সোহরাব হাসান
রোববার সকালে প্রথম আলো হাতে নিয়ে মনটি ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। প্রতিদিনের খবরের কাগজেই মন খারাপ করা অনেক খবর থাকে। তাই বলে এ রকম বর্বরতা! কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার কথা বলে একটি মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার অভিসন্ধি এবং ক্যাডার দিয়ে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করার ঘটনা ঘটিয়েছে বগুড়ার ক্ষমতাসীন দলের এক মাস্তান। সেখানেই শেষ নয়। নিজের অপরাধ ঢাকতে সে চরিত্রহীন অপবাদ দিয়ে মেয়ে ও তাঁর মাকে নির্যাতন করেছে, তাদের মাথা মুড়ে দিয়েছে।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার তার সহযোগী রূপম, আলী আজম ও আতিকুর রহমান মিলে মা ও মেয়ের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে (প্রথম আলোর বানান রীতি অনুযায়ী চালিয়েছেন যথার্থ হলেও মানুষ নামের এই ঘৃণ্য জীবের নামে সম্মানার্থক ‘ন’ বসাতে পারলাম না।)।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামানও স্বীকার করেছেন, ‘কিশোরী ও তার মায়ের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এর পেছনে যত বড় রাঘব বোয়ালই থাকুক না কেন, কেউ রক্ষা পাবে না।’ এই সাহসী বক্তব্যের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
এ ঘটনা প্রমাণ করে যে ক্ষমতার রাজনীতি যতটা কলুষিত, জনপ্রশাসন ততটা কলুষিত হয়নি। হয়তো এ কারণেই পুলিশ সুপার ঘটনাকে মধ্যযুগীয় বর্বরতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। বরিশালের আগৈলঝাড়ার সাবেক ইউএনও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ভাতিজাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিতে কসুর করেননি।
ঢাকার রেইনট্রি হোটেলের দুই নারী ধর্ষণের ঘটনার চেয়েও এটি ভয়ংকর। সেখানে অপরাধীরা অপরাধ ঢাকতে আক্রান্তকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্ষান্ত ছিলেন। কিন্তু বগুড়ার কথিত শ্রমিকনেতা তুফান নিজের অপরাধ ঢাকতে ক্যাডারদের পাশাপাশি তার স্ত্রী ও এক নারী কাউন্সিলরকে লেলিয়ে দিয়েছে আক্রান্ত মেয়েটি ও তার মায়ের পেছনে। তারা শুক্রবার মা ও মেয়েকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালায় এবং দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেয়। কোনো সভ্য দুনিয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে?
এই অপমানের প্রতিকার কী। কোনো শাস্তিই মা ও মেয়ের অপমান মুছে ফেলতে পারবে না। তবুও ন্যায়বিচার নতুন তুফানদের দৌরাত্ম্য কমাবে। সমাজটাকে কিছুটা হলেও মানুষের বাসযোগ্য রাখবে? অপরাধীরা তখনই বেপরোয়া হয়, যখন ভাবে তারা যত বড় অপরাধই করুক না কেন, শাস্তি হবে না।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আছাদুর রহমান বলেছেন, ‘বিষয়টি জানার পর ব্যক্তিগতভাবে আমি বিব্রত। সহযোগী সংগঠনের একজন নেতার এ ধরনের কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। যাঁরা তুফান সরকারের মতো ব্যক্তিকে সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদ দেন, এ ঘটনার জন্য তাঁরাও কম দায়ী নন।’
কিন্তু তুফানদের অপকর্ম, দুষ্কর্মে বগুড়ার মানুষ অনেক দিন ধরেই অতিষ্ঠ। কোনো ব্যবস্থা তাঁরা নেননি। বরং আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি মমতাজউদদীন তুফানের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এই নীরবতার মাজেজা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
তারপরও আমরা আশা করব, আছাদুর রহমান সাহেবরা কথা রাখবেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। এ ধরনের অপরাধী দল বা সহযোগী সংগঠনে থাকলে সেটি দলের জন্য কেবল বিব্রতকর নয়, লজ্জারও। এখন দেখার বিষয়, বগুড়া শ্রমিক লীগ তথা ক্ষমতাসীন দলটি কীভাবে লজ্জা ঢাকে? একটি হতে পারে, তারা পুরো ঘটনাই অস্বীকার করল। সবকিছু দলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার বলে চালিয়ে দিলেন। আরেকটি হতে পারে, দেরিতে হলেও উপলব্ধি করলেন, তুফানেরা দলের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বরিশালের ঘটনায় দেখেছি, ইউএনও তারিক সালমন সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থায় নেওয়ায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে তাঁকে জেলহাজতে পর্যন্ত নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তারিক সালমন হয়রানি থেকে রেহাই পান। বগুড়ায় কী হবে আমরা জানি না। পুলিশ সুপার কী তাঁর অবস্থানে অনড় থাকতে পারবেন? পারলে আমরা সাধুবাদ দেব। বগুড়ার শান্তিকামী মানুষও পাশে থেকে তাঁকে সাহস জোগাবে।
এ ঘটনায় পুলিশ শ্রমিকনেতা তুফান সরকার, তাঁর সহযোগী শহরের চকসূত্রাপুর কসাইপট্টির আলী আজম ওরফে ডিপু, খান্দার এলাকার আতিকুর রহমান এবং কালীতলা এলাকার রূপমকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে নারী কাউন্সিলর ও তাঁর মা-বোন আত্মগোপনে আছেন। আর ঘটনার শিকার অসুস্থ মা-মেয়েকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। মেয়েটির শরীরের সাত-আট স্থানে রড বা লাঠির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলো প্রতিনিধিকে বলেছে, ‘অনেক আকুতি-মিনতি করেছি। পায়ে ধরে মাফ চেয়েছি। তারপরও রক্ষা পাইনি।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী বলেছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তুফান সরকার মেয়েটিকে কলেজে ভর্তির কথা বলে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করেছে বলে স্বীকার করে। গ্রেপ্তার করা আতিকুর রহমানও আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। রোববার তুফান ও তার দুই সহযোগীকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম এ ঘটনাকে জঘন্যতম কাজ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, এমন কোনো অপকর্ম নেই যে তুফান করে না। তার অভিযোগ, শ্রমিক লীগের এক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় আছে তুফান। তুফান ও তাঁর ভাই মতিন এলাকায় সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ নামে পরিচিত। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা স্বীকার করেছেন, দলে বা সহযোগী সংগঠনে খারাপ লোক ঢুকে পড়েছে। কিন্তু খারাপ লোকদের বিরুদ্ধে তাঁরা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা জানা নেই। তুফান সরকারের বিরুদ্ধে মাদকের দুটি মামলা রয়েছে। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে যুবদল নেতা ইমরান হত্যা মামলা ছিল।
এদিকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে বেলা তিনটার দিকে শহরের সাতমাথায় প্রথম আলো বন্ধুসভা এবং সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সমাজের সর্বস্তরের লোকজন অংশ নেয়। এই প্রতিবাদকে ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে। আরও বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে হবে, দুর্বৃত্তদের ক্ষমা নেই।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত তিন সহযোগীসহ ধর্ষণের ঘটনার হোতা তুফান সরকারের ছবি দেখিয়ে সহকর্মী জাহীদ রেজা নূর ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, দেখুন, হাতকড়া পরানো সত্ত্বেও লোকটি কীভাবে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। সহযোগীদের অপরাধের মাত্রা কম বলেই হয়তো মাথা নিচু করে আছে। সমাজে অপরাধ করে পার পাওয়া যায় বলেই লোকটি এভাবে তাকানোর সাহস পেয়েছে। আমাদের সমাজে তুফানেরা অন্যায় করে পার পেয়ে যায়, বুক ফুলিয়ে হাঁটে।
তুফানদের মুখ নিচু করাতে হলে আপনাকেও মুখ খুলতে হবে। নিশ্চুপ থাকলে চলবে না।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post