ফিল্মি কায়দায় নরসিংদীর রায়পুরা থানা পুলিশের বিরুদ্ধে অর্থ ও গরু লুটের অভিযোগ উঠেছে। গত মঙ্গলবার মেঘনা নদীতে গরু ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ও ২৫টি গরু ছিনিয়ে নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
শুধু টাকা লুট করেই ক্ষান্ত হননি পুলিশ সদস্যরা। বেশির ভাগ গরু ব্যবসায়ীকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এ নিয়ে উপজেলার চারটি গ্রামে চলছে মাতম। ঋণের টাকা লুট হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকে টাকার দাবি ছেড়ে দিয়ে মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পেয়েছেন। থানা পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
রায়পুরা থানার ওসি দোলোয়ার হোসেন ৯ লাখ টাকা ও ২৫টি গরু জব্দের কথা স্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার আমেনা বেগম বলেন, এ ধরনের ঘটনার কথা শুনেছি। বিষয়টি তদন্তে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) হাসিবুল আলমের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে।
তবে গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি। কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার নিলক্ষ্যা ইউনিয়নের হরিপুর, দরিপুর, শুঁটকিকান্দা ও গোপীনাথপুর গ্রামে প্রায় দুই শতাধিক ব্যবসায়ী গরু বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত। গত মঙ্গলবার সকালে চারটি গ্রামের প্রায় ৬০-৬৫ জন ব্যবসায়ী গরু নিয়ে নৌকাযোগে পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বাইশ মৌজা সাপ্তাহিক গরুর হাটে যান। বেচাকেনা শেষে বিকাল ৫টার দিকে গরু বিক্রির টাকাসহ অবিক্রীত ২৫টি গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন।
ব্যবসায়ীদের দুটি নৌকা মেঘনা নদীর মাঝখানে পৌঁছলে রায়পুরা থানার এসআই শাখাওয়াত হোসেনের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের পুলিশের একটি টিম তাদের গতিরোধ করে। পরে অস্ত্রের মুখে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে তাদের প্রত্যেকের দেহ তল্লাশি করে গরু বিক্রির প্রায় ৭০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।
দুই নৌকার সবাইকে থানায় নিয়ে যায়। পরে ৪৯ জনকে নাশকতা ও বিস্ফোরণ মামলায় আটক দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।
৭০ লাখ টাকার মধ্যে আবেদ আলী বেপারীর ১০টি গরু বিক্রির পাঁচ লাখ টাকা, বাবুল বেপারীর দুই লাখ ৭০ হাজার, ইসলাম উদ্দিনের ৭০ হাজার, কালু মিয়ার এক লাখ ৯০ হাজার, ফেলু মিয়ার দুই লাখ ৬০ হাজার, করিম মিয়ার দুই লাখ ২০ হাজার, জলিল মিয়ার দুই লাখ ৪০ হাজার, কাশেম মিয়ার এক লাখ ৬০ হাজার, খলিল মিয়ার এক লাখ ৯০ হাজার, কাশেম মিয়ার দুই লাখ, শাজাহান মিয়ার এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা রয়েছে। বাকিরা জেলে থাকায় পরিবারের লোকজন সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারেনি।
তবে পুলিশের দাবী, ৮০-৯০ জন লোক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামার চেষ্টা চালাচ্ছে এমন সংবাদের ভিত্তেতে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাদের আটক করে। ওই সময় তাদের কাছ থেকে ২১টি রডের টুকরো, ৩২টি ককটেল ও ৪৪টি টেঁটা জব্দ করা হয়।
কথা হয় গরু ব্যবসায়ী মো. জাকারুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের দুটি নৌকায় প্রায় ৭০ লাখ টাকা ছিল, যা পুলিশ বেশে ডাকাতরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, তারা পুলিশ নয়! আসলে ডাকাত। পুলিশ হলে এভাবে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করত না।
অপর গরু ব্যবসায়ী ইউসুফ এ প্রসঙ্গে বলেন, শাখাওয়াত দারোগা তিনটি স্পিডবোট নিয়ে আমাদের ব্যারিকেড দেয়। নৌকায় এসেই পিস্তল ঠেকিয়ে আমাদের কাছে থাকা নগদ টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। তারা টাকাগুলো তিনটি গামছা দিয়ে বেঁধে একটি স্পিডবোট নিয়ে চলে যায়।
নৌকার মাঝি নিজাম ও বশির বলেন, পুলিশের ভয়ে তিন বেপারির প্রায় ৪ লাখ টাকা একটি ছেঁড়া কাথা দিয়ে নৌকার নিচে লুকিয়ে রাখি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
কালু বেপারির স্ত্রী অরিফা বলেন, ‘ঋণ নিয়া আমার স্বামী ব্যবসা করে। পুলিশ আমার স্বামী ও ছেলের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে গেছে। আবার তাদের জেলে দিছে। এখন ঋণের টাকা কেমনে শোধ করমু?’
অপর গরু ব্যবসায়ী ভুট্টো মিয়া বলেন, পুলিশ যা করছে তাতে পুলিশে ডাকাতের মধ্যে পার্থক্য রইল না।
থানা পুলিশের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া ব্যবসায়ী ইসলাম উদ্দিন বলেন, থানায় নেয়ার পর পুলিশ সদস্যরা টাকা ফেরত চাইলে মামলায় ডুকিয়ে দেয়া হবে বলে ভয় দেখায়। আর টাকা না চাইলে ছেড়ে দেয়া হবে বলে জানায়। পরে বাধ্য হয়ে গরু বিক্রির ৭০ হাজার টাকার দাবি ছেড়ে দেই।
এদিকে একসঙ্গে এত ব্যবসায়ীকে আটক করে নেয়ার পর তাদের স্বজনরা থানায় ভিড় জমান। পরে আটক কিশোর ও বয়োবৃদ্ধসহ ১১ জনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত রায়পুরা থানার দারোগা মো. শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। ওই সময় তার ব্যবহৃত মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
অভিযোগ অস্বীকার করে রায়পুরা থানার ওসি মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামার চেষ্টা চালাচ্ছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে ৪৯ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। এদের মধ্যে আটজন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, ৭-৮ জন ডিবি এসল্টভুক্ত, ১৬ জন টেঁটাযোদ্ধা। ৭০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের কাছ থেকে ৯ লাখ ৬ হাজার ১৫০ টাকা পাওয়া গেছে, যা জব্ধ তালিকায় দেখানো হয়েছে। দাঙ্গা হাঙ্গামা করতে গেলে এত টাকা নিয়ে যায় কিনা? জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
সূত্র: যুগান্তর
Discussion about this post