ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
জুলাই ৩। ভোর ৫টা ১৩। লেখার টেবিলে বসে দেশের বরেণ্য কবি, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার দেখতে পেলেন, তার চোখের ওষুধ শেষ। সেটা তার সকালের হাঁটাহাঁটিরও সময়। তিনি ওষুধ কেনা ও হাঁটাহাঁটির জন্য শ্যামলীর রিং রোডের বাসা থেকে বের হয়ে ওষুধে দোকানের দিকে যাচ্ছিলেন। সেটা তার বাসার কাছেই। এক মিনিটের পথ। ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। আমার নিজেরও গুরুতর কিডনি ও ব্লাড প্রেসারের সমস্যা। বাসার পাশেই লাজ ফার্মা। ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। রাত ৩টা ৪টায়ও ওষুধ কিনতে যাই। আমিও ফজরের আজানের পর ধানমন্ডি লেকের ধারে হাঁটতে যেতাম। একসময় কিছু প্রবীণ সহকর্মী আমাকে সতর্ক করলেন, ধানমন্ডি লেকে আমার হাঁটতে না আসাই ভালো। কেউ অপমান করতে পারে, কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারে। আমি ধানমন্ডি লেকের ধারে হাঁটা ছেড়ে দিয়েছি। ভিন্ন রুট নিয়েছি। ফরহাদ মজহার সে রকম কিছু সম্ভবত কখনো ভাবেননি বা আমার মতো করে কেউ তাকে সতর্ক করেননি।
ফরহাদ মজহারকে অপহরণকারীরা জানত, তিনি ওই সময় হাঁটতে বের হন। আর সেটাই ছিল তাদের জন্য মোক্ষম সময়। বাসার সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার বাইরে যাওয়া মাত্রই একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়াল তার পথ রোধ করে। তিনজন লোক তাকে টেনে হিঁচড়ে তুলল ওই মাইক্রোবাসে। ভেতরে ছিল আরো তিনজন। তারা দেশবরেণ্য এই বুদ্ধিজীবীকে সিটের ওপর না বসিয়ে সিটের সামনে মেঝেতে বসায়। এরপর তার গায়ের ওপর পা দিয়ে ধরে রাখে। এ সময় ফরহাদ মজহার তার স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ফোনে নিচু কণ্ঠে বলেন, ‘ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ এটা টের পেয়ে অপহরণকারীরা মোবাইলটি তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। বাকি কথাবার্তা অপহরণকারীদের নিয়ন্ত্রণেই হয়েছিল। মোবাইলটি ছিনিয়ে নিয়ে অপহরণকারীরা তাকে বলেছিল, ‘তুই বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।’ তারপর তাকে চড়- থাপ্পড়, কিল-ঘুষি-লাথি মারতে থাকে অপহরণকারীরা। এরপর তারা তার চোখ বেঁধে ফেলে। খুলনা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার আগে ফরহাদ মজহার আর কিছু জানেন না। কী বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন ফরহাদ মজহার? সেটা হলো গো-মাংসের অজুহাতে ভারতে এখন মুসলিম নিধন চলছে। তিনি তার সমালোচনা করেছেন। সেখানকার মুসলমানদের রক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
আর তিনি যা ধারাবাহিকভাবে করেন, তা হলো দেশের রাজনীতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ। কখনো কখনো মার্কসবাদ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনাও করেন। সেসব আলোচনা যে সবার মনমতো হবে, এমন কথা তো বলা যায় না। কেউ পছন্দ করবেন, কেউ করবেন না। সেটা কেনো বাড়াবাড়ি হতে যাবে? আর তিনি করেন নয়া কৃষি আন্দোলন। সে আন্দোলনের লক্ষ্য, উৎসের কাছে ফিরে যাওয়া। খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যবস্তুতে প্রকৃতিনির্ভর হওয়া, যাতে মানুষ রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারে। তার এই আন্দোলন দেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। তার এই আন্দোলনের মূল বক্তব্য হলো দেশের ফসল উৎপাদন ব্যবস্থায় রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের কোনো প্রয়োজন নেই। উৎপাদনের যেটুকু ঘাটতি দেখা দেবে, তা পুষিয়ে নেয়া হবে কেউড়া ফসল দিয়ে। কেউড়া ফসল হলো- একটি ফসল যখন উৎপাদিত হচ্ছে তখন কম সময়ে উৎপাদিত ফসল সেই জমিতে বপন করা। ধরা যাক, কেউ ইক্ষুর চাষ করছেন- তাহলে তিনি ক্ষেতের চারদিকে লাগাতে পারেন ধনিয়া পাতা, ঢেঁড়শ, বরবটি, শিম প্রভৃতি সবজি। আলের ভেতরে ভেতরে লাগাতে পারেন মিষ্টি কুমড়া বা ক্ষিরা জাতীয় সবজি। এর অর্থনৈতিক মূল্য যেমন আছে, তেমনি স্বাস্থ্যমূল্যও অনেক বেশি। কীটনাশক বা রাসায়নিক সার ব্যবহার না করার ফলে জমির উর্বরা শক্তি বাড়বে প্রাকৃতিকভাবে। আর এগুলো না থাকলে জমির ধার দিয়ে আপনা-আপনি গজিয়ে উঠবে অনেক ধরনের শাকসবজি কলমি, হেলেঞ্চা প্রভৃতি। যেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী ও রোগ প্রতিরোধক।
একই সাথে কীটনাশক বা রাসায়নিক সার ব্যবহার না করার ফলে জলাভূমিগুলোতে ফিরে আসতে শুরু করে বহু প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ। জমিতে কীটনাশক বা রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে সেগুলো ধুয়ে চলে যায় পুকুরগুলোতে- ধ্বংস হয়ে যায় অণুজীব আর পুকুরের ছোট ছোট মাছ। নয়া কৃষি আন্দোলনের ফলে প্রকল্পভুক্ত এলাকায় ফিরে এসেছে বহু প্রজাতির ছোট ছোট মাছÑ টেংরা, পুঁটি, গোলসা, চেলা, কাচকি এমনই সব মাছে ভরে গেছে এলাকা। সেখানে মাছচাষের ব্যবস্থা নেই। প্রাকৃতিকভাবেই বহু প্রজাতির মাছ পুকুরে এসে জমা হয়েছে। কীটনাশক বা রাসায়নিক সারের অপকারী দিক হলো, এগুলো পুকুরের পানিতে যায় সেখান থেকে যায় মাছের পেটে এবং সেখান থেকে আসে মানুষের উদরে। বাঁধায় ক্যান্সার, আলসার প্রভৃতি জটিল রোগ। ডাক্তারের কাছে দৌড়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। নয়া কৃষি আন্দোলনের লক্ষ্য এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ। এখানে তো ফরহাদ মজহারের কোনো শত্রু থাকার কথা নয় বা এটা তার কোনো বাড়াবাড়িও নয়।
তাহলে ফরহাদ মজহার বাড়াবাড়ি কোন জায়গায় করলেন? বাড়াবাড়ি যদি করেই থাকেন, তাহলে করেছেন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ নিয়ে, বাড়াবাড়ি যদি করেই থাকেন তাহলে করেছেন ঘটনার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে- তাকেও বাড়াবাড়ি বলা যায় না। তার ভাষা পরিশীলিত ও পরিমার্জিত, কিন্তু তিনি যা বিশ্বাস করেন সে কথা দৃঢ়কণ্ঠে বলেন। তিনি যা বিশ্বাস করেন, তার পেছনে যৌক্তিক ভিত্তি দাঁড় করান। সেটাই অনেকের অপছন্দ আর সে কারণেই সম্ভবত অপহৃত হয়েছিলেন ফরহাদ মজহার। অপহরণকারীরা মাইক্রোবাসে তুলে তাকে সিটের ওপর বসতে দেয়নি, মেঝেতে বসিয়ে পা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিল। তাকে যখন খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়- তখন তার জ্ঞান ফেরে।
ইতোমধ্যে ফরিদা আখতার বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেন। পুলিশ তার মোবাইল ফোনটি ট্র্যাক করতে শুরু করে। পুলিশ জানায়, একবার দৌলতদিয়া ঘাটে একবার ফরিদপুরে- এভাবে খুলনা পর্যন্ত ছয়বার তার মোবাইল ফোন ট্র্যাক করা সম্ভব হয়। পুলিশ জানিয়েছে, তাকে নিয়ে ফরিদপুর শহরে গাড়িটি প্রায় আড়াই ঘণ্টা ঘোরাফেরা করে। পুলিশ ও র্যাব তৎপর হয়। কিন্তু প্রশ্ন এখানে আছে। তারা যদি জানতেই পারলেন যে, ফরহাদ মজহার ওমুক জায়গায় আছেন, তাহলে সেখানকার পুলিশ ও র্যাবের সহায়তায় কেন তাকে উদ্ধার করা হলো না। ফরিদপুর শহরে যদি মাইক্রোটি আড়াই ঘণ্টা ঘোরাফেরা করে থাকে, তাহলে চার দিকে সড়কে চেক পোস্ট বসিয়ে অবরুদ্ধ করলেই ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো। পুলিশ ও র্যাব কি সেটা চায়নি? নাকি যারা তাকে অপহরণ করেছিল, তারা ছিল পুলিশ ও র্যাবের চেয়েও অধিক ক্ষমতাশালী? যাদের ধরে ফেলার এখতিয়ার পুলিশ ও র্যাবের ছিল না? ফরিদপুরে কেন এই বিলম্ব করা হলো? তাকে কি তবে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের মতো অপহরণকারীরা ভারতে পাচার করে দিতে চেয়েছিল? কিন্তু সম্ভবত সেই সুযোগ তারা করে উঠতে পারেনি। ফলে গাড়িটি খুলনার দিকে চলে যায়।
সেখানে তিনি চেতনা ফিরে পান। অপহরণকারীরা নিউ গ্রিল হাউজ দেখিয়ে সেখানে তাকে রাতের খাবার খেয়ে নিতে বলে এবং জানায় যে ফরহাদ মজহার যেন কোনো রকম চালাকির চেষ্টা না করেন। অপহরণকারীরা আছে তার আশপাশে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত ফরহাদ মজহার রেস্টুরেন্টে গিয়ে সবজি, ভাত, ডালের অর্ডার দেন। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে এসে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন শূন্য হাতে। ওয়েটার এসে তাকে জাগায়। ফরহাদ মজহার বলেছেন, তিনি বসেছিলেন আলোকিত কোনো টেবিলে, যাতে লোকে তাকে দেখতে পায়। ভাত খেয়ে তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু পাশের টেবিলে বসে একজন তার দিকে নজর রাখছিল। ফরহাদ মজহারের সন্দেহ, সেই ব্যক্তিও ছিল অপহরণকারীদের একজন। নিচে নেমে এলে অপহরণকারীরা তাকে হানিফ এসি বাসে আই-৩ নম্বর সিটের একটি টিকিট ধরিয়ে দেয়। বলে, সোজা ঢাকা যাবি। মুখ খুললে বিপদ। আমরা আশপাশেই থাকব। বাসে উঠে ফরহাদ মজহার পুনরায় ঘুমিয়ে পড়েন। বাসটি খুলনা থেকে ছেড়ে যশোরের অভয়নগর আসার পর একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে এক ব্যক্তি ফোন করে জানতে চায়, আই-৩ এর যাত্রীর অবস্থা কী? এর কিছুক্ষণ পর র্যাব থেকে ফোন করে বলা হয়, চালক যেন গাড়িটি যেখানে আছে তারা না আসা পর্যন্ত সেখানেই দাঁড় করিয়েই রাখে। সেই অজ্ঞাত ফোন নাম্বারটি কার ছিল, অনুসন্ধান করা হয়নি।
গাড়ি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় ৪০ মিনিট পর পুলিশ এসে ফরহাদ মজহারকে নামিয়ে নিয়ে যায়। এরপর আসে র্যাব। তারা ফরহাদ মজহারকে পুলিশের কাছ থেকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাবের মধ্যে বেশ কিছুটা বাগি¦তণ্ডা হয়। শেষ পর্যন্ত র্যাব ফরহাদ মজহারকে নিয়ে ফের খুলনার দিকে যাত্রা শুরু করে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আরো বেশ কয়েকটি গাড়ি দিয়ে র্যাবের গাড়ির গতি রোধ করা হয় এবং ফরহাদ মজহারকে পুলিশের জিম্মায় নিয়ে নেয়। তারপর তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে আদাবর থানা, গোয়েন্দা দফতর হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে। আদালত তাকে নিজ জিম্মায় বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেন। কিন্তু তিনি এতটাই মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত ছিলেন যে, তাকে ভর্তি করা হয় বারডেম হাসপাতালে। তার রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস। সেখানে তিনি এখনো চিকিৎসাধীন আছেন। এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি একটি কথাই বলেছিলেন যে, আই অ্যাম ট্রমাটাইজড। সেই ট্রমা তার এখনো কাটেনি। সবাইকে ঠিকমতো চিনতেও পারেন না। কথা বলছেন খুবই কম। ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে। দরজায় ডিবি-এসবি পাহারা দিচ্ছে। কেউ দেখা করতে গেলে তাকে হাজার রকম প্রশ্ন করছে। কিন্তু একজন আদালত কর্তৃক মুক্ত মানুষকে নিয়ে এ আবার কেমন খেলা? ফরহাদ মজহার কি শেষ পর্যন্ত সত্য বলতে পারবেন?
কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারের মতো গত সাড়ে তিন বছরে ‘রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ’ বা ‘অপহরণের’ পর পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন কমপক্ষে ২৭ জন। এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে কিছু অভিন্ন ছক বা মিল লক্ষ করা যায়। অপহৃত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশকে অপহরণের পর ‘উদ্ভ্রান্ত’ অবস্থায় কোনো সড়কে পাওয়া যায়। কিন্তু ফিরে আসার পর অনেকে কোনো কথা মনে করতে পারেন না। বাকিরা মুখে কুলুপ আঁটেন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে ২০১৪ সাল থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন। তাদের মধ্যে লাশ উদ্ধার হয় ৪৪ জনের, পরে গ্রেফতার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে ফিরে আসেন ২৭ জন। বাকি ১৭৭ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা কখনো কখনো গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফিরে আসার পর নিখোঁজ ব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলেছেন, চোখ বেঁধে তাদের মাইক্রোবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর বাইরে তারা কেউ আর বিস্তারিত কিছু বলেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘কেউ কিন্তু সরাসরি বলে না ডিবি বা র্যাব তুলে নিয়ে গেছে। তারা বলে ডিবি বা র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে। আমরা নিয়মিত এমন ভুয়া ডিবি ও র্যাব গ্রেফতার করছি। এত নিখোঁজ উদ্ধারের পরও যখন আমাদের নামে অভিযোগ ওঠে, তখন তো আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়।’ তিনি বলেন, কখনো কখনো বড় বড় অপরাধী গা ঢাকা দেয় আর পরিবার অভিযোগ করে, তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে।
১৮ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর কবি ফরহাদ মজহার গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগকে বলেছেন, শ্যামলীতে তার বাসার সামনে থেকে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। এরপর আর কিছু তিনি জানেন না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, অপহরণ বা রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর ফিরে আসার একটি ঘটনারও সুরাহা হয়েছে বলে জানা যায়নি। কারো কোনো শাস্তিও হয়নি। ফলে এটা নিয়ে জনমনে, বিশেষ করে সরকারের সমালোচকদের মনে আতঙ্ক দিন দিন বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটেই এ ধরনের অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা অত্যাবশ্যক। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা সুদৃঢ় করার জন্য সরকারের উচিত ব্যবস্থা নেয়া।
গত সাড়ে তিন বছরে নিখোঁজ অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন এমন কমপক্ষে এক ডজন ব্যক্তিকে নিয়ে গণমাধ্যম সরগরম ছিল। তাদের নিখোঁজ থাকার সময়কাল সর্বনি¤œ ১৮ ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত মাস পর্যন্ত। ১৬ এপ্রিল ২০১৪ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবুবকর সিদ্দিক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোড থেকে অপহৃত হন। ৩৪ ঘণ্টা পর তাকে চোখবাঁধা অবস্থায় কে বা কারা মিরপুরে নামিয়ে দিয়ে যায়। তার পকেটে ৩০০ টাকাও গুঁজে দেয় অপহরণকারীরা। তিনি চোখের বাঁধন খুলে প্রথমে রিকশায় করে মিরপুর ১০ নম্বরে, পরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ধানমন্ডিতে যান। ধানমন্ডি কলাবাগান খেলার মাঠের পাশে স্টাফ কোয়ার্টারের কোনায় বসানো পুলিশ চেকপোস্ট তাকে আটকায়। পরিচয় জানতে পেরে তাকে থানায় নিয়ে যায়। আবুবকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় ফতুল্লা থানায় মামলা করেন তার স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তবে ওই মামলার আর কোনো অগ্রগতি নেই।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে বনানীতে তাদের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন তার স্ত্রী মেহের নিগার। পুলিশ সে সময় এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ২১ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর তাকে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ১০ মার্চ ২০১৫ সালে উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ৬২ দিন পর ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে উদ্ধার হন। ১২ মে তিনি মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল থেকে তার স্ত্রী হাসিনা খানকে ফোন করেন। ভারতীয় পুলিশের বরাতে বলা হয়, মেঘালয়ের গলফ গ্রিন এলাকায় ঘোরাঘুরির সময় পুলিশ তাকে আটক করে। সে সময় তাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছিল। সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি নিজে ভারতে আসেননি। যারা তাকে অপহরণ করেছিল, তারাই তাকে ভারতে রেখে গেছে। তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে চাননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন তানভীর আহমেদ। ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ দিবাগত রাতে তিনি নিখোঁজ হন। পাঁচ দিন পর তাকে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় বিমানবন্দর সড়কে হাঁটতে দেখে পুলিশ বাড়ি পৌঁছে দেয়। তিনিও কোনো কথা না বলে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছেন।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুমাম কাদের চৌধুরী পুরান ঢাকার আদালতপাড়া থেকে নিখোঁজ হন গত বছরের ৪ আগস্ট। প্রায় সাত মাস অজ্ঞাত স্থানে থাকার পর তিনি বাড়ি ফেরেন। গত বছরের ১৫ অক্টোবর কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে, ৩০ নভেম্বর পাবনা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ রংপুর থেকে পাবনা আসার পথে, ১ ডিসেম্বর তানভীরের বন্ধু ও একই মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন পাবনার কলেজ ক্যাম্পাস থেকে এবং বরিশালের চাকরিপ্রার্থী তরুণ মেহেদী হাসান হাওলাদার বনানী থেকে, ৬ ডিসেম্বর ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় রাকিবুল ইসলাম রকি লক্ষ্মীপুর থেকে নিখোঁজ হন। তারা সবাই পরে ফিরে আসেন। চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদের বাবা নুরুল আলম, পাবনা মেডিক্যাল কলেজের দুই শিক্ষার্থীর বাবা সুরুজ্জামান ও নুরুল আলম সরকার বলেন, সন্তান ফিরে আসাতেই তারা সন্তুষ্ট। তারা এ নিয়ে আর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করতে চান না।
মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কামনা করি, ফরহাদ মজহার দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন এবং মনে পড়লে সত্য প্রকাশ করুন।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post