আজ একটি ভিন্নধর্মী বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। বিষয়টি হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে মুসলিম সভ্যতার যে বিরাট জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্যি-সংস্কৃতি বিদ্যমান, বাঙালি মুসলমান হিসেবে আমরা তার কতটুকু জানি বা জানার চেষ্টা করি, সেখানে আমাদের অবদানই বা কতটুকু। আরবি আমাদের ভাষা নয়, তাই মুসলিম সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলতে যাওয়া বিরাট ধৃষ্টতা। তবুও কিছু অনুবাদসাহিত্য পুঁথিপত্র পড়ে যৎসামান্য জানতে পেরেছি তাই বলতে ইচ্ছে হলো।
ফিরে যাই পনেরো শ’ বছর আগের আরবে। ধুধু বালির প্রান্তর। ওপরে অসীম নীল আকাশ। চারিদিকে ছোট-বড় পাহাড়ে ঘেরা লোকালয়। মাঝে মধ্যে উর্বর মরূদ্যান। খেজুর বাগানসহ গৃহপালিত পশু ও মানুষের বসবাস। জলাভূমিকে কেন্দ্র করে লোকালয় এবং চারণক্ষেত্র। উল্লেখ্য, এর ওপরে লেগে আছে গোত্রে গোত্রে লড়াই-যুদ্ধ। দিন-মাস পেরিয়ে বছরের পর বছর ধরে। ছিল বিনোদন, নাচ-গান, কবিতা ও সাহিত্য। যুদ্ধের উন্মাদনাকে আগুনের মতো ছড়িয়ে দিতে উৎসাহিত করে গান, কবিতা আর নূপুরের ছন্দ। নিজ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করতে রচিত হতো বীরগাথা। শত্রুকে ঘায়েল করতে লেখা হতো হিংসা-বিদ্বেষমিশ্রিত কাব্য-মহাকাব্য। মৃত্যুতে রচিত হতো শোকগাথা। প্রাক রাসূল সা:-এর যুগের আরব ছিল এমনি এক কাব্যচর্চার অফুরন্ত ভাণ্ডার। জন্মেছিল ইমরুল কায়েসের মতো বিশ্বখ্যাত কবি।
রাসূলে করিম সা:-এর আবির্ভাবের সাথে সাথেই পরিবর্তিত হতে শুরু হলো মক্কার সার্বিক প্রেক্ষাপট। মক্কাজুড়ে শুরু হলো সত্য-মিথ্যার আপসহীন সংগ্রাম। সুন্দর-অসুন্দরের চূড়ান্ত যুদ্ধ। তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের ওপর নিরঙ্কুশ আস্থা নিয়ে আবর্তিত হতে শুরু হলো ইসলাম কবুলকারী মানুষদের চিন্তা-চেতনা, আত্মোপলব্ধি, দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ। অবতীর্ণ হলো মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। মানব জাতির জীবনচক্রের শুরু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত যত কল্যাণকর দিক আছে, তার পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা।
সৃষ্টির সূচনাতেই মানুষের আবেগ-অনুভূতি তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করতে থাকে। মুখের ভাষার মাধ্যমে আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, প্রেম-আলপনা, সুখ-দুঃখের যে স্বত্বঃস্ফূর্ত প্রকাশ নেই সাহিত্য, তাই গান, তাই কবিতা। কবি সাহিত্যেকেরা কোথাও তাদের কাব্যচর্চা দিয়ে জাতিকে সত্য সুন্দর অর্থবহ জীবনের সন্ধান দিয়েছে, আবার কোথাও বা তাদের কাব্যপ্রতিভা জাতিকে দ্রুত পাপ-পঙ্কিলতার অতল গহ্বরে ডুবিয়ে দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে সূরা শোয়ারায় মহান আল্লাহ কবিদের সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছেন-
‘এবং কবিদের অনুসরণ করে যারা, তারা বিভ্রান্ত। তুমি কি দেখো না যে তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং অমন কথা বলে যা তারা করে না। তবে তাদের কথা, ‘স্বতন্ত্র যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎ কর্ম করে, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ (আয়াত-২২৫-২২৭)
এ আয়াত তিনটি নাজিল হওয়ার পর রাসূল সা:-এর সাহাবা কবিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত সাহাবা কবি ইসরত হাসমান বিন সাবিত হজরত আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা এবং হজরত কা’ব ইবনে মালিক ক্রন্দনরত অবস্থায় উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের প্রশ্ন একটিই আমাদের এখন কি হবে?
রাসূল সা: তাদের সান্ত্বনা দেন এবং আয়াত তিনটির ব্যাখ্যায় বলেন- আয়াতগুলোর প্রথমাংশে মুশরিক, মুনাফিক, কবিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং শেষাংশে তৎকালীন সমাজে ব্যতিক্রমীদের জন্য বলা হয়েছে। ব্যতিক্রমী বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা আল্লাহতে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছে, সৎকর্ম করে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। এরপর ঈমানদার কবিরা সন্দেহাতীতভাবে আল-কুরআনের দেয়া নির্দেশনাবলি অনুযায়ী কাব্য রচনায় ও কাব্যচর্চায় অধিকতর মনোনিবেশ করেন।
রাসূল সা:-এর সাহাবাদের কাব্য রচনায় যারা সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন তাদের নাম- (১) হজরত হাসমান বিন সাবিত (রা.), (২) হজরত আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা.), (৩) হজরত কা’ব বিন মালিক, (৪) হজরত আল নাবিগাহ ওরফে আবু লাফলা, (৫) হজরত আমান বিন মিরদাস, (৬) হজরত সুহহিমরা। মহিলা সাহাবিদের মধ্যে যারা কবিতা রচনা করতেন তাদের মধ্যে হজরত ফাতেমাতুজ জোহরা, হজরত খানসা ও হজরত নাবিখাজাদীর নাম প্রসিদ্ধ।
এ ছাড়াও খোলাফায়ে রাশেদিনের মধ্যে হজরত আবু বকর সিদ্দীক, হজরত উমর ফারুক ও হজরত আলী ইবনে আবি তালিবের নাম উল্লেখযোগ্য। হজরত আলী রা: ইতিহাস বেত্তা ও পত্রসাহিত্যে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাকে জ্ঞানের দরজা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
উল্লিখিত সাহাবাদের কাব্যচর্চা ইসলামের জন্য ছিল মহা-প্রেরণার উৎস।
খন্দকের যুদ্ধ সমাগত। আল্লাহর রসূল সা: মুহাজিদ ও আনসারদের সাথে অবলীলায় মাটি কাটছেন। বহন করছেন। পেটে পাথর বাঁধা মুখে কবিতা :
হে আল্লাহ, জীবন তো আখিরাতের জীবন নিশ্চয়
মুহাজির আনসারদের ক্ষমা করো ওগো দয়াময়
আনসার-মুহাজিররা এর উত্তর দেন এভাবে-
যতদিন আমাদের থাকবে হায়াত
মুহাম্মদের হাতে জিহাদের করিলাম বায়াত।
অপূর্ব কাব্যচর্চা। একদিকে আল্লাহর রাসূল সা: কবিতার মাধ্যমে গুনাহ মাফের আরিজ নিয়ে হাত উঠিয়েছেন অপর দিকে আনসার মুহাজিররা মুহাম্মদ সা:-এর হাতে জিহাদের বায়াত নিচ্ছেন কবিতা উচ্চারণ করে।
মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। বিজয়ী বেশে জগতের শ্রেষ্ঠ মানব-মানবতার মুক্তি দূত সিজদারত অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ করছেন এ ¯¦র্ণময় মুহূর্তে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা: উটের রশি ধরে হাঁটছেন। কণ্ঠে তার ধ্বনিত হচ্ছে ইসলামের শাশ্বত আহ্বান-
‘কাফির তোয়া শোনরে ওরে পথ ছেড়ে দে,
সকল ভালো রাসূল মাঝে। নে লুটে নে।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা: মুতার যুদ্ধে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন। যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগ মুহূর্তে তিনি একটি কবিতা আবৃত্তি করেন, যার অর্থ নিম্নরুপ :
‘কসম খেয়ে বলছি, হে ইবনে রাওয়াহা
এই ময়দানে তোমাকে নামতেই হবে।
তোমাকে কেন জান্নাত সম্পর্কে নিষ্পৃহ দেখছি?
হজরত রাওয়াহার মতো সাহাবাদের জীবন-মরণের ‘ফয়সালা হতো কবিতায় ঠিকানা-হতো জান্নাত।
মুতার যুদ্ধ ফেরত সেনাদলের কাছে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার শাহাদতের সংবাদ শুনে কবি হাসসান বিন সাবিব একটি কবিতা রচনা করেন ও আবৃত্তি করেন-
বন্ধুর স্মৃতি আমার চোখে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়েছে,
বস্তুত; স্মৃতিই হলো কান্নার উদ্দীপক।
তার এ কবিতার জাদুময় প্রভাবে উপস্থিত সাহাবিরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
হুদাইবিয়ার সন্ধির পর হজরত খুবাইব রা: মক্কায় আটক অবস্থায় কয়েক দিন অমানবিক নির্যাতনের পর তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়।
‘মুসলিম হয়ে মরতে যাচ্ছি আমার কিসের ভয়
আল্লাহর পথে মরব যখন চাই নাক দিক নির্ণয়।’
কবিতা আবৃত্তি শেষ হতেই তিনি শহীদ হয়ে যান। এভাবেই জীবনে-মরণে, হাসি-আনন্দে, শোকে-দুঃখে সদা সর্বদা কাব্যচর্চা পরিলক্ষিত হয় সাহাবাদের জীবনে।
হজরত কা’ব বিন মালিক রা: খাইবার যুদ্ধের সময় তার রচিত কবিতা আবৃত্তি করে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মাঝে মধ্যেই সাহাবা কবিরা রাসূল সা:-কে ঘিরে বসে কবিতা আবৃত্তি করতেন। কবি আন-নাবিগাহ রচিত একটি কবিতার সামান্য অংশ নিম্নরুপ :
‘মর্যাদা ও মহিমায় আমরা পৌঁছেছি নীলাগ্র ভেদ করে।
আরো চাই, তারো ঊর্ধ্বে দেখা যাক
আমাদের বিজয় নিশান।
তৎকালীন মহিলা কবি খানসা রা:-কে তিনি প্রায়ই কবিতা শোনাতে বলতেন। খানসার রা: চার ছেলে উহুদ যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। মায়ের কবিতা-তার সন্তানদের শাহাদতের আকাক্সাকে ও তৃষ্ণাকে এমন একপর্যায়ে নিয়ে যায় যে তারা শহীদ হয়ে মায়ের কোলে ফিরে আসেন।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মৃত্যুতে যখন আকাশ এবং পৃথিবীবাসী শোকে দিশাহারা, যখন প্রিয় হারানোর, অভিভাবক হারানোর বেদনায় গোটা সৃষ্টি মুহ্যমান তখন কবি হাসসান বিন সাবিত রচনা করে চলেন একের পর এক শোকগাথা। তার এ শোকগাথা সাহিত্যের মাপকাঠিতেও অনন্য সাধারণ।
কবি হাসসান আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন :
‘হে শ্রেষ্ঠমানব, আমি ঝরনার মধ্যে ছিলাম।
কিন্তু এখন আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছি।’
তিনি আরো বলেছেন : ‘হে চোখ তোমার কি হয়েছে যে ঘুমাচ্ছ না?
মনে হচ্ছে যেন তাতে সুরমা লাগানো হয়েছে?’
বিমূর্ত এ শোকের এ প্রকাশ ভঙ্গি আজকের দিনেও অনন্য সাধারণ।
রাসূল সা:-এর সাহাবিদের কাব্যচর্চা আলোচনা কোনো সঙ্কীর্ণ ও সীমিত জ্ঞান নিয়ে সম্ভব নয়। আরবি ভাষায় আমাদের অজ্ঞতার কারণে কাব্যের প্রকৃত স্বাদ-রস আস্বাদন ও কাব্যিক মূল্যায়ন অসম্ভব। অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে কখনো প্রকৃত কাব্য-সৌন্দর্য ধরাছাঁয়া যায় না, তার ছায়াটুকুই শুধু পাওয়া সম্ভব। সাহাবায়ে কিরামদের কবিতার ভাব-ভাষা ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল। উপমা, রূপক, শব্দ চয়ন, শব্দ বিন্যাস ছিল অসাধারণ। ছন্দ ঝঙ্কার ছিল অতুলনীয়। বিষয়বস্তু সর্বক্ষেত্রেই ছিল অশ্লীলতা বর্জিত। কবিদের প্রতি আল্লাহর রাসূল সা:-এর কঠোর নির্দেশ ছিল অশ্লীলতার বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন- ইসলাম গ্রহণের পরও যে অশ্লীল কবিতা ছাড়তে পারল না সে যেন তার জিভটাই নষ্ট করে ফেলল।’ প্রাক-ইসলামি যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ইমরুল কায়েসের অশ্লীল কাব্য রচনার জন্য আল্লাহর রাসূল সা: তাকে জাহান্নামগামী কবিদের নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আজকের সমাজে যারা কাব্যচর্চা করেন, তাদের জন্য রাসূল সা:-এর হাদিসটি অত্যন্ত কঠিন ও ভয়াবহ সতর্কবাণী বললে আশা করি ভুল হবে না।
আল্লাহর রাসূল সা: ঘোষণা করেন, ‘কাব্যচর্চাই কবিদের জন্য জিহাদে অংশ গ্রহণের সমতুল্য এবং এজন্য তিনি তাদের জন্য গণিমতের অর্থ নির্ধারণ করে দেন। এ ভাবেই কাব্যচর্চা জিহাদের সমমর্যাদায় অভিসিক্ত হয়। আলহামদুলিল্লাহ। চূড়ান্ত ঐতিহাসিক ঘোষণা হিসেবে উল্লেখ করা যায় মহানবী সা: কবি হাসসান বিন সাবিতকে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে হাসসান আল্লাহর কাছে তোমার জন্য রয়েছে জান্নাত।’
পরিশেষে বলতে চাই, আজ বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষময় ছোবলে ইসলামি শিক্ষা সংস্কৃতি ও সাহিত্য চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
এ বিষাক্ত নগ্নহামলাকে প্রতিহত করতে একান্তভাবে উচিত সাহাবায়ে কিরামদের সাহিত্যচর্চার মডেলকে সামনে রেখে মাতৃভাষার মাধ্যমে এ পরাশক্তির মোকাবেলা করা।
লেখিকা : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ
Discussion about this post