আহমেদ আফগানী
সাত বছরেও সিরিয়া সংকট শেষ হয়নি। এর মধ্যে পক্ষ বিপক্ষ তৈরি হয়েছে বেশ। প্রথমে আসাদ বিরোধী ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে ডিরেক্ট সহায়তা করেছে তুরস্ক ও আমেরিকা। এরপর আমেরিকা দেখলো যুদ্ধ অনেকদিন স্থায়ী হয়ে গেলো তখন আমেরিকা নতুন পক্ষ নামিয়েছে আফগানিস্তানের মত। আর সেটা ক্যান্সার হয়ে গেলো পুরো পৃথিবীতে।
আমেরিকা ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ পদ্ধতি অবলম্বন করে স্থায়িত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল যুদ্ধকে।
অপরপক্ষে আসাদ সরকারকে একচেটিয়া মরিয়া হয়ে সাহায্য করে গিয়েছে ইরান। ইরান আসাদের পক্ষে যাওয়ার মোটা দাগে কারণ তিনটি।
১- আসাদ দীর্ঘদিন ধরে ইরানের পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে ছিল। জাতিসংঘ ও আমেরিকার অবরোধকে উপেক্ষা করে আসাদ ইরানের পাশে ছিল। কৃতজ্ঞতা হতে পারে।
২- ব্যক্তিগতভাবে আসাদ সেক্যুলার হলেও সে শিয়া পরিবার থেকেই আসা। তাই সে শিয়াদের স্বার্থ ও ইরানের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং করবে।
৩- ইরান কখনোই চায় না তার ঘাড়ের উপর আমেরিকা ও ইসরাঈল একসঙ্গে নিঃশ্বাস ছাড়ুক। ইরানে ইসলামী বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ইরানকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে এই আমেরিকাকে। সিরিয়া পরাজিত হলে ইরানের মিত্র রাষ্ট্র আর একটিও থাকবে না। তাই আসাদকে ওখানে জিততেই হবে। নইলে ইসরাঈল চলে আসবে সিরিয়ায়। ইরান অরক্ষিত হয়ে পড়বে। এমনিতেই ইরান তার চারপাশ থেকে আমেরিকার ঘাঁটি দ্বারা আবদ্ধ।
যাই হোক যুদ্ধে অনেকটা বিব্রত ছিল সৌদী। তারা কী করবে বুঝতে পারছিল না। আসাদকে সহায়তা করার প্রশ্নই আসে না। আসাদ ও ইরানকেই সৌদী তার একমাত্র শত্রু মনে করে। আবার ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে সহায়তা করতে পারছিল না। কারণ এই আরব বসন্ত তার দেশেও আগুন ছড়াতে পারে। বরং তাদের নিজ দেশে শিয়াদের চাইতে এদেরই ভয় বেশি।
যুদ্ধে আসাদ বিরোধীদের অবস্থান ছিল ভালোই। সিরিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল তারা নিজেদের করে নিয়েছে। এই অবস্থায় ইরান ডেকে নিয়েছে তার আরেক মিত্র রাশিয়াকে। আমার আজকের লিখা এই রাশিয়ার ভূমিকাকে কেন্দ্র করেই।
রাশিয়া ও ইরানের যৌথ আক্রমনে পিছু হটলো ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। আসলে মূলত পিছনে হটলো তুরস্ক। রাশিয়ার একটি বিমান ভূপাতিত করলো তুরস্ক। এই নিয়ে তুরস্ক ও রাশিয়া মুখোমুখি।
হঠাৎ পটপরিবর্তন। তুরস্কে এক ব্যর্থ ক্যু হলো। তুরস্ক এর জন্য দায়ি করলো আমেরিকাকে। ব্যস, আমেরিকা ও তুরস্কের বন্ধুত্ব ভেঙ্গে গেল।
সিরিয়া যুদ্ধও অন্যদিকে মোড় নিলো। তুরস্ক নিজেকে রক্ষা করার জন্য রাশিয়ার সাথে তিক্ততা দূর করলো। রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক বন্ধু হয়ে গেলো। চরম ধরা খেলো ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। কারণ এখন আর তুরস্ক সেই অর্থে সাহায্য করছে না তাদের।
রাশিয়ার বিমান হামলা, ইরান ও হিজবুল্লাহর সরাসরি অংশগ্রহণ আসাদ বাহিনীকে বিজয়ী করে তুলেছে। যুদ্ধ এখন আসাদের নিয়ন্ত্রণে। আসাদের পরাজয় আর হচ্ছে না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এমতাবস্থায় ইসরাঈলের আতঙ্ক বেড়ে যায়। এই যুদ্ধে ইরান জয়ী হওয়া মানে ইসরাঈলের ঘুম হারাম।
একই সাথে সৌদী আরবেরও কলিজায় কামড়। কারণ সৌদী কাতার ও ইখওয়ানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে সুন্নী দেশগুলোরও সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে অনেকটা। তার উপরে আবার তুরস্ক ও ইরানের মিত্রতা সৌদী আরবকে পাগল করে তুলেছে। মুসলিম বিশ্বে ইরানের প্রভাব বেড়ে যাবে এই আশঙ্কায় গোপন চুক্তিতে মিলিত হয় সৌদী, আমেরিকা ও ইসরাঈল।
সেই সূত্র ধরে আমরা একদিন জানলাম ইসরাঈলের সাথে যুদ্ধ করা অন্যায় বলে ফতোয়া দিয়েছে সৌদী গ্র্যান্ড মুফতি। আরেকদিন জানলাম ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টকে ডেকে মোহাম্মদ বিন সালমান বললেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হতে। কিন্তু তিনি হননি। কী প্রস্তাব সেটা আমরা ক্লিয়ার ছিলাম না।
আরেকদিন হুট করে জানতে পারলাম লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সা’দ হারিরি সৌদীতে এসে পদত্যাগ করেছেন। অভিযোগ করেছেন তিনি নাকি হিজবুল্লাহ দ্বারা আক্রান্ত।
এরপর আমাদের কাছে অনেকটা ক্লিয়ার হয়ে যায় কী ছিল সৌদী, আমেরিকা ও ইসরাঈলের চুক্তি? ইরানকে যদি টিকে থাকতে হয় তাহলে ব্যস্ত থাকতে হবে ইসরাঈলকে। আর ইসরাঈলকে ব্যস্ত করে রেখেছে একদিকে হামাস এবং অন্যদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহ।
এই কথা ইসরাঈল যেমন জানে তেমনি জানে ইরানও। তাই ইরান সবসময় নিজেদের স্বার্থে এই দুই গোষ্ঠীকে ছায়া দিয়ে আসছে। এই দুই গোষ্ঠী ব্যর্থ হলে ইসরাইল ও আমেরিকা সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের সাহস পাবে ইরানে।
তাই তারা চেয়েছিলো সৌদীকে দিয়ে দুটি কাজ করতে-
১- ফিলিস্তিন সরকারের সাথে কিছু বিষয়ে সমঝোতা করে ইসরাঈল-ফিলিস্তিন(ফাতাহ) সন্ধি করবে। স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করবে। একে অপরকে স্বীকৃতি দিবে। বিনিময়ে জেরুজালেম ও বায়তুল আকসা ইসরাঈলকে দিয়ে দিতে হবে। এরপর ফিলিস্তিনের ফাতাহ ও ইসরাঈল মিলে হামাসকে শেষ করে দিবে এবং হামাসকে ফিলিস্তিনের শান্তির অন্তরায় হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
২- লেবাননে শিয়া-সুন্নী সংঘর্ষ লাগাবে। হিজবুল্লাহকে একদিক থেকে ইসরাঈল অন্যদিক থেকে সূন্নীদের সহায়তা করার নাম করে সৌদী আমেরিকা চেপে ধরবে। হিজবুল্লাহ শেষ হয়ে গেলে ইসরাঈলের আর কোন সমস্যা থাকবে না।
এরপর তিনদেশের অভিন্ন শত্রু ইরান ও সিরিয়াকে কন্ট্রোল করা ইজি হয়ে যাবে। কিন্তু সৌদী বাদশার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান সবকিছুতেই ব্যর্থ হলো। ফাতাহ কোনভাবেই রাজি হয়নি। কারণ তারা যেমনিভাবে ইসরাঈলকে বিশ্বাস করে না তেমনি সৌদীকেও নয়। বরং বিশ্বাসযোগ্যতায় হামাস এই দুই দেশের চাইতে এগিয়ে। তদুপরি তারা জেরুজালেম ছাড়তেও রাজি নয়।
আবার সা’দ হারিরিকে নিয়ে করা ষড়যন্ত্র খুব সুন্দরভাবে ট্যাকল দিয়েছে হিজবুল্লাহ। সা’দের মন্ত্রীদের সাথে এবং লেবাননের সুন্নী নেতাদের সাথে নিয়ে সৌদি গংদের ষড়যন্ত্র ক্লিয়ার করেছে। সব মিলিয়ে সেখানে দারুণ ব্যাপার হয়েছে। প্রায় নিশ্চিত এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গিয়েছে লেবানন। সা’দও পরে দেশে এসে সব ঠিকঠাক করে নিয়েছে।
এতকিছু ইরানের পক্ষে থাকলেও এর মধ্যে ঘটে গিয়েছে আরেকটি ঘটনা। হুট করেই নেতানিয়াহুর সাথে পুতিনের গোপন কিছু একটা হয়ে গেল। সাথে সাথে চাপে পড়ে গেলো ইরান।
৯ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রাশিয়া সফরে গেল ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। রাশিয়া ত্যাগ করার পূর্বে সাংবাদিকদের সাথে দেওয়া বক্তব্যে নেতানিয়াহু বলেছিল, এটা মনে করার কোনো ভিত্তি নেই যে, সিরিয়াতে ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপে রাশিয়া বাধার সৃষ্টি করবে।
ওই দিন রাতেই দেখা গেল সেই কথার সত্যতা। সেদিন রাত ১টার সময় ইসরায়েল তার বিমানবাহিনীর ২৮টি এফ-১৫ এবং এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান থেকে সিরিয়ার ভূমিতে অন্তত ৬০টি মিসাইল নিক্ষেপ করে। গোলান মালভূমি থেকে নিক্ষেপ করে আরো ১০টি স্থল থেকে স্থল মিসাইল। সেগুলো আঘাত হানে সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানের প্রায় ৫০টি সামরিক স্থাপনার উপর। নিহত হয় অন্তত ২৭ জন, যাদের মধ্যে ছিল এগারো জন ইরানী এবং ছয় জন সিরীয় সেনা।
রাশিয়ার আচরণ এবং ইসরাঈলের আচরণ দেখে একথা বলা যায় যে ইরানের উপর ইসরাঈলের এই হামলায় রাশিয়ার সমর্থন ছিল। কিন্তু কেন?
কারণ হতে পারে তিনটি।
১- সিরিয়াতে অবস্থানকারী দুই বিজয়ী পক্ষ রাশিয়া এবং ইরানের মধ্যে সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সেই প্রতিযোগিতায় রাশিয়া এগিয়ে যাবার জন্য।
২- সিরিয়াতে রাশিয়ার অর্জনগুলোর বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের যে একটিমাত্র রাষ্ট্র বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেই ইসরায়েলের সাথে তারা সুসম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে উত্তেজনা প্রশমিত করার সুযোগ তৈরি করে নিয়েছে।
৩- মধ্যপ্রাচ্যে যাতে ইরানের আধিপত্য এমনভাবে সৃষ্টি না হয় যাতে করে ইরান পরাশক্তিতে রুপান্তরিত হয়। ইতিমধ্যে ইরান বহুদিন আমেরিকা ও জাতিসংঘের অবরোধের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা দেখিয়েছে বেশ।
যাই হোক আমার মনে হচ্ছে ইরান বিচক্ষণতার সাথেই মোকাবিলা করবে। সেই সাথে টিকে থাকবে হামাস ও হিজবুল্লাহ। বায়তুল আকসা আবারো আমাদের হবে।
লেখক: ব্লগার ও গবেষক