মোঃ আশরাফুজ্জামান
মুহাম্মদ সা. ৬১০ সালে নবুওয়াত পাওয়ার পর ক্রমেই মক্কার প্রতিষ্ঠিত অভিজাত ধর্মীয়-রাজনৈতিক সম্প্রদায়কে তাদের কর্তৃত্ব হারানোর চ্যালেঞ্জে ফেলেদেন। একারণে মক্কাবাসীগণ মুহাম্মদ সা. কে তাদের ধর্মীয়-রাজনৈতিক কর্তৃত্বের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করত। ফলে তারা কোনোভাবে মুহাম্মদ সা. কর্তৃক প্রচারিত একত্ববাদ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত মতাদর্শকে মেনে নিতে পারেনি।
নানা অপকৌশল গ্রহণ করে তারা মুহাম্মদ সা. কে রুখতে চাইল। আলোচনা, সতর্কতা জারি, আন্তঃধর্মীয় কোয়ালিশনের প্রস্তাব, অর্থের লোভ, নারী ভোগের আহ্বান, অত্যাচার-নির্যাতন, জেল, অবরোধ, অনুসারিদের হত্যা, স্বয়ং মুহাম্মদ সা.কে কাবার চত্ত্বরে সালাত আদায়রত অবস্থায় গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা প্রচেষ্টা করেও মক্কাবাসীগণ ব্যর্থ হল।
তখন তারা কাবার চত্ত্বরের পাশে সম্মিলিত অভিজাত নের্তৃবর্গ মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, মুহাম্মদ সা. কে সম্মিলিতভাবে হত্যা করতে হবে। এ হত্যাকান্ডে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাগণ নিজ নিজ গোত্র থেকে শক্তিশালী যুবক ক্যাডার নিয়োগ করে। যাতে হত্যার দায়ভার সবার উপর সমানভাবে বর্তায় এবং মুহাম্মদ সা. এর পরিবার বা তার অনুসারিরা প্রতাপশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারে। মুহাম্মদ সা. এহেন পরিস্থিতিতে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যান তাদের অগোচরেই। ফলে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
কিন্তু তারা মুহাম্মদ সা. এর নতুন ধর্মীয় মতবাদের আশু হুমকি উপলদ্ধি করে। তাদের আশংকা মুহাম্মদ সা. মদীনায় নিজের শক্তিবৃদ্ধি করে মক্কার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিতে পারে। অন্য দিকে মদীনায় মুহাম্মদ সা. নিজের অবস্থান জোরদার করেন এবং মক্কাবাসীর হামলার আশংকায় মদীনার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারের পাশপাশি হামলা মোকাবেলায় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
মক্কার ধর্মীয়-রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দ এবং মুহাম্মদ সা. এর মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল শুরু থেকেই। যা মদীনা হিজরতের পর জোরদার হয়। ফলে নানা ঘটনার পরিক্রমায় মক্কার ধর্মীয় রাজনৈতিক সম্মিলিত শক্তি ও নববগঠিত মদীনা সাধারণতন্ত্রের মুসলিমদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সামরিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মক্কার শক্তিশালী, শিক্ষিত, অধিকাংশ অভিজাত ও সমরাস্ত্র সজ্জিত শক্তির সাথে অপেক্ষাকৃত দুর্বল, কম শিক্ষিত, সমরাস্ত্রে নগন্য মুসলিম শক্তির মাঝে ১৭ রমজান,দ্বিতীয় হিজরি, বদর প্রান্তরে সামনা সামনি যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে মুহাম্মদ সা. এর নের্তৃত্বে মদীনার মুসলিমরা জয়ী হন।
যুদ্ধে উভয় পক্ষের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরাজিত মক্কার সামরিক বাহিনীর কিছু যোদ্ধা বন্দী হন। যুদ্ধবন্দীদের সাথে মদীনার মুসলিমরা যে মানবিক আচরণ করে তা বর্তমানের জেনেভা কনভেনশনের যুদ্ধবন্দীর অধিকারকেও হার মানায়।
যুদ্ধবন্দীর মুক্তির জন্য বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে মদীনা কর্তৃপক্ষ। নিয়মানুযায়ী মুক্তিপণের মাধ্যমে অনেকে মুক্ত হন। যুদ্ধবন্দী মুক্তির জন্য যে শর্তটি মুহাম্মদ সা. এর রাজনৈতিক দুরদর্শিতার পরিচয় বহন করে তা হল,‘ যে সকল যুদ্ধবন্দী শিক্ষিত অথচ মুক্তিপণ দেওয়ার ক্ষমতা নেই তারা প্রত্যেকে মদীনার ১০ জন শিশুকে শিক্ষা প্রদান করবে।’
মুহাম্মদ সা. এ নীতির মাধ্যমে মদীনায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার যাত্রা করেন। তিনি উপলদ্ধি করেন একটি জাতিকে যদি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছাতে হয় তাহলে নতুন প্রজন্মকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান ছাড়া সেটি সম্ভবপর হবে না। তাই পরম শত্রু জেনেও নিজ সন্তানদের শিক্ষায় শিক্ষিতকরণে মদীনার কর্ণধর মুহাম্মদ সা. এমন সিদ্ধান্তগ্রহণ করেন। যা তাকে এক অনন্য শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিতে পরিণত করে।
লেখকের ব্লগ থেকে সংগৃহিত