আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশটিতে ভারতীয় স্বার্থ যেম বিপর্যস্ত হয়েছে তেমনি সংকটেও পড়েছেন মোদী। বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ আগে সমগ্র আফগানিস্তান তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর দেশটিতে কূটনীতিক তৎপরতার দিক থেকেও পিছিয়ে পড়েছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পরেও আফগানিস্তানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হলো ভারত।
২০ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধের পর আফাগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিদেশী সেনারা বিদায় নিতে বাধ্য হন। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধের অবসান হয়। এরপর তালেবানবিরোধী পশ্চিমা মদদপুষ্ট সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশটি থেকে পালিয়ে যান। ওই সময় তালেবান যোদ্ধারা কাবুল শহর অবরোধ করে রেখেছিলেন।
পশ্চিমা মদদপুষ্ট সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি সরকারের সাথে ভারতের খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি পালিয়ে যাওয়ার পর সকল বিদেশী এনজিও সদস্য, কূটনীতিক আর পশ্চিমা শক্তিগুলোকে সাহায্যকারী আফগানরা দেশটি থেকে পালিয়ে যান। তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে তালেবান সদস্যরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তাদের ওপর হামলা চালাতে পারে।
আফাগানিস্তানের এমন পরিস্থিতির মধ্যে ভারত তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। তারা তাদের কূটনীতিক ও নাগরিকদের ভারতে নিয়ে আসে। কাবুল বিমানবন্দরের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে অনেক ভারতীয় নাগরিক দেশে ফিরে যেতে না পারায় এখনো তারা তাদের সরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
তালেবানের সাথে যোগাযোগ না করে চরম ভুল করেছিল ভারত
চীনের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে যে ভারত তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তালেবানের সাথে কোনো যোগাযোগও করেনি। এটা তাদের চরম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। পরে যখন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তালেবানে সাথে যোগাযোগ করে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাতারের দোহায় তালেবান তাদের রাজনৈতিক দফতর খুলেছিল ২০১৩ সালে। পরে ভারত তাদের সাথে যোগাযোগ করে এ বছরের জুন মাসে।
এ বিষয়ে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, দু’টি বিষয় ভারতের বিরুদ্ধে গেছে। প্রথমত, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তালেবানের সাথে আলোচনা করতে চাইছিল না। পরে যখন তারা আলোচনা করে তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তালেবানের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায় পাকিস্তান তাদের কূটনীতি প্রয়োগ করে সকল আফগান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রক্রিয়া ব্যর্থ করে দেয়। যদিও ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে তালেবান কর্তৃপক্ষ আফগান পুনর্মিলনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি করেছিল। এখন আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের কারণে ভারত ওই অঞ্চলে তাদের সকল প্রভাব হারিয়েছে। এখন ভারত ভূ-রাজনৈতিকভাবে খুবই অসুবিধার মধ্যে আছে।
ভারত এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন যে তালেবান কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএআইর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখবে। এর আগে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অভিযোগ ছিল যে ভারত বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে আফগানিস্তান থেকে তাদের ওপর হামলা করছে।
মাইকেল কুগেলম্যান আরো বলেন, আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের কারণে ভারতের স্বার্থ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আফগানিস্তানে এখন পাকিস্তানপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি পাকিস্তান ও চীন তাদের প্রভাব আরো বাড়াবে। এর মাধ্যমে ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়বে। কারণ, তালেবান আঞ্চলিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিবে। এমনকি ভারতবিরোধী শক্তিগুলোকেও তারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিবে।
আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগ
আফগানিস্তানে ভারত তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করেছে। তারা আফগানি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছে। তারা আফগানিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন তৈরি করেছে ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
২০২০ সালের আফগান সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর বলেন, আফগানিস্তানে ভারতের চার শ’ বেশি প্রকল্প আছে। এর মাধ্যমে ভারত দেশটির সকল অংশে প্রবেশ করেছিল। আফগানিস্তানের ৩৪ প্রদেশেই ভারত তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।
২০০১ সালে তালেবানকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মদদপুষ্ট নর্দান অ্যালায়েন্স। ওই সময় নর্দান অ্যালায়েন্সকে ভারত সাহায্য করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উইলসন সেন্টারের এশিয়া বিষয়ক সহকারী পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত।
একই ধরনের মন্তব্য করেছেন নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব। তিনি বলেন, আমি মনে করি ভারতকে আফগানিস্তান থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, আফগানিস্তানে গত ২০ বছরে ভারত অনেক কাজ করলেও এখন ওই দেশটিতে তাদের কোনো কূটনীতিক তৎপরতা নেই। এখন আফগানিস্তানে ভারতের কোনো ভূমিকা নেই।
Discussion about this post