আমাদের দেশে স্বাধীনতার আগে ও পরে অনেক রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হলেও হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া বাকি সবই ময়দানে সফলতা পায়নি। তবু নতুন নতুন দলের আবির্ভাব ঘটছে। সেই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন অক্সফোর্ড পড়ুয়া ড. রেজা কিবরিয়া ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে ‘গণঅধিকার পরিষদ’ নামে আরো একটি রাজনৈতিক দল। এটির আত্মপ্রকাশ হলো গত ২৬ অক্টোবর। অবশ্য বেশ কিছু দিন ধরেই এই দলের গঠন নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছিল। তবে মজার ব্যাপার হলো আত্মপ্রকাশের দিনেই এই দল ও এর সহযোগী সংগঠন ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদকে ‘জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী সংগঠন’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। সে দাবি জানায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠন। যাই হোক, নতুন এই দলের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় এ দেশে নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তার একটি ধারণাচিত্র আঁকা।
দেশে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের ইতিহাস দু’টি পর্বে বিভক্ত করে আলোচনা করা যেতে পারে। এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক দলের ইতিহাস, স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলার মানুষের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। তবে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পেছনে শুধু এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার আদায়ের বিষয়টিই একমাত্র কারণ ছিল তা বলা যাবে না। দলটি গঠনের পেছনে অনুঘটক হিসেবে আরো কাজ করেছে মুসলিম লীগের বাঙালি নেতাদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা। পাকিস্তান সৃষ্টিতে যাতের অবদান ছিল অপরিসীম। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে পদবঞ্চিত সেসব নেতার আগ্রহ ও উৎসাহে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও তরুণ নেতা সামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটি। আওয়ামী মুসলিম লীগ কয়েক বছর পরে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায়’ অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। পরে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। শুরুতে দলটি রাজনৈতিক অঙ্গনে ঢেউ তুললেও সময়ের ব্যবধানে স্তিমিত হয়ে পড়ে। এখন তো নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে সিরাজুল আলমের চিন্তাপ্রসূত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ গঠিত হয়। তারুণ্যে ভরপুর দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জলিল। জন্মের পরপরই নতুন দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঝড় তোলে। কিন্তু সেই ঝড়ো হাওয়া অল্প দিনেই স্তিমিত হয়ে আসে। অল্প সময়ের ব্যবধানে জাসদ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। জাসদ ভেঙে গঠিত হয় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। পরে বাসদও ব্র্যাকেট বন্দী হয়ে পড়ে। হাল আমলে বহুধাবিভক্ত জাসদ কুপিবাতির মতো টিম টিম করে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। অথচ জন্মের পর এটি দেশের তরুণদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছিল। তবে ক্ষমতায় থেকে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑবিএনপি আমজনতার মনে জায়গা করে নেয়। এখনো দলটি বাংলাদেশে দারুণভাবে জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থেকে জন্ম নেয়া জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান করে নিতে পারেনি। যদিও বর্তমানে দলটি একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন কিভাবে হয়েছে তা দেশবাসীর কারো অজানা নয়। সঙ্গত কারণেই বলা যায়, জাতীয় পার্টির প্রাসঙ্গিকতা সাদা চোখেই স্পষ্ট। বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ কে এম ওবায়দুর রহমান জনতা দল গঠন করেও পরবর্তীতে ফের বিএনপিতেই ফিরে আসেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৯ সালে বিশিষ্ট সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গঠন করেন এনডিপি। তাদের সেই উদ্যোগও রাজনীতির ময়দানে কোনো স্বাক্ষর রাখতে পারেনি।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে খ্যাতনামা আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণফোরাম। দলটি দেশের রাজনীতির বহমান স্রোতে হালে পানি পায়নি। ঠিক তেমনি নব্বইয়ের শেষে একই দল আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আবদুল কাদের সিদ্দিকী গঠন করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এর পরিণতিও আগের দলগুলোর মতোই। আর ২০০২ সালে বিএনটির সাথে মতদ্বৈধতায় জড়িয়ে প্রেসিডেন্টের পর থেকে পদত্যাগের পর বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি. চৌধুরী) গঠন করেন বিকল্পধারা। একই সময়ে বিএনপির অপর নেতা অলি আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি)। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ ছাড়া এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকারের সময়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর নেতৃত্বাধীন প্রগ্রেসিভ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং মেজর জেনালের (অব:) ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি। এগুলো কিংস পার্টির অভিধা পায়। একই সময় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী ড. ইউনূস নাগরিক শক্তি (নাশ) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করলেও জনগণের সাড়া না পেয়ে মাঝপথে থামিয়ে দেন। সেই উদ্যোগ আঁতুর ঘরেই মৃত্যুবরণ করে। একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার গঠিত নাগরিক ঐক্যের অবস্থাও তথৈবচ। ব্যতিক্রম শুধু বদরুদ্দিন ওমরের নেতৃত্বাধীন দল গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট থেকে বেরিয়ে আসা জোনায়েদ সাকির নেত্বত্বাধীন গণসংহতি। বামধারার রাজনীতিতে এই দলটি কিছুটা জায়গা করে নিতে পেরেছে। এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, এটিও এখন পর্যন্ত ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরে বেরুতে পারেনি। মোটা দাগে এই হলো দেশের রাজনৈতিক দলের ইতিহাস।
হাল আমলে দুটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে; যার একটি এ লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। ২৬ অক্টোবর সদ্য ভূমিষ্ঠ ‘গণঅধিকার পরিষদ’। দ্বিতীয়টি করোনাকালে গত বছর আত্মপ্রকাশ করে এবি পার্টি। এর নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক সচিব সোলায়মান চৌধুরী এবং শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু। কিন্তু দলটি এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে না পারায় অনালোচিতই রয়ে গেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি, বাংলাদেশী, বাম এবং ইসলামী এই চার ধারার রাজনীতি প্রবহমান। দেশের প্রধান দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দল দু’টির নেতৃত্ব উত্তরাধিকারের ধারায় প্রতিষ্ঠিত। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় দল দু’টি পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বিএনপির অবলম্বন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বামপন্থী এবং ইসলামপন্থীরা বহুধা বিভক্ত। ইসলামপন্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দল জামায়াতে ইসলামী। বামপন্থীদের মধ্যে এখনো সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে সিপিবির। বাম এবং ইসলামীপন্থী আদর্শের অন্য দলগুলোর বেশির ভাগই নামসর্বস্ব।
দেশের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ইতিহাস পাঠে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় সেটি হলো, দলছুট হয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে কেউ সুবিধা করতে পারেননি। একই সাথে ব্যক্তিনির্ভর দলগুলো সংশ্লিষ্ট নেতার অনুপস্থিতিতে হারিয়ে গেছে। লক্ষণীয় যে, দু-চারটি দল ছাড়া বাকি সবই জনসম্পৃক্ত হতে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই ব্যর্থতা? উত্তরে প্রথমত বলতে হয়, মূলত রাজনৈতিক দল যে কারণে সফলতা এবং নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে সে ধরনের জনঘনিষ্ঠ কর্মসূচি কেউই দিতে পারেনি। একই সাথে জনগণের নির্ভরযোগ্য নেতৃত্বের সমাবেশ ঘটাতে পারেনি। জনগণ যখন দেখে, তাদের অধিকার আদায়ের কর্মসূচি নিয়ে এসব দল এগিয়ে আসছে না, গণমুখী না হওয়ায় এগুলো আর কোনো আবেদন রাখতে পারেনি। সঙ্গত কারণেই পুরনো দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি গণমানুষ।
এখন প্রশ্ন চলে আসে দেশে নতুন রাজনৈতিক দলের কি কোনো ভবিষ্যৎ নেই? রাজনীতিতে বাঁকবদলের কোনো লক্ষণ নেই? জবাবে বলা যায়, অবশ্যই আছে। যেহেতু দেশের প্রধান দুই দল জাতীয়তাবাদী ধারায় রাজনীতি করছে তাই নতুন দলের জনগণকে পুরনো বটিকা খাওয়ানো চেষ্টা অর্থহীন। এ ক্ষেত্রে কর্মসূচি হতে হবে সমকালীন বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দেশের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে গড়ে তোলা। এর অর্থ হলো, দেশের মানুষকে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করা। একই সাথে কিভাবে নাগরিকদের সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে তার সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা প্রণয়ন করে জনসমক্ষে উপস্থাপন করা।
এখনকার বাস্তবতা হলো, আগামীর রাজনীতি ধারণ করতে দেশের প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো উপযোগিতা হারাচ্ছে। কিন্তু সেই অভাব এখনো নতুন কোনো দল কাজে লাগাতে পারছে না। কিভাবে নিজেদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে আমজনতাকে সংযুক্ত করা যায়; তা এখনো নতুন দলের নেতৃত্বের অজানা। ফলে তাদের গ্রহণ করতে জনগণের অনীহা।
একটি বিষয় স্পষ্ট, শুধু কায়েমি স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে যারা কাজ করবেন, তারা প্রচলিত অর্থে যতই যোগ্য হন না কেন তাদের পক্ষে জনগণের আস্থা অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হবে, রেজা কিবরিয়া এবং ভিপি নুরুল হকের নেতৃত্বে ঘোষিত নতুন দল যদি সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুকূলে অবস্থান নেয় তাহলে জনগণও তাদের নিরাশ করবে বলে মনে হয় না। তা যদি করতে না পারেন পূর্বসূরিদের মতো রাজনীতির ময়দান থেকে তারাও স্বাক্ষরবিহীনভাবে হারিয়ে যাবেন। তবে তাদের একটি সুবিধা হলো, এই দলটি কোনো রাজনৈতিক দল ভেঙে গঠিত হয়নি। একই সাথে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় যে তারুণ্যের প্রাধান্য পেয়েছিল এখানেও তারুণ্যদের সমাবেশ ঘটেছে। দলটির দ্বিতীয় প্রধান নুরুল হক কোটা সংস্থার আন্দোলন করে দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। সেই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে ডাকসুতে ভোট করে সুফল ঘরে তুলতে সক্ষম হন। তবে আগামী দিনগুলোতে ‘গণঅধিকার পরিষদ’ কী কর্মসূচি নিয়ে আবির্ভূত হয় তার ওপরই দলটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। গণমানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে না পারলে তাদেরও রাজনীতির ময়দায়ে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার কোনো কারণ নেই।
Discussion about this post