রুমীন ফারহানা
বাংলাদেশের গণমাধ্যম জুড়ে আগামী সংসদ নির্বাচন, সংলাপ, সমঝোতা, রোহিঙ্গা সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি যে বিষয়টি ঘুরেফিরে বারবারই আলোচনায় আসছে তা হলো মাননীয় প্রধান বিচারপতি। তিনি বিদেশ থেকে ফিরছেন কবে? আদৌ ফিরছেন কি? ফিরলেওবা তিনি কি আবার স্বীয় পদে বসতে পারবেন? আবার নতুন করে প্রশ্ন উঠছে যদি প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেন তাহলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে কিনা? যদিও অ্যাটর্নি জেনারেল স্পষ্ট বলেছেন কোনও শূন্যতা তৈরি হবে না কারণ সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন রাষ্ট্রপতি তবে তাতেও কথা থেকে যায়। পদত্যাগের প্রশ্ন উঠছে কেন? প্রধান বিচারপতি কি বলেছেন তিনি পদত্যাগ করবেন? এমন কী অ্যাটর্নি জেনারেল এও বলেছেন যে প্রধান বিচারপতি ফিরে এসে আদালতে বসার চেষ্টা করলে তা হবে আদালত অবমাননার সামিল।
আদালত অবমাননা কখন হয়? প্রশ্নগুলো জনমনে আসার একটি বড় কারণ হলো মানুষ বিশ্বাস করে যে প্রধান বিচারপতির এই হঠাৎ অন্তর্ধান যতটা না স্বাস্থ্যগত কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে।
বাংলাদেশে ষোড়শ সংশোধনীর রায় এসেছিল অনেকটা ঝড়ের মতো। রায়ের ধাক্কা আদালতের অঙ্গন পেরিয়ে রাজনীতির মাঠ ঘুরে একেবারে সংসদ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল। সভ্য রাষ্ট্র যেখানে আইন, বিচার এবং নির্বাহী বিভাগ যার যার মতো স্বাধীন এবং আলাদা সেখানে এ ধরনের ঘটনা কল্পনা করা না গেলেও আমাদের মতো ব্যক্তি কেন্দ্রীক শাসন ব্যবস্থায় এটি হতেই পারে আর হয়েছেও তাই। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে হর্তাকর্তারা কে কী বলেছেন তা গণমাধ্যমের কল্যাণে সকলেরই কম-বেশি জানা আছে। তাই সেগুলো আর বিস্তারিত বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। তবে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার। গঠনমূলক সমালোচনার নামে প্রধান বিচারপতিকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের নেতা নেত্রীরা যে চমকপ্রদ ভাষা ব্যবহার করে পার পেয়েছেন তাতে দেশে এখন আদালত অবমাননা সংক্রান্ত কোনও আইন আছে বললে পাগলও বিশ্বাস করবে না।
আলোচনা, সমালোচনা এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে না হেঁটে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আইনগত পদক্ষেপ নিলে অর্থাৎ রিভিউ করলেই সেটি সঠিক এবং নিয়মতান্ত্রিক হতো। কিন্তু তার বদলে আমরা দেখলাম হঠাৎ করেই নানান নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে গেলেন। নাটকীয়তা বলছি এ কারণেই যে দীর্ঘ ৩৯ দিন অবকাশের পর যখন হাইকোর্ট খুলতে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই ছুটিতে গেলেন তিনি। আইনমন্ত্রী তড়িঘড়ি অসুস্থতা জনিত কারণে একটা ছুটির দরখাস্ত গণমাধ্যমে আনলেন বটে তবে তা তেমন বিশ্বাসযাগ্যতা পেলো না। বানান ভুলে ভরা চিঠি, প্রশ্নবিদ্ধ সই, দীর্ঘ অবকাশের পর হঠাৎ অসুস্থতা এবং সর্বোপরি ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পরপরই এই ছুটির আবেদন পুরো বিষয়টিকে ঘোলা করে তুললো। এখানেই শেষ নয়। ঘটনার অব্যবহিত পরপরই প্রধান বিচারপতি বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে পরিষ্কার বলে দিয়ে গেলেন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন তবে কিছুটা বিব্রত। তাঁর বিব্রত হওয়ার কারণটিও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ওই চিঠিতেই। রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী, সরকারের মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত সমালোচনাই বিব্রত হওয়ার কারণ। অতীতের আরও অসংখ্য বারের মতই এই চিঠিতেও তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচারবিভাগ এবং সরকারের মধ্যেকার সম্পর্কের আরও অবনতি হবে। মজার বিষয় হলো আইনমন্ত্রীর ভাষ্য আর প্রধান বিচারপতির চিঠি যেহেতু সম্পূর্ণ বিপরীত তাই এর কোনটি গ্রহণযোগ্য কোনটি নয় সে বিচারের ভার আমি পাঠকের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি।
চমক এখানেই শেষ নয়। মাননীয় প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাওয়ার ঠিক পরপরই নজীরবিহীন এক বিবৃতি প্রকাশ করলো সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিস। সেখানে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে বিভ্রান্তিমূলক দাবি করে বলা হলো মহামান্য রাষ্ট্রপতি গত ৩০ শে সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ব্যতীত আপিল বিভাগের অন্য পাঁচজন বিচারপতি মহোদয়গণকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান এবং দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১ টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত দালিলিক তথ্যাদি হস্তান্তর করেন। পরবর্তীতে আপিল বিভাগের পাঁচজন বিচারপতি এক বৈঠকে মিলিত হয়ে উক্ত ১১টি অভিযোগ বিশদভাবে পর্যালোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ওই সকল গুরুতর অভিযোগ মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করা হবে এবং তিনি এ বিষয়ে সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে তাঁর সঙ্গে এজলাসে বসে আর বিচারকাজ পরিচালনা সম্ভব হবে না। রেজিস্ট্রার জেনারেলের বিবৃতি মতে তাঁরা মাননীয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন কিন্তু কোনও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা সদুত্তর না পেয়ে অভিযোগগুলো সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে বিচারকাজ পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্পষ্ট বলেছেন প্রধান বিচারপতির আবার ফিরে আসা সুদূরপরাহত। কারণ হিসাবে তিনি বলেন আপিল বিভাগের অন্য বিচারকদের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে অস্বীকৃতি জানানোর কথা। আইনমন্ত্রী স্পষ্ট বলেন ১১টি অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বে ফিরতে পারছেন না প্রধান বিচারপতি। অবশ্য এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করে বক্তব্য দিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। পরবর্তীতে আবার আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল মতিন খসরুও আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একই সুরে বলেন যে প্রধান বিচারপতির নিজ আসনে আবার বসা সুদূরপরাহত।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া সর্বসম্মত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের একমাত্র বৈধ, আইনগত এবং সাংবিধানিক পন্থা হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এর বিধানাবলী অনুসরণ ব্যতীত কোনও বিচারককে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করা যাবে না। আর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যে দুজন কর্মে প্রবীন তাঁদের নিয়ে। তবে কাউন্সিলের কোনও সদস্যের নিজের আচরণের বিষয়ে যদি তদন্তের প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে কাউন্সিলের যারা সদস্য আছেন তাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীন তিনিই সদস্য হিসাবে কাজ করবেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যদি কোনও অভিযোগ এসে থাকে তাহলে তিনি বাদে কর্মে প্রবীন পরবর্তী তিন বিচারপতি হবেন কাউন্সিল সদস্য। উল্লেখ্য যে রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন কোনও বিচারপতি গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হতে পারেন তাহলে তিনি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করতে এবং তার ফল প্রকাশের নির্দেশ দিতে পারেন।
এখন জনমনে প্রশ্ন হলো-
১. যে মুহূর্তে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ১১ টি অভিযোগ আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিগণের সামনে তুলে ধরলেন, যাদের পরবর্তীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সদস্য হওয়ার কথা, সেই মুহূর্তেই কি প্রশ্ন ওঠে না কাউন্সিল গঠন না করেই এর সম্ভাব্য সদস্যদের সামনে বিচার্য বিষয় হতে পারে এমন কোনও বিষয় সম্পর্কে আলোচনা কতটা ন্যায় সঙ্গত? আরও সহজ ভাষায় বললে আদালতের বাইরে আদালতের বিচার্য বিষয় নিয়ে বিচার শুরুর আগেই আদালতের বিচারপতির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বিচার প্রক্রিয়াকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করে?
২. সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন না করে মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা কতটা যুক্তি সঙ্গত? এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে প্রধান বিচারপতি হবার পাশাপাশি ব্যক্তি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রাষ্ট্রের একজন নাগরিকও বটে যার সাংবিধানিক অধিকার আছে যে কোনও অভিযোগের উত্তর দেওয়ার আগে তাঁর পছন্দমত একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করবার। তাঁকে কি সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল?
৩. সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে কোথায় বলা আছে যে কোনও বিচারপতি সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপিত হলেই তিনি এজলাসে বসার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন? অথবা Presumption of innocence এর যে মৌলিক ধারণা তা থেকে বাংলাদেশের জাস্টিস সিস্টেম কবে সরে এসেছে? মনে রাখতে হবে সংবিধান মতে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ গঠনের পূর্ণ এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির। সুতরাং তিনি যতদিন পর্যন্ত না কাউন্সিল কতৃক দোষী প্রমাণিত হয়ে অপসারিত হন ততদিন পর্যন্ত তাঁর বিচারকাজ চালিয়ে যাওয়ার পূর্ণ এখতিয়ার আছে। তার সঙ্গে বসতে অস্বীকৃতি জানানো কি শপথ ভঙ্গের মধ্যে পড়ে না?
৪. সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হওয়ার আগে, কোনও প্রকার তদন্ত এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিসের মাধ্যমে যে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে সেখানে বলা আছে যে মাননীয় বিচারপতিগণ প্রধান বিচারপতির ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। কাউন্সিল গঠন এবং বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আগেই সম্ভাব্য বিচারপতিদের এই অসন্তোষ কি তদন্তেই পূর্বেই এক প্রকার মনস্থির করার মতো নয় যা সাধারণত ন্যায়-বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় বলে গণ্য হতে পারে। এ অবস্থায় ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় ভবিষ্যত কোনও পদক্ষেপের চিন্তাই কি বাহুল্য বলে বিবেচিত হবে না?
৫. সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মতে রাষ্ট্রপতি সকল কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ক্রমে করে থাকেন। এখানে প্রশ্ন আসে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এসকল অভিযোগ নামা নিয়ে অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনা কি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ক্রমেই হয়েছিল? তাহলে এ সকল অভিযোগের বিষয়ে ঠিক কখন তথ্য আসে তাঁদের হাতে? ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পরপর নাকি আগে? আগে হলে তাৎক্ষণিক কেন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ তো সকলেই নিয়েছিলেন।
পরিশেষে বলি ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছতার ঘাটতি, স্বেচ্ছাচারিতা আর জবাবদিহিহীনতা শুধু প্রতিষ্ঠানকেই পঙ্গু করে না রাষ্ট্রকেও অকার্যকর করে তোলে যার পরিণতি কখনোই শুভ হয় না।
লেখক: সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post