুষের কাছে! এরকম নানা কথা বলতে থাকেন তিনি। তিনি জানালেন, এরকম ভোট কাস্টিং হবে আগেই অনুভব করছিলেন। তাই তার নিজের লোক দিয়ে কিছু ভোট ধানের শীষে মারিয়েছেন। তখন দেখা যায় ধানের শীষে সীল মারার জন্য অনেক কেন্দ্রে অবশিষ্ট ব্যালট নেই। সব শেষে রাতে বাসায় চলে আসি এক বুক হতাশা নিয়ে।
ফলাফল ঘোষণার পর থেকে কয়েকদিন ছিল সরকারি চাকুরি জীবনে আমার সবচেয়ে বাজে সময়। অপরাধবোধ প্রতি মূহুর্তে আমাকে যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। অফিসে যেতে ইচ্ছাই করছিল না। জীবনের প্রথম উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার মত একজন তরুণ কর্মকর্তাকে দিয়ে সরকার এমন বাজে কাজ কেন করল তা আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অথচ, আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বারবার আশ্বস্থ করছিলেন এই বলে-‘আমরা তোমাদের দিয়ে কোন অন্যায় করাব না’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন অন্যায় এবং অবৈধ কাজে আমাদের জড়িয়েই ছাড়লেন উর্ধ্বতনরা।
নির্বাচনের অভিজ্ঞাতা নিয়ে আমার পাশ্ববর্তী উপজেলার ইউএনও’র সাথে কথা বলি। তারাও জানালেন একই অভিজ্ঞতার কথা। একই মানসিক অবস্থার কথা জানালেন তারাও। একজন ইউএনও জানালেন, তাঁর উপজেলায় এসিল্যান্ড ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছাত্র লীগের নেতাও ছিলেন এক সময় ওই এসিল্যান্ড। কিন্তু এমন অনৈতিক কাজ করে তার এতই অপরাধবোধ হচ্ছিল যে সেই এসিল্যান্ড নাকি ৩দিন বাসা থেকে বের হননি।
ঢাকার এক ব্যাংক কর্মকর্তা যিনি একটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। ডিবির এএসপি’র চাহিদা অনুযায়ী আগের রাতে ব্যালটে স্বাক্ষর করতে রাজি হচ্ছিলেন না তিনি। অত:পর ডিবি’র এসএসপি সাহেব তাঁকে কলার চেপে ধরেন। তখন বিশ্রি ভাষায় গালি দিয়ে বলেন, শালা হিন্দু রাজাকারের বাচ্ছা! এমন পরিস্থিতিতে তিনি ব্যালটে স্বাক্ষর না দিয়ে রাতে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যান।
আর্মির এক মেজর বন্ধু নির্বাচনের এক সপ্তাহ আমাকে হোয়াটঅ্যাপে ফোন দেন। তিনি জানান, তাঁর অধিনস্থ এক সৈনিক নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে ফিরে তাঁর সামনে এসে কাঁদছিলেন। কারন হিসাবে জানায়, নির্বাচনের দিন এক প্রবীন ভোটার বলছিলেন, তাঁর ভাবনায় ছিল সেনাবাহিনী আসলে তারা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন এবং নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন। কিন্তু সেনাবাহিনী আসার পরও কিছুই হল না। নিজের ভোটটি দিতে পারেনি ওই বৃদ্ধ প্রবীন। ওই মেজর বন্ধু আরো জানান, সিনিয়র অনেকেরই মন খারাপ। কারন প্রতিবার নির্বাচন শেষে ফেরার সময় সাধারণ মানুষ তাদেরকে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচন থেকে ফিরে আসার সময় কেউ তাদের প্রতি হাত নেড়ে বিদায় জানায়নি। বরং সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের ঘৃনার বহি:প্রকাশ দেখা গেছে!
এই ছিল একজন উপজেলা নির্বাহনী অফিসারের ভোট নিয়ে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার জবানবন্দি। এই জবানবন্দি থেকে নির্বাচনের নামে কিভাবে মানুষের সাথে প্রহসন করা হয়েছে তাঁর একটি সার্বিক চিত্র পাওয়া যায়। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের জবানবন্দি হাতে আসার পর চেষ্টা করেছিলাম পুলিং বা প্রিজাইডিং অফিসারের অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্য। তবে কেউ এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হন না। পরিচিতজনদের মধ্য থেকে একজন পুলিং অফিসার রাজি হলেন। তিনি খুব সংক্ষেপে ৭০০ ওয়ার্ডে তাঁর অভিজ্ঞতা লিখে পাঠালেন। সেটি হুবহু তোলে ধরা হল পাঠকদের জন্য। তবে তাঁর শর্ত হল সব রকম পরিচিতি গোপন রাখতে হবে। সেজন্য তাঁর সব রকম পরিচয় এখানে উহ্য রাখা হল।
(২০১৮ সালের নির্বাচনের পরই উপজেলা নির্বাহি অফিসার নিজের অভিজ্ঞতা লিখে পাঠিয়েছিলেন আমার দেশ পত্রিকায়। লেখাটি আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান এর বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে সংযুক্ত করে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অভিজ্ঞতাটি পাঠকদের সুবিধার্থে হুবহু তুলে ধরা হলো।)
Discussion about this post