মুহাম্মদ নোমান
কায়রো টাইম রাত ৩ টা। প্রতিদিনের মতো আল জাজীরার রাতের সংবাদ দেখার পর ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। এতগুলো কষ্ট নিয়ে কীভাবে ঘুমানো যায়? তাই আজকে আর ঘুমকেও বেশী দোষ দিচ্ছি না। কুদসে দুই সপ্তাহ ধরে ঘটে চলা ঘটনাগুলো তো আছেই; কিন্তু আজকের কষ্টের কারণটা অন্য কিছু এবং কষ্টটাও একটু বেশী। রাতের আল জাজিরার সংবাদে কুদসের নেতৃত্বস্থানীয় দুই জন ফিলিস্তীনি নাগরিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সাক্ষাৎকারে আল আকসার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর কথা তো এসেছেই; কিন্তু দুটি কথা আজকে নতুন শুনলাম-
১. ইসরাইল আল আকসাকে দখল করার জন্য মরিয়া। কিন্তু হুট করে একদিনে দখল করে বসার মতো বোকা তারা নয়। তাই বেশ কিছুদিন আগে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আল আকসাকে সময়ানোপাতে ভাগ করা হবে। অর্থাৎ দৈনিক ২৪ ঘণ্টাকে ফিলিস্তীনি মুসলমান এবং ইহুদীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। যে সময়টা ইহুদীদের জন্য বরাদ্ধ করা হবে সেই সময়ে আকসায় মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। এটা হচ্ছে আকসাকে পুরোপুরি গ্রাস করার প্রাথমিক পদক্ষেপ। পর্যায়ক্রমে আকসায় মুসলমানদের সম্পূর্ণ প্রবেশ নিষিদ্ধ করাই উদ্দেশ্য। এটা বোঝার জন্য খুব বেশী চালাক হওয়ার দরকার ছিল না। তাই ফিলিস্তীনি মুসলমানরা ইসরাইলের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। শায়খ রায়েদ সালাহসহ ইসলামী নেতারাই মূলতঃ এই আন্দোলনের পেছনে বেশী ভুমিকা রাখছিল। ইসরাইল যখন কোনভাবেই সফল হতে পারছিল না তখন উপসাগরীয় একটি দেশের কাছে নালিশ দেয়। তখন ঐ দেশটির পক্ষ থেকে কুদসের ইসলামী নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং ইসরাইলের কথা মেনে নিয়ে আল-আকসার সময়ানোপাতিক বিভক্তিকে মেনে নিতে বলা হয়। না মানলে তারা ঐ দেশের কাছ থেকে আর কোন সাহায্য সহযোগিতা পাবে না বলে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়।
২. ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই ইহুদীদের পলিসি ছিল গরিব ফিলিস্তীনিদেরকে মোটা অংকের লোভ দিয়ে তাদের কাছ থেকে ফিলিস্তীনের ভূমি ক্রয় করা। এভাবে ১৯৪৮ সালের বহু আগে থেকেই ইহুদীরা ফিলিস্তিনের ভূমি ক্রয় করতে থাকে এবং বসতিস্থাপন করতে থাকে। এর পর ১৯৪৮ সালে যা হবার তাই হল। অনেক দেরীতে হলেও ফিলিস্তিনিরা ইহুদীদের পলিসি ধরতে পারে এবং তখন থেকে ইহুদীদের কাছে জায়গা বিক্রি করা বন্ধ করে দেয়। বিশেষ করে কুদসে তারা কোন ইহুদীর কাছেই এক ইঞ্চি জায়গাও আর বিক্রি করছিলো না। এবারও উপসাগরীয় একটি দেশ ইহুদীদের এই সমস্যাও সমাধান করতে এগিয়ে এলো। ঐ দেশটি বিভিন্ন মুসলিম নামে জায়গা কিনতে লাগলো। যেহেতু পেট্রোডলার আছেই, তো এক টাকার জায়গা পাঁচ টাকা দিয়ে কিনতে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছিলো না। গরিব কুদসবাসিও ধোঁকা খেয়ে প্রয়োজনের কারণে তাদের জায়গা ওইসব মুসলিম প্রতিনিধিদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করে। তারপর বেশ কিছুদিন পরে দেখা গেলো ওইসব জাগায় বিভিন্ন ইহুদী সংস্থার সাইনবোর্ড ঝুলছে।
গাদ্দারী, মুনাফেকী এবং নিমকহারামির কতোটা নিম্মস্তরে নামতে পারলে এরা এসব করতে পারে! মুসলমান দাবী করে, নবীর ওয়ারিশ দাবী করে, দ্বীনের খাদেম দাবী করে তারা এগুলো করছে। আরবদের রক্ত কি এতোটাই বিষাক্ত হয়ে পড়েছে? আরবদের শরীরে কি এতোটাই পচন ধরেছে? এই দুইটি কথা শুনার পর ব্যাথায় বুকটা চিনচিন করছিলো। খুব হতাশ লাগছিলো ভবিষ্যৎ নিয়ে। এপাশ-ওপাশ করছি; কিন্তু ঘুম আসছে না। সময়ও কাটছে না। তাই বিরক্তি দূর করার জন্য টুইটারটা খুললাম। আরবে, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোতে টুইটারের ব্যাবহার বেশী। সব নতুন আপডেট খুব দ্রুত পাওয়া যায়। তো টুইটার খুলতেই কয়েকটা বিষয়ে নজর আটকে গেলো-
১. সৌদি আরব থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে- “মহামান্য বাদশাহ সালমানের হস্তক্ষেপ এবং সময়োপযুগি পদক্ষেপের বদৌলতে আল আকসা থেকে ইসরাইলী ব্যারিকেড এবং সৈন্যদের অপসারণের জন্য মহামান্য বাদশাহের প্রতি জাতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে।”
২. ঠিক একই কারণে, অর্থাৎ কুদস বিজয় করার জন্য আরব আমিরাতের ভাইসপ্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ বিন যায়েদ মহামান্য বাদশাহ সালমানের শুকরিয়া আদায় করছে।
৩. তারপর দেখলাম গোটা টুইটারে একটি হ্যাশট্যাগের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে- (الأقصى في قلب سلمان) অর্থাৎ- “আল-আকসা সালমানের হৃদয়ে।”
শুকরিয়ানামা-দুটি এবং হ্যাশট্যাগটি দেখার পর আর বিছানায় থাকা সম্ভব হয়নি। শরীরে প্রচণ্ড কাঁপন অনুভব করলাম। তারপর আলোআঁধারিতে কীবোর্ডের দিকে হাত বাড়ালাম এং দুটি বাক্য লেখার চেষ্টা করলাম। একটি দুটি করে লেখছি; তবে আমার মাথায় একটি বাক্যই ঘুরপাক খাচ্ছে- (إذا فقدت الحياء فافعل ما شئت) অর্থাৎ- “যদি লজ্জা হারিয়ে ফেলো, তাহলে যা ইচ্ছে করতে পারো”
মোবাইল হাত থেকে রাখতে যাবো এমন সময় আরেকটি ভিডিওতে চোখ আটকে গেলো। তাতে দেখা যাচ্ছে গতকাল রাতে আল-আকসার সামনে শতশত ফিলিস্তিনী জড়ো হয়ে নেতানিয়াহু এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠিন শ্লোগান দিচ্ছে। এটা তারা সবসময় দেয়, নতুন কিছু না। কিন্তু কাল দেখলাম নতুন ঘটনা। ইসরাইল এবং নেতানিয়াহুর নামের শ্লোগানের পরে তাদের তিন নাম্বার শ্লোগানটি ছিল-
“আলে সউদের পতন হোক, পতন হোক”
আমার মুখে এবার একটি চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। ওইসব মিছিলকারীদের প্রতি রাগও হল- বেটারা যার বদৌলতে আজকে ১৪ দিন পরে আকসায় ঢুকতে পারছিস তারই পতনের দাবীতে মিছিল করছিস?! নিমকহারামের দল কোথাকার…….!!
Discussion about this post