সময়টা ছিল ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। এই দিনে ইতালিয়ান ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী ওমর মুখতার (রহিঃ)-এর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। তিনি শাহাদাত বরণ করেন। সেই সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তাঁকে বলা হতো লায়ন অন ডেজার্ট বা মরু সিংহ।
জন্ম ও শিক্ষা :
ওমর মুখতার লিবিয়ার পূর্ব সিরনিকার আল-বুতনান জেলায় জানযুর গ্রামে ১৮৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল আল মুখতার ইবনে মুহাম্মাদ। আর মায়ের নাম ছিল আয়েশা বিনতে মুহারিব। শৈশবেই বাবা-মা দুজনকে হারান মুখতার। পরে তাকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন শারিফ আল গারিয়ানি নামের এক ব্যক্তি। মুখতারের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়েছিল স্থানীয় মসজিদে । পরে তিনি সুফিদের আন্দোলন সেনুসির মূলকেন্দ্র জাগবুবের সেনুসি বিশ্ববিদ্যালয়ে আট বছর শিক্ষালাভ করেন।
উন্নত জীবন ধারার জন্য ওমর সুপরিচিত ছিলেন। তিনি রাতে তিন ঘন্টার বেশী ঘুমাতেন না। রাতের শেষ তৃতীয় ভাগে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে উঠতেন। তখন থেকে ফজরের আগ পর্যন্ত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তিনি সম্পূর্ণ কুরআন হিফজ করেছিলেন। ভদ্র এবং অত্যন্ত ধার্মিক ব্যাক্তি হিসেবে সুবিদিত ছিলেন। কথিত আছে, তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার সম্পূর্ণ কুরআন কারীম খতম করতেন। ওমর একজন শিক্ষক হিসেবে অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সানুসির প্রবল সুফী অনুশাসন চালিত স্কুলে। তিনি জীবনে নির্বিশেষ দুঃখ ও দুর্দশার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর ছিল গভীর প্রজ্ঞা ও সাহস, যা তাঁর জীবদ্দশাতেই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান ছিল। দক্ষতা অর্জন এবং অনুসরণ করার জন্য তিনি ছিলেন তরুণদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।
ইসলামী আন্দোলনে যাত্রা :
১৮৯৯ সালে ফরাসিদের প্রতিহত করার জন্য রাবিহ আয যুবায়েরকে সাহায্য করতে অন্য সেনুসিদের সাথে তাকে অফ্রিকার চাদ ভুখণ্ডে পাঠানো হয়। সেখানে সেনুসি নেতা আল মাহমুদের মৃত্যুর পর ১৯০২ সালে মুখতারকে লিবিয়ায় ডেকে পাঠান সেনুসসিদের শীর্ষ নেতা আহমেদ শরীফ আস সেনুসি। তিনি মুখতারকে লিবিয়ার পূর্ব উপকূলীয় এলাকা সাইরেনাইসার উত্তরাঞ্চলের জাওইয়াত লকসর এলাকার নেতা করে পাঠান।
ওমর মুখতার অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বর্বর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হয়ে জনগণ, তাদের সম্পদ এবং সম্মান রক্ষা করার মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম অঙ্কিত করেন। বর্ণিত আছে, আমাদের বীর ওমর ‘আসাদ আল-সাহারা- ‘মরু সিংহ’ উপাধি পেয়েছিলেন একজন তরুণ হিসেবে সুদানের পথে তার ক্কাফেলা নিয়ে ভ্রমণ করার সময়। এই যাত্রা ছিল বিপদের আশঙ্কায় পরিপূর্ণ। কারণ এটি ছিল একটি ভয়ঙ্কর সিংহের গমনপথ। ওমর এই সফরে বিপদজ্জনক সিংহের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি হাতে শটগান নিয়ে ঘোড়ার পিঠে আরোহন করে সিংহের পিছু নিলেন এবং এটিকে হত্যা করলেন। সেখান থেকে তার নাম মরু সিংহ।
ইতালির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ :
১৯১১ সালের ঘটনা। ইতালীয়ান দখলদার শক্তি যখন বিচ্ছিন্ন অটোম্যান খলিফাদের কাছ থেকে লিবিয়া দখল করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তার বয়স ছিল প্রায় ৫৩ বছর। ইতালিয়ান ফ্যসিস্ট সরকার বেনিতো মুসোলিনির পরিচালনায় লিবিয়া আক্রমণকে ‘রোমান রিকনকুইস্তা’ নামে অভিহিত করে। যার অর্থ ‘পুনরূদ্ধার করা’। সেসব ভূমির পুনরুদ্ধার করা যা একসময় রোমান শাসনের অধীনে ছিল। ‘রিকনকুইস্তা’ শব্দটির ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণীয় ছিল। এটা ইতিহাসে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। যার রেশ ধরে ক্রুসেডের বিশাল অংশ জয় করার উদ্দেশ্যে খিষ্টানরা মুসলিমদের স্পেন আক্রমণ করে, অবশেষে তারা সফল হয়।
তাঁর গেরিলা যুদ্ধের দক্ষতা, শক্তিমত্তা, সাহস এবং উদ্দীপনার কারণে তার বাহিনী সেই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর একটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অপরদিকে তার বিপরীতে ইতালিয়ানদের উৎকৃষ্ট এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং তাঁর অর্ধেক বয়সী পুরুষসৈন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতালিয়ান ট্যাঙ্ক এবং এরোপ্লেনের বিরুদ্ধে ওমরের সক্রিয় অশ্বারোহী যোদ্ধার সংখ্যা ছিল মাত্র ১০০০ থেকে ৩০০০। এদের মধ্যে অধিকাংশই হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। যাদের কাজ ছিল প্রায় প্রতিদিনই মুসোলিনের সশস্ত্র বাহিনীকে পরাস্ত করা। তারা এক বছরে ২৫০টিরও বেশী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এটিকে প্রতিরোধ করার জন্য নাগরিকদেরকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ইতালিয়ান ফ্যাসিষ্ট সরকার ‘কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প’ গঠন করে। ১৯৩০ সালে ইতালিয়ান সরকার ১ লাখ বেদুইন পুরুষ, মহিলা এবং ছেলেমেয়েকে মরুভূমির ক্যম্পে একত্রিত করে- যা ছিল সেই সময়ে সেরিনাইকার আদিবাসী জনসংখ্যার অর্ধেক। এটা ছিল অনেকটা বর্তমান সময়ে ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধের জন্য ইসরায়েলদের অভিগমনের মতই। ইতালিয়ানরা যুদ্ধে যতবার ক্ষতিগ্রস্ত হত, জনগণের উপর আরও বেশি কঠোর শাস্তির নিপীড়ন চালাত।
লিবিয়ার ইতিহাসবিদ মাহমুদ আলি আত তায়েব ১৯৭৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শিবিরগুলোতে থাকা ৫৫ শতাংশ লিবিয়র মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৩০ সালের নভেম্বরে ক্ষুধা ও অসুস্থতায় প্রতিদিন ১৭ জন করে লিবিয় মারা যেত।
মুখতার বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯২৪ সালে ইতালির গভর্নর আর্নেস্ট বমবেলি জেবেল আখদারের পার্বত্য অঞ্চলে পাল্টা গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। ইতালির এই নতুন বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের মুখে মুখতার দ্রুত তার যুদ্ধকৌশল পাল্টান। এসময় তিনি মিশর থেকেও কিছুটা সামরিক সাহায্য পেতে সমর্থ হন।
১৯২৭ সালের মার্চে ইতালীয়রা জাঘবুব দখল করে। ১৯২৭ থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত মুখতার সানুসি বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। ১৯২৯ সালে পিয়েত্রো বাদোগলি লিবিয়ার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ওমর মুখতারের সাথে শান্তি আলোচনায় বসেন। এসময় গভর্নরের পক্ষ থেকে মুখতারকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। শেষ পর্যন্ত এই আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং ওই বছরের অক্টোবরে মুখতার লিবিয়ায় ইতালির সেনাপ্রধান রডোলফো গ্রাজিয়ানির সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য লিবিয় যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।
১৯৩০ সালের জুনে গ্রাজিয়ানির বাহিনী মুখতারের কাছে পরাজিত হয়। খবর পেয়ে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মুসোলিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মুখতার বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে দিতে গ্রাজিয়ানির পরামর্শে মুসোলিনি জেবেল আখদার থেকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প সরিয়ে উপকূল এলাকায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। এছাড়া গিয়ারাবুবে উপকূলের কাছে লিবিয়া ও মিশরের সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। মুখতারের যোদ্ধারা যাতে মিশর ও স্থানীয় জনতার সহযোগিতা না পায় সেজন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়।
১৯৩১ সালের প্রথম দিক থেকেই মুখতার বাহিনীর প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে দিতে সক্ষম হয় গ্রাজিয়ানির বাহিনী। আকাশ ও স্থল উভয় পথেই মুখতার বাহিনীর ওপর চলে আক্রমণ। এর পরেও মুখতার লড়াই চালিয়ে যান। ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্লোনটার কাছে অতর্কিত হামলা চালানো হয় মুখতার বাহিনীর ওপর। ইতালির সেনাদের গুলিতে মুখতারের ঘোড়াটি মারা গেলে পড়ে যান তিনি। এরপরেও নিজের বন্দুকটি নেওয়ার চেষ্টা করলে সেনারা তার হাত লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। শেষ পর্যন্ত আহত অবস্থায় ৭২ বছর বয়সে বন্দি হন মুখতার।
মাত্র তিনদিনের মধ্যে মুখতারের বিচার সম্পন্ন হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয় বেনগাজির সামরিক আদালত। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সুলুকের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মুখতারকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে মুখতারকে মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিনিময়ে তাকে মুজাহিদদের কাছে চিঠি লিখে ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। জবাবে মুখতার বলেছিলেন, “যেই শাহাদত অঙ্গুলি দিয়ে আমি প্রতিদিন সাক্ষ্য দেই যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই। সেই আঙ্গুল দিয়ে অসত্য কোনো কথা লিখতে পারবো না। আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আত্মসমর্পণ করি না। আমরা হয় জিতি, না হয় মরি। তোমাদেরকে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে লড়তে হবে এবং এর পরের প্রজন্মের সঙ্গে।’
যতক্ষন পর্যন্ত না আমি দুই সর্বোচ্চ স্তরের মর্যাদার (শহীদ অথবা বিজয়) যে কোন একটি লাভ করব, ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাব এবং আমি আল্লাহর নামে শপথ করছি যিনি অন্তর্যামী , এই মূহুর্তে যদি আমার হাত বাঁধা না থাকত তাহলে আমি খালি হাতেই তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
ওমর মুখতার ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের মূলনীতি ধারণ করার জন্যও সুবিদিত ছিলেন। একবার এক ঘটনা ঘটেছিল। ওমর মুখতার দুজন জীবিত ইতালিয়ান বন্দীকে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “আমরা বন্দীদেরকে হত্যা করি না”। তার সহযোদ্ধা বলল, “তারা আমাদের সাথে এমন আচরণ করেছে”। যার জবাবে তিনি এই মহান বানী উচ্চারণ করেছিলেন, তারা আমাদের শিক্ষক নয়।
ফাঁসিতে ঝুলানোর সময় তাকে বলা হল, সে ইচ্ছা করলে তার সর্বশেষ যে কোন কথাই বলতে পারে। তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় উচ্চারণ করলেন কুরাআনের আয়াত: নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই এবং আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবো। ওমর মুখতারের শেষ পরিণতি স্বচক্ষে দেখার জন্য বিশ হাজার কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পের বন্দী এবং সিরেনাইকা নাগরিকদের জোরপুর্বক বাধ্য করা হয়েছিল।
Discussion about this post