মিজানুর রহমান খান
মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মীয়তার নৈকট্য আছে। তাঁর পিতামহ ভারত থেকে গিয়ে যে যুগে মালয় দ্বীপে বসতি গড়েছিলেন, তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা ভারতীয় ছিলেন। কুয়ালালামপুরের প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে অবশ্য এই গল্প (অসমর্থিত) বলতে পছন্দ করেন যে, মাহাথিরের দাদার বাড়ি চট্টগ্রাম, অবশ্য শুধু বাংলাদেশিই বলি কেন, আমার সাম্প্রতিক কুয়ালালামপুর সফরকালে এক মালয়েশীয় ট্যাক্সিচালকও বাংলাদেশি জেনে স্মিত হেসে জানালেন, মাহাথির আপনাদের মানুষ। অবশ্য মাহাথিরের পূর্বপুরুষেরা কেরালা বা বঙ্গোপসাগরের কোলে থাকা চট্টগ্রামের-যেখানকারই হোক না কেন, ব্যবধান শুধু এক দরিয়া। একসময় সমুদ্রপথে কেরালা ও চট্টগ্রামের যোগাযোগ হয়তো ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।
মাহাথির বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিতে একটা প্রাসঙ্গিক নাম, তবে সেটা কে কেন কীভাবে ব্যবহার করছে, তা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। উন্নয়ন দর্শন ছাড়াও ভুল স্বীকার, ক্ষমা প্রদর্শন, আপসরফা এবং শত্রুকে মিত্র হিসেবে মেনে নেওয়ার মতো কয়েকটি বিষয় মাহাথিরের কাছ থেকে শেখার আছে বাংলাদেশের। তবে এত দিন যাঁরা বলে আসছিলেন যে, মাহাথিরও উন্নয়নের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সদাশয় স্বৈরাচার এবং বিরোধীদলীয় মতামত কম গ্রাহ্য করেছেন, এবারের অনন্য পর্বে তাঁকে সেই অভিধায় ফেলা যাবে না। এই পর্বের মাহাথির বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক।
আনোয়ার ইব্রাহিম ইস্যুতে মাহাথিরকে পশ্চিমা গণমাধ্যম সাফল্যের সঙ্গে চিত্রিত করতে পেরেছিল যে, মাহাথির আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজেকে আসীন করতে পারলেও তাঁর উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি সংকটাপন্ন। তৃতীয় বিশ্বের গড়পড়তা কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকের কাতারেই তাঁর স্থান। উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোনো কুলীন নেতার মর্যাদা তার জন্য নৈবনৈবচ।
কিন্তু মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ নজির সৃষ্টি করেছেন মাহাথির। প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা আছে, অনধিক দুই বছর তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। এরপর সম্ভবত আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা ছাড়বেন। আসলে ‘সম্ভবত’ নয়, আনোয়ার ও তাঁর স্ত্রীর (নবনিযুক্ত উপপ্রধানমন্ত্রী ওয়ান আজিজা) সঙ্গে তাঁর পরিষ্কার সমঝোতার ফল হলো, তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে সক্ষম হওয়া। এটাও এক পরিহাস যে, তিনি একদা তথাকথিত সমকামিতার ‘হাতেনাতে’ প্রমাণ পেয়ে মিত্র থেকে শত্রুতে রূপান্তরিত হওয়া যে আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগারে পুরেছিলেন, সেই আনোয়ারের আশীর্বাদ ও তাঁর দলের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবেই মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ইব্রাহিমের মর্যাদাপূর্ণ শর্তে মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বাংলাদেশের এটাই শেখার যে, যোগ্যতা থাকলে কারাগারে আটকানো কোনো ব্যাপার তো নয়, বরং কখনো সেটাই হতে পারে নিজের ও জাতির পরিত্রাণের উৎস।
মালয়েশিয়া তার রাজনীতির ইতিহাসের একটা অশ্রুতপূর্ব পালাবদল দেখছে। মূলত সাধারণ মানুষ ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলায় দণ্ডিত ইব্রাহিমকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। তিনি দণ্ডিত, তাই নির্বাচনে অযোগ্য। মাহাথির অবশ্য নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে ইব্রাহিমকেই দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন।
মাহাথিরের পরের পথপরিক্রমাটা কী হতে পারে, তা জানতে টেলিফোনে কুয়ালালামপুরে একজন ঘনিষ্ঠ রাজনীতি পর্যবেক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে যা বুঝতে পেরেছি, তা মোটামুটি এ রকম: মাহাথিরের পরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি থাকবেন ইব্রাহিমপত্নী। কিছুদিন পরেই ইব্রাহিম ছাড়া পাবেন। কোনো একটি উপনির্বাচনে জয়ী করে এনে তাঁর হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবেন মাহাথির।
তাই বলি, বাংলাদেশের গণমাধ্যম যখন মাহাথির-ম্যাজিককে বেশি বড় করে দেখছে, অগ্রজ সাংবাদিক কামাল আহমেদ ‘ম’ তে মাহাথিরের সঙ্গে ‘মারদেকা’ বা মুক্তি দেখেছেন, তখন পর্দার আড়ালের বাস্তবতা হলো, ইব্রাহিমই গেম চেঞ্জার। মাহাথির পুষ্পবৃষ্টির মধ্য দিয়ে শপথ নিয়েছেন। সাধারণ মানুষ তাঁর ভুল স্বীকার করা, ঔদার্য ও মহত্তম উদাহরণ তৈরির জন্যই তাঁকে এভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মাহাথির ও ইব্রাহিমের এই বিরল সমঝোতা বা রিকনসিলিয়েশন সত্যিই এক বিস্ময়। গণতন্ত্রকে যে ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’ বলা হয়, মালয়েশিয়া তা বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সমঝোতার একটি নব্য ধ্রুপদি নজির স্থাপন করেছেন মাহাথির ও ইব্রাহিম। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, ‘সমঝোতা’ কোনো ফ্যান্টাসি নয়। বিদেশি শক্তির দয়াদাক্ষিণ্যের চেয়ে জনতায় ভরসা রাখাই শ্রেষ্ঠতম বিকল্প। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপাতত আপসরফা নির্বাসিত এবং কল্পনার বাইরের একটি বিষয়। কিন্তু মাহাথির-ইব্রাহিমের আপস আমাদের অন্তত তত্ত্বগতভাবে আশাবাদী করে তুলতে পারে।
মাহাথির অকপটে স্বীকার করেছেন, তিনি ইব্রাহিমকে ফেলে দিয়ে ভুল করেছিলেন। সেটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছিল। সেই রাজনৈতিক ভুলের খেসারত দিয়েছেন তিনি। তবে সেটা মধুর। আনোয়ার বন্ধুবর মাহাথিরকে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর শর্তে প্রধানমন্ত্রী করে মধুর প্রতিশোধ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রীর যোগ্যতা ও নেতৃত্বের প্রশংসা করতেই হবে। ইব্রাহিমের ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, ইব্রাহিমের স্ত্রী গোটা জাতীয় রাজনীতিতে একটি আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন। তিনি সেই ‘বিজয়লক্ষ্মী নারী’। আনোয়ারের স্ত্রী প্রমাণ করেছেন, উত্তরাধিকারের রাজনীতি মানেই হিংসার চাষাবাদ নয়, তিনি প্রমাণ রেখেছেন কীভাবে শুধু জনগণের শক্তির ওপর আস্থা রেখে কারারুদ্ধ স্বামীকে কাছে না পেয়েও পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনা যায়। অবশ্যই মাহাথিরের ক্যারিশমাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। তবে মালয়েশিয়ায় চলমান রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে মাহাথির নায়ক, সার্বিক দিকে বিবেচনায় ইব্রাহিমই মহানায়ক।
মাহাথির তাঁর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেছেন, রাজা ইব্রাহিমকে ক্ষমা করে দেবেন। এটা কিন্তু একজন মাহাথিরের ঔদার্য নয়, এটা বন্দী ইব্রাহিমের অর্জন। যোগ্যতা থাকলে আইনের শাসনের সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া সম্ভব। মাহাথির হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, যে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তিনি ইব্রাহিমকে কারাগারেই শুধু নয়, মাটিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই ইব্রাহিমেই তিনি শুদ্ধ হবেন। ইব্রাহিম তাবৎ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, জনগণের শক্তিতে বিশ্বাসী ও বলীয়ান হলে রাষ্ট্রক্ষমতা ও মর্যাদা পুনরুদ্ধারে জামিন লাগে না। কারাগারের ভেতরে কম আন্তরিক চিকিৎসাসেবাও কোনো সমস্যা নয়। নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা ইব্রাহিমের কারাগারের বাইরে চিকিৎসার আবেদন সরকার নাকচ করে চলছিল।
তবে মাহাথিরের কাছ থেকে আমরা আরও যেটা শিখব, সেটা হলো যে দলকে তিনি নিজ হাতে গড়াপেটা করেছেন, দুই দশকের বেশি সময় যে দল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছে, সেই দলটি দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে তিনি তা পরিত্যাগ করেছেন। মাহাথির বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালয়েশিয়া সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের সাইডলাইনে মাহাথিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মাহাথির সরকারের বৈদেশিক শ্রমিক নিয়োগ নীতি কী হবে, সেটা দেখার বিষয়। তবে গত নির্বাচনে একটি মহল রটিয়েছিল, ৫০ হাজারের মতো বাংলাদেশি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সমর্থনে প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন, এবার তেমন খবর ছাপা হয়নি। তবে নাজিব রাজাক যেভাবে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে রাজপথে নেমে এসেছিলেন, সেই অবস্থানই থাকবে। কারণ, মাহাথিরের রোহিঙ্গাদের বিষয়ে খুবই দৃঢ়চেতা অবস্থান সুবিদিত। মাহাথির বলেছেন, ‘আপত্তি সত্ত্বেও আসিয়ানে মিয়ানমারকে আমরা নিয়েছিলাম, সেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নাগরিক ছিল, এখন মিয়ানমার তাদের অস্বীকার করছে, এটা হতে পারে না। গত এক-দু শ বছরে যারা মালয়েশিয়ায় এসেছে, তারাও আমাদের নাগরিক।’
রোহিঙ্গা প্রশ্নে আসিয়ানে মাহাথির আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন-সেটাই প্রত্যাশিত।
লেখক: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক