ফারুক ওয়াসিফ
লেখক ও সাংবাদিক
মানুষ কেবল অক্সিজেনেই বাঁচে না, আশায়ও বাঁচে। আশা তার জীবনের জ্বালানি। রিকশাচালক তমির উদ্দিনের চার শিশুর জন্য কিছুই ছিল না, সামান্য আশা শুধু ছিল। সেই আশাটা রূপকথার মতো করে সত্যি হয়েছে। হাজার বছর আগের বাংলা ভাষার কবিতার ছেঁড়া একটি অংশ পাওয়া গেছে। সেখানে কবির কথাটা ছিল এমন, ‘বউ, শিশুটাকে বাঁচিয়ে রাখিস, আবার বৃষ্টি হবে, ঘাসগুলো হবে সবুজ।’ তমির উদ্দিন তাঁর বউ সেলিনা বেগমকে কী আশার কথা শোনাতেন, জানি না। বললেও তা বোঝার ক্ষমতা ছিল না এই মায়ের। তিনি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ঘরে তিন ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলেটি ১০, একেবারে ছোটটি মেয়ে; মাত্র দুই বছর বয়স। নামটা ভারি সুন্দর, মেঘলা আক্তার। বাকি তিনজন সালাউদ্দিন, স্বাধীন ও ইকবাল। শিশুমাত্রই সুন্দর। ওদের যে সুন্দর নাম রাখা, সেটাও কিন্তু আশা থেকেই। যাতে নামের মতো সুন্দর জীবন তাদের হয়। হয়তো উপযুক্ত সহায় পেলে সালাউদ্দিন হতে পারে ক্রুসেডজয়ী সালাহউদ্দিন আইয়ুবির মতো শক্তিমান সুলতান। স্বাধীন হতে পারে সত্যিকারভাবেই স্বাধীন ও মুক্ত এক মানুষ। ইকবাল হতে পারে উর্দু ভাষার কবি মুহাম্মদ ইকবালের মতো প্রভাবশালী। আর মেঘলার জন্য তো হতেই পারত ওর ভাইদের চেয়েও বেশি পরমা।
কিন্তু আসলে কিছুই হতো না। তিন ভাই-ই কাগজ টুকিয়ে খায়। হাঁটতে শিখলে মেঘলারও সেটাই করতে হতো। যে কাগজ তারা রাস্তা থেকে টোকায়, তার ভাষা তারা পড়তে পারে না। বাপের সাধ্য নেই, মায়ের তো মাথাই ঠিক নেই। কোনো পুতুপুতু, আহা-উহুতে তাদের কোনো লাভ হতো না। তাদের দরকার ছিল বাস্তব সাহায্য। সেই কাজটিই একজন করেছেন। সেই গল্পে পরে আসছি।
এই টোকাইদের খবর কেউ করেনি। ‘এতটুকু আশা’ সিনেমার গানটির মতো, ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবনপাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।’ জামালপুর শহরেরই শওকত জামান নামের এক ব্যক্তির মনেও আশা ছিল। খবরের পাতা পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারলেও জীবনপাতায় তিনি তাঁদের খবর করেছেন। ফেসবুকের পাতা তো আজকাল জীবনপাতাই। কোটি কোটি মানুষ নিজেদের জীবনের ঘটনা সেখানে তুলে ধরে।
শওকত জামান ফেসবুকে জানালেন, ‘ক্ষুধার্ত তিন ভাই কাগজ টোকাচ্ছে।’ সেই খবর পড়লেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাবুদ্দিন খান। শনিবার ফেসবুকে পোস্ট আসে, সোমবার জেলা প্রশাসক তাদের বাড়িতে যান। তাঁর তহবিল থেকে ঘর নির্মাণের জন্য দুই বান্ডিল টিন, ছয় হাজার টাকা, খাবার ও নতুন পোশাক দেন। ছেলেগুলোকে ভর্তি করিয়ে দেন স্কুলে। তাদের হাতে তুলে দেন বই। এখন তিনি চেষ্টা করছেন শিশুদের বাবার নতুন কর্মসংস্থানের জন্য। তত দিনের জন্য এক বস্তা চালসহ দরকারি জিনিসপত্রও দেওয়া হয়েছে।
শওকত জামান ফেসবুকে জানালেন, ‘ক্ষুধার্ত তিন ভাই কাগজ টোকাচ্ছে।’ সেই খবর পড়লেন জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাবুদ্দিন খান। শনিবার ফেসবুকে পোস্ট আসে, সোমবার জেলা প্রশাসক তাদের বাড়িতে যান। তাঁর তহবিল থেকে ঘর নির্মাণের জন্য দুই বান্ডিল টিন, ছয় হাজার টাকা, খাবার ও নতুন পোশাক দেন। ছেলেগুলোকে ভর্তি করিয়ে দেন স্কুলে। তাদের হাতে তুলে দেন বই। এখন তিনি চেষ্টা করছেন শিশুদের বাবার নতুন কর্মসংস্থানের জন্য। তত দিনের জন্য এক বস্তা চালসহ দরকারি জিনিসপত্রও দেওয়া হয়েছে।
পুরো ঘটনাটা চেইন রিঅ্যাকশনের মতো। পাঠক, এখানেই আপনার মনোযোগ চাই। ক্ষুধার্ত তিন শিশু কাগজ কুড়িয়ে খায়। অনেকেই দেখলেন, কিন্তু সাড়া দিয়ে সাহায্যের আহ্বান করলেন মাত্র একজন। অনেকেই সেই আহ্বান শুনলেন, কিন্তু এগিয়ে এলেন মাত্র একজন। সেই খবর আবার প্রকাশিত হলো গতকাল বুধবারের প্রথম আলোয়। এই যে ধাপে ধাপে একজন করে উদ্যোগী মানুষ পাওয়া গেল; এ না হলে হয় না কিছু। এই চেইনের কোনো ধাপের একজন যদি না থাকতেন, তাহলে এই উপকার পেত না ওই পরিবার।
তাই বলি, স্মল ইজ বিউটিফুল। বিরাট কিছু করতে না পারি, ছোট ছোট উদ্যোগ, আয়োজন, চেষ্টার দরকার আছে। একসঙ্গে অনেক মানুষ যদি তা করে, তাহলে দেশটাই বদলে দেওয়া সম্ভব। সম্ভব যে এর প্রমাণ আছে। আদিকাল থেকেই এ দেশের সাধারণ মানুষই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-হাসপাতালের জন্য জমি দিয়েছে, চাঁদা দিয়েছে। এই দেশে নদীশাসন ও বন্যা প্রতিরোধব্যবস্থা একসময় বড়লোক-ছোটলোক একযোগেই করত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও প্রাণে প্রাণ মেলানোর সেরা উদাহরণ। প্রাণে প্রাণে এই যে বন্ধন, এ দিয়ে অনেক বিপদ মোকাবিলা করা সম্ভব। আর মানুষ যদি একবার দেখে, তাদের সাহায্যে মানুষের জীবন বদলে যাচ্ছে, তাহলে যে-জাতীয় আত্মবিশ্বাস দাঁড়াবে, তা হবে বিরাট সামাজিক পুঁজি।
জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাবুদ্দিন খানকে ধন্যবাদ। তিনি কোনো বাড়তি কাজ করেননি। যা করেছেন, সেটাই তাঁর দায়িত্ব। কিন্তু এটুকুই-বা নিজে উদ্যোগী হয়ে কজন করে? তাই তিনি এক দৃষ্টান্ত। সরকারে থাকা মানুষ, প্রশাসনে থাকা কর্তা কিংবা সমাজে বড় হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের সবার হাতেই কিছু না কিছু ক্ষমতা জমা আছে। যার কিছু নেই, তিনি শওকত সাহেবের মতো জানান দিতে পারেন।
ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির কারাগারে জীবন দেওয়া প্রতিভাধর মার্ক্সবাদী নেতা ও তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসির একটা কথা এ রকম: চিন্তার দিক থেকে আমি সমালোচক, কিন্তু ইচ্ছাশক্তিতে আমি আশাবাদী। আশা নিজেই এক রাজনৈতিক পুষ্টি। বাংলাদেশ অনেক আশার সমাধিভূমি। তারপরও অনেক আশা এখানে মরতে অস্বীকার করে। দিনবদলের সূত্রটা খুবই সরল: ইচ্ছা করুন, আশা করুন, যোগাযোগ করুন আর চেষ্টা করুন।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post