‘এই ওভারে ৮৫ (রান) হইলে ডবল দিবেন জসীম ভাই?’ হাতে টাকা নিয়ে জানতে চাইলেন মো. মনিরুল ইসলাম। যাঁর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি ছিল, সেই জসীমউদ্দীন উত্তর দিলেন ‘ট্যাকা কি কাগজ! আট শতে হাজার পাবি। লাগলে বল।’ চা-দোকানের ১৭ ইঞ্চি টেলিভিশনে চলছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস বনাম চিটাগাং ভাইকিংসের খেলা। রান তখন ৭০। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর শ্যামলী এলাকার একটি রিকশা গ্যারেজ-সংলগ্ন চায়ের দোকানে এমন দৃশ্যই দেখা গেল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) খেলা চলার সময় প্রতিদিনই এখানে বসছে জুয়ার আসর।
দোকানটির সামনে ১৩ জনের মধ্যে তিনজনের পরনে শার্ট-প্যান্ট, বাকিরা লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা। প্যান্ট-শার্ট পরা তিনজনই বাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে একজন জসীমউদ্দীনকে দেখা গেল হাতের আঙুলের ফাঁকে অনেকগুলো নোট গুঁজে রাখা। সিগারেটের ধোঁয়ায় দমবন্ধ পরিবেশ। দোকানের শিশু বিক্রেতা ব্যস্ত উপস্থিত বাজিকরদের মধ্যে সিগারেট আর পান বিক্রিতে।
প্রায় একই চিত্র ঢাকার পাড়া-মহল্লার অলিগলি, বাজার থেকে শুরু করে জেলা শহরগুলোতে। চায়ের দোকান, রেস্তোঁরা, সেলুন, রিকশা গ্যারেজ ইত্যাদিকেন্দ্রিক ক্রিকেট জুয়ার আসর বসছে প্রতিদিন। এসব আসরে যোগ দেওয়া বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ। তাঁরা জুয়ার আসরে এসে প্রতিদিনই নিঃস্ব হচ্ছেন। দেশের প্রচলিত আইনে জুয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আফজালুর রহমান সিনহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সকালে পত্রিকায় বাড্ডার (হত্যাকাণ্ড) ঘটনাটা দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছি। আমরা এত কিছু জানতাম না। খেলার আয়োজকেরা স্টেডিয়ামের ভেতরে কিছু হলে সেটার বিষয়ে বলতে পারে। কিন্তু স্টেডিয়ামের বাইরে পাড়া-মহল্লায় এ ধরনের কিছু হলে তো সেটা ঠেকানো সাধ্যের বাইরে।’
ক্রিকেট নিয়ে জুয়া নতুন নয়। ২০১৪ সালে ঢাকায় ধরা পড়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জুয়াড়ি অতনু দত্ত। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানতে পারে, ওই জুয়ার সঙ্গে আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ও নিরাপত্তা ইউনিটের কর্মকর্তা ধরম সিং যাদব জড়িত ছিলেন। রাজশাহীতে গত ২২ সেপ্টেম্বর ক্রিকেট জুয়া নিয়ে বিরোধে নিহত হন এক যুবক। এর আগে জুয়াড়িদের সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগে জাতীয় দলের খেলোয়াড় আশরাফুলসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সর্বশেষ গত রোববার পূর্ব বাড্ডায় বিপিএলের বাজির আসর বসতে না দেওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের পরে ঢাকার পুলিশ ক্রিকেট বাজির বিষয়ে তৎপর হলেও পরিস্থিতি বদলায়নি মোটেও।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড্ডার ঘটনার পরে আমরা সব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বলেছি এ ধরনের জুয়া বন্ধ করতে ও নজরদারি বাড়াতে। সব থানা-পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
শ্রমজীবীদের নিঃস্ব হওয়ার ফাঁদ
গতকাল বিকেলে দেখা গেল নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেটের পেছনের ছোট ছোট চায়ের দোকানগুলোতেও চলছে জমজমাট জুয়া। রেস্তোরাঁর কর্মী, বইয়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী, মোটর গ্যারেজের মেকানিক, প্রেসের কর্মী—সবাই এসে জুটেছেন এখানে। নিম্ন আয়ের, বেশির ভাগের বয়সই কম। চায়ের দোকানে জড়ো হওয়া ১৫-১৬ বছরের এক রেস্তোরাঁ কর্মী জানালেন, তাঁর এক সহকর্মী গত তিন দিনে সাড়ে আট হাজার টাকা বাজিতে হেরেছেন। অথচ তাঁর মাসিক বেতন সাকল্যে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।
দলের হার-জিত, পরের বলে কত রান বা ছয়-চার হবে কি না, পরের ওভারে ব্যাটসম্যান আউট হবেন কি না, একজন বোলার কত উইকেট পাবেন, ব্যাটসম্যান কত রান করবেন, দলের কত রান হতে পারে, নির্দিষ্ট দল কত রান বা উইকেটের ব্যবধানে জিতবে ইত্যাদি ছোটখাটো নানা বিষয় নিয়েই চলছে বাজি ধরা। বাজির দরও ঠিক করেন নিজেরাই।
মোহাম্মদপুর এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী এলাকার চায়ের দোকান, সেলুনগুলোতে প্রতিদিনই বসছে জুয়ার আসর। আশপাশের মেসে থাকা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওগুলোতে যোগ দিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘তবে বছরব্যাপী ক্রিকেট জুয়া সবচেয়ে বেশি হয় বিহারি ক্যাম্প এলাকায়।’
সাভারের মজিদপুর এলাকার পোশাককর্মী রিপন মিয়া মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সহকর্মীদের অনেকেই এই ক্রিকেট জুয়ায় মজেছেন। নিজেদের মেসে বা পাড়ার চায়ের দোকানে প্রতিদিনই বসছে এ রকম জুয়ার আসর। দু-একজন মাঝেমধ্যে কিছু পয়সা জিতলেও শেষ পর্যন্ত সবাই হারছেন। গত শনিবার জুয়ায় হেরে তাঁর পাশের রুমের এক কর্মী মুঠোফোন বেচতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, আগে শ্রমিক পাড়ায় বিভিন্ন চা-দোকানের পাশে, রাস্তার মোড়ে পেতে রাখা ক্যারম বোর্ড শ্রমিকেরা বোর্ডপ্রতি খেলায় বাজি ধরতেন। এখন সেই দোকানেই ক্রিকেট বাজি চলছে।
অন্তর্জালে আন্তর্জাতিক জুয়া
কেবল স্থানীয় পর্যায়েই নয়, ইন্টারনেটে ক্রিকেট জুয়ার ফাঁদ পেতে আছে বহু ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ। ঢাকার এক তরুণ চাকরিজীবী বলেন, তিনি চার-পাঁচ বছর ধরে ক্রিকেটের বিভিন্ন আয়োজনে বাজি ধরে আসছেন। একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তিনি বাজি ধরেন। সাইটটি চালায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি জুয়া কোম্পানি। এ রকম বহু কোম্পানি রয়েছে। যারা ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক লিগ বা টুর্নামেন্ট চলার সময় বাজির আয়োজন করে। বাজি ধরার আগে ওই ওয়েবসাইটে ডলার দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। প্রাথমিক পর্যায়েই হাজারখানেক ডলারের (৮০ হাজার টাকা) প্রয়োজন হয়। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সব অর্থের লেনদেন হয়। ম্যাচ শুরুর আগেই বাজির দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এক টাকা বাজি ধরার পরে জিতলে কত টাকা দেওয়া হবে এবং হারলে কত টাকা দিতে হবে, সেই দরটা নির্ধারিত হয়। গতকাল বিপিএলের চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার খেলার সময় এ ম্যাচ নিয়েও বাজি হয়েছে।
বাজির পরামর্শ সাইট
বাজির আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটগুলোতে বাজি ধরার আগে বাজিকরেরা যাতে দলের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন, সে জন্য অসংখ্য ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ রয়েছে। ফেসবুকের গ্রুপ বা পেজগুলো বিপিএলের বাজি ধরা নিয়েও সরব। এর মধ্য একাধিক ওয়েবসাইটে বিপিএলে ক্রিকেট বাজির বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ওই ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি বাজি ধরা যায়। তবে ওয়েবসাইটে নির্দেশনা রয়েছে, এখানে বাজি ধরা কেবল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরতদের জন্য প্রযোজ্য। কারণ, ওই সব দেশে জুয়া আইনসিদ্ধ। যেসব দেশে জুয়া বেআইনি, সেসব দেশের নাগরিকদের ওই ওয়েবসাইট ব্যবহারে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞায় কোনো কাজ হচ্ছে না। ওই ওয়েবসাইটের হিন্দিভাষীদের আনাগোনাই বেশি দেখা গেছে। ওই সব ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটে কিছুক্ষণ পরপর মাঠের অবস্থা, পিচের অবস্থা, সংশ্লিষ্ট বোলার অথবা ব্যাটসম্যানের বিস্তারিত তথ্য ইত্যাদি তুলে ধরা হচ্ছে।
ঢাকার বাইরে একই অবস্থা
জামালপুর সদরের এক তরুণ বলেন, জেলার চায়ের দোকান, সেলুনসহ সড়কের মোড়ে বসছে এ ধরনের বাজির আসর। ফেসবুক পাতা, বাজির আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটগুলো থেকে বাজির দরটা জেনে নিজেরা নিজেদের মধ্যেই বাজি ধরেন।
প্রথম আলোর রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, শহরের বিভিন্ন জায়গাতেই চলে বাজি ধরা। বিশেষ করে কাচারিবাজার এলাকার সেলুনগুলোতে খেলার সময় নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষগুলো ভিড় করে বাজি ধরেন। এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি রংপুরের হারাগাছের বিড়িশিল্প-অধ্যুষিত এলাকায়। বিড়ি শ্রমিকেরা এসবে যুক্ত হয়ে প্রতিদিন নিজের উপার্জনটুকুও হারাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক বলেন, চট্টগ্রামে বিপিএলের সময় নগরের প্রতিটি মোড়ের চা-দোকানে পাড়ায় পাড়ায় বাজি ধরা হয়। তবে এর মধ্যেই নগরে বেশ কয়েকটি মারামারি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি পুলিশের নজরে আছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মো. আকরামুল হোসেন।
রাজশাহী অফিস জানায়, বিপিএল নিয়ে রাজধানীর গ্রামেগঞ্জে বাজি চলছে। গ্রাম বা শহরে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তরুণেরা জুয়া খেলছেন। এতে বেশির ভাগই হেরে যাচ্ছেন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো খেলা নির্মল আনন্দ দেওয়ার জন্য। কিন্তু যদি প্রতিটি বল বাজি ধরার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আর খেলার আনন্দ থাকে না। এ ধরনের জুয়া সামাজিক শান্তি বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বড় কোনো সর্বনাশ হওয়ার আগেই এর লাগাম টেনে ধরতে হবে।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post