গোলাম মোর্তোজা
নিজ ভূমি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করলো, যা রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত পৃথিবীর প্রায় সবাইকে অবাক করে দিলো। প্রশ্ন আসলো, কেন এমন সমঝোতায় বাংলাদেশ স্বাক্ষর করলো? রোহিঙ্গাদের কি আদৌ ফেরত পাঠানো যাবে? আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি আদৌ রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চায়? ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
১. ‘মিয়ানমারের ইচ্ছেতেই ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করা হয়েছে’— বলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ‘১৯৯২ সালের মতো চুক্তি বা সমঝোতা করা যাবে না’— এ কথাও বলেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ‘১৯৯২ সালের প্রেক্ষাপট আর ২০১৭ সালের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা’— এই বক্তব্যও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর।
বাংলাদেশ তার নিজের অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরে এসে মিয়ানমারের সঙ্গে ১৯৯২ সালের চুক্তির আলোকে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, এই সমঝোতা স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাবে।
২. যে সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষর হয়েছে, তা কি বলে যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে?
ক. সমঝোতা অনুযায়ী ‘যাচাই বাছাই’ করে দেখা হবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক কিনা।
খ. ‘যাচাই-বাছাই’ করবে মিয়ানমার-বাংলাদেশ, যৌথভাবে। ‘যাচাই-বাছাই’ প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিলে সিদ্ধান্ত নেবে এককভাবে মিয়ানমার। লক্ষ্য করুন, যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে কোনও কাগজপত্র দেখাতে পারবে না, অর্থাৎ তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবে মিয়ানমার।
গ. সমঝোতা অনুযায়ী যেসব রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে চাইবে, তাদেরকেই ফেরত পাঠানো যাবে। বাংলাদেশ কাউকে জোর করে ফেরত পাঠাতে পারবে না।
ঘ. রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি ক্ষেত পর্যন্ত জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন কোনও পরিবার নেই, যে পরিবারের একাধিক সদস্যকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী হত্যা করেনি, ধর্ষণ করেনি। রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো এখন পোড়ামাটি-কালো কয়লার ডিপো।
ঙ. যে সামরিক বাহিনী যাদের হত্যা করলো, যে সামরিক বাহিনী যাদের ধর্ষণ করলো, যে সামরিক বাহিনী যাদের নিপীড়ন করলো, যে সামরিক বাহিনী যাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করলো, সেই সামরিক বাহিনীর কাছে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চাইবে? আপনি চাইতেন, আমি চাইতাম?
চ. কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে সাধারণত সরাসরি ‘না’ বলে দেওয়া হয় না। বলা হয় ‘নাও হতে পারে’ ‘সংশয় আছে’… ইত্যাদি। ওপরের তথ্যগুলোর ভিত্তিতে আপনার পক্ষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কি কঠিন বা অসম্ভব যে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ফেরত পাঠাতে পারবে কিনা বা ফেরত পাঠাতে চায় কিনা?
৩. রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে বহু আগে থেকে সম্পৃক্ত জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউএনএইচসিআর। গত ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা এসেছে ৬ লাখ ২০ হাজার, এই সংখ্যাও নির্ধারণ করেছে ইউএনএইচসিআর। এই সংখ্যাটাই বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে। এবারের সংকটের শুরু থেকে জোরালো আলোচনা ছিল, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জাতিসংঘ তথা ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সবাই কম-বেশি এমন কথা বলেছেন। অথচ সম্মতিপত্রে ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। যদিও সম্মতিপত্রে এ বিষয়ক আলোচনার সময় বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত রাখার আলোচনা জোরালোভাবেই করেছিলেন। মিয়ানমার চায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মিয়ানমারের ইচ্ছে অনুযায়ী সম্মতিপত্র তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘কেন তৃতীয় কাউকে ডাকতে হবে?’
তৃতীয় কাউকে ডাকার কারণ ছিল—
ক. মিয়ানমার বন্ধু হিসেবে বা পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী হিসেবে বিশ্বস্ত নয়। মিয়ানমার মুখে যা বলে, তা বিশ্বাস করে না, সেই অনুযায়ী কাজও করে না। এ কথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই একাধিকবার বলেছেন। ১৯৭৮, ১৯৯২ সালের চুক্তি মিয়ানমার ভঙ্গ করেছে।
খ. এই লেখা যখন লিখছি, আপনি যখন পড়ছেন, তখনও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। রাখাইনে থাকার মতো পরিবেশ নেই বলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যে মুহূর্তে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছে, সেই মুহূর্তেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। কত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে ও আসছে, সেই সংখ্যা নির্ধারণ করছে ইউএনএইচসিআর। সংখ্যা যারা নির্ধারণ করছে তারা জানে যে এরা মিয়ানমার থেকে আসছে। নাগরিকত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআরের বক্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। মিয়ানমারের অসত্য বক্তব্য বা বহুচারিতা প্রমাণের জন্যেও ইউএনএইচসিআরের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন ছিল।
গ. এবার রোহিঙ্গাদের আসার আগে থেকেই বাংলাদেশে চার থেকে ছয় লাখ রোহিঙ্গা ছিল। বাংলাদেশ একক চেষ্টা করে এত বছরেও তাদের ফেরত পাঠাতে পারেনি। বাস্তবতা বলে, একক চেষ্টা বা দ্বিপাক্ষিকভাবে বাংলাদেশ এবারের আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারবে না। যেহেতু আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবার বাংলাদেশের সঙ্গে ছিল, সেহেতু ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের টালবাহানার প্রসঙ্গ যদি ইউএনএইচসিআর তুলে ধরত, আন্তর্জাতিক চাপ জোরালো হতো। এ কারণেও তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত রাখা জরুরি ছিল।
ঘ. সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে গিয়ে বাংলাদেশ তার পক্ষে থাকা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করেছে। মিয়ানমার যখন রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিয়ে জটিলতা তৈরি করবে, বাংলাদেশের একক বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে না। ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ যৌথভাবে কিছু বললে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অন্যরকম গুরুত্ব বহন করত। এ কারণেও তৃতীয় পক্ষকে সম্পৃক্ত করা জরুরি ছিল।
ঙ. ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সময় তৃতীয় কাউকে ডাকা হয়নি, এখন কেন ডাকতে হবে’— প্রশ্ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রোহিঙ্গা— সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি বিষয়। একটির সঙ্গে আরেকটি কোনও দিক দিয়েই মেলানো যায় না। হ্যাঁ, পার্বত্য চুক্তির সময় প্রকাশ্যে কাউকে ডাকা হয়নি, সেটা সত্য। কিন্তু নেপথ্যে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারত সেই সময় বাংলাদেশ ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠী— উভয়ের স্বার্থ দেখেছিল আন্তরিকভাবে। চীন এখন শুধু মিয়ানমারের স্বার্থ দেখছে, বাংলাদেশের নয়। গঙ্গা চুক্তির সময় জ্যোতি বসু ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বার্থ দেখেছিলেন।
সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বা গঙ্গা চুক্তির সঙ্গে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ফেরত ইস্যুর সম্মতিপত্র মিলিয়ে দেখার সুযোগ নেই।
৪. চীন জাতিসংঘে মিয়ানমারের পক্ষে ভেটো দিয়েছে, ভোট দিয়েছে। মিয়ানমারের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করিয়েছে। ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে যেহেতু চীন খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, সেহেতু চীনের বিরাগভাজন হতে চায়নি সরকার। ফলে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে কি যাবে না, তা খুব একটা বিবেচনায় স্থান পায়নি। দেশের রাজনীতিতে ‘বিরাট সাফল্য’ প্রমাণের জন্যে প্রচারণা চালানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে।
বলা হচ্ছে, ভারতের কূটনীতি এক্ষেত্রে চীনের কূটনীতির কাছে পরাজিত হয়েছে। প্রথমত, ভারত এক্ষেত্রে তার ভূমিকা নির্ধারণে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সিদ্ধান্ত নিতে না পারার ক্ষেত্রে কিছু কারণও ছিল।
ভারতের হৃদ্যতা অং সান সু চি’র সঙ্গে। কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষমতার কেন্দ্র সামরিক বাহিনী, যে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ভারতের হৃদ্যতা অতটা নয়। সু চি’র সঙ্গে আলোচনা করে ভারত যদি কোনও উদ্যোগ নিত, তা বাস্তবায়ন করা যেত না সামরিক বাহিনীর বাধার কারণে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী চীনের সম্মতি ছাড়া ভারতের উদ্যোগকে গ্রহণ করত না। চীন কখনোই ভারতের কোনও উদ্যোগকে স্বাগত জানাত না। ভারত নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত ছিল বলেই ত্বরিত কোনও উদ্যোগ নিতে পারেনি। এক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল চীন। চীনের হৃদ্যতা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে। সেনাপ্রধানকে চীনে ডেকে নিয়ে রাজকীয় সম্মাননা দিয়েছে। আর বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষা করেছে।
৫. সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ বলছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে কার্যক্রম শুরু হবে। সম্মতিপত্রের শর্ত যদিও তা বলে না। ফলে প্রশ্ন এসেছে, বাংলাদেশ আসলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চায় কিনা? যদি রোহিঙ্গাদের ফেরত না পাঠায়, তবে বাংলাদেশের লাভ কী?
না, বাংলাদেশের কোনও লাভ নেই। সরকারের লাভ আছে।
ক. বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
খ. বাংলাদেশে যদি ১২-১৪ লাখ রোহিঙ্গা থেকে যায়, তবে সবসময় সরকার প্রশংসিত হবে এভাবে যে, গরিব দেশ হয়েও বাংলাদেশ এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে।
গ. বাংলাদেশ সরকারের বিবেচনায় যে এই দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে, তার প্রমাণ— সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করার তিন-চার দিন পরেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রকল্প দৃশ্যমান করেছে। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পুনর্বাসন করার জন্য প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
ঘ. সম্মতিপত্র অনুযায়ী যদি দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়, বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের ফেরতই পাঠাতে চায় বা ফেরত পাঠাতে পারবে বলে বিশ্বাস করে, তাহলে পুনর্বাসন প্রকল্প কেন?
পুনর্বাসন প্রকল্পের অর্থ সম্মতিপত্র স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ বুঝে গেছে যে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে না বা মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। ফলে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করে পৃথিবীকে দেখাতে চায়— বাংলাদেশ অনন্য নজির তৈরি করেছে, গরিব দেশ হয়েও বাংলাদেশ সরকার ১২-১৪ লাখ রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করেছে। বাংলাদেশকে এর প্রেক্ষিতে কী ভয়াবহ সংকটে পড়তে হবে, তা বিবেচনায় গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে বিশ্বব্যাপী শেখ হাসিনা সরকারের প্রশংসিত হওয়ার দিকটি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেয়ে পুনর্বাসন করলে বহির্বিশ্বে সরকারের ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হবে।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post