ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
ট্রেনে উঠলাম বিমানবন্দর স্টেশন থেকে। জয়ন্তিকা ট্রেন। নামটা যিনিই দিন না কেন, সুন্দর। কেমন যেন মনে হলো, এই ট্রেনযাত্রা আমাদের জন্য সত্যি সত্যি আনন্দদায়ক হবে। আমরা যাব শায়েস্তাগঞ্জ। হিসেব অনুযায়ী শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছাতে আমাদের সোয়া চারটা বেজে যাওয়ার কথা। সম্ভবত যাত্রা শুরু করেছিলাম সোয়া এগারোটায়। আমি ও আমার স্ত্রী। তবে আমাদের গন্তব্য শায়েস্তাগঞ্জ নয়। দিনকালের শায়েস্তাগঞ্জের প্রতিনিধি রতন পাঁচ দশ মিনিট অন্তর অন্তর ফোন করছিল, কত দূরে আছেন, আমি ঘড়ি দেখি। বলি কোথায় যে আছি বলতে পারবো না। তুমি বরং স্টেশন মাস্টারকে ফোন করে জেনে নাও ট্রেন শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছতে কতটা বাজবে। সে বললো সর্বোচ্চ পাঁচটা।
প্রথমদিকে ট্রেনের লাউড স্পীকারে মাঝে মধ্যে ঘোষণা করা হচ্ছিল কোভিড থেকে মুক্ত থাকার উপায় সম্পর্কে। একবার শুনলাম স্থানের ঘোষণা দিচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবে ওমুক স্টেশনে। সম্মানিত যাত্রীগণকে তাদের ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি থাকুন। আমরা তো খুব খুশি। শায়েস্তাগঞ্জে আসা মাত্রই আমাদেরকে নিশ্চয়ই রেল কর্তৃপক্ষ জানান দেবে, মালপত্র গুছিয়ে নিন। আমি বার বার ঘড়ি দেখি। ঘড়ির কাটা চারটা ছুঁই ছুঁই। ধারণা করলাম অল্প কিছু সময়ের মধ্যে তারা আমাদের জানান দেবে যে, সামনে শায়েস্তাগঞ্জ।
বিকেল চারটার দিকে আমরা সত্যি সত্যি শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছালাম। আমরা যে কমরায় ছিলাম সেখানে কারো নামার প্রস্তুতি দেখলাম না। রতনও আর ফোন দিচ্ছে না। মনে হলো শায়েস্তাগঞ্জ তাহলে আরো দূরে। সেখানে ট্রেন ক’মিনিট যে দাঁড়ায় বলতে পারিনা। সময় বোধ হয় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে রতন ফোন দিল। ত্রস্ত কণ্ঠে বললো নামেন। আমরা ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে তড়িঘড়ি দরজার সামনে ছুটে গেলাম। সঙ্গে তিনটা ব্যাগ। দরজার কাছে গিয়ে দেখি কয়েকজন গার্ড জটলা করছে। বললাম, এটা কোন স্টেশন, ওরা বললো শায়েস্তাগঞ্জ। অভিযোগের সুরে বললাম, কিন্তু জানালেন নাতো। মাইকে ঘোষণাও হলো না। আপনারও তো কিছু বললেন না। দরজা খুলুন। একজন গার্ড দরজাটা খুলে দিল। আমি একটি ব্যাগ হাতে লাফিয়ে নিচে নেমে গেলাম। আমার স্ত্রীর পক্ষে সেটা ছিল অসম্ভব। ফলে আমার চোখের সামনে আমার স্ত্রী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বিরস মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ট্রেন ছেড়ে দিল। পরবর্তী স্টেশন শ্রীমঙ্গল। আমি আমার ঐ অঞ্চলের প্রতিনিধিদের বললাম, আপনাদের ভাবী ট্রেন থেকে নামতে পারেনি। শ্রীমঙ্গল চলে গেছেন। স্টেশনে থাকুন। দয়া করে উনাকে কোথাও বসান।
ট্রেন ছেড়ে দেয়ার পর নাকি গার্ডরা ভিড় ধরে তার কাছে আসেন। তাকে বলেন, আমাদের আগে কেন বললেন না। তিনি তাদেরকে বলেন, আপনাদের আগে বলতে হবে সেটাতো জানতাম না। তারা তাকে আশ^স্ত করেন, শ্রীমঙ্গলে অবশ্যই তাকে নামিয়ে দিবেন।
আমাদের গন্তব্য শায়েস্তাগঞ্জও নয়। শ্রীমঙ্গলও নয়। আমরা যাবো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনভূমি কালেঙ্গায়। সেটা শায়েস্তাগঞ্জ থেকে ঘন্টা-সোয়া ঘন্টার পথ। সে হিসেবে আমাদের বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে কালেঙ্গা পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু সকলি গরল ভেল।
আমি স্টেশনের ভেতরে রেলওয়ের লোকদের কাছে জানতে চাইলাম, এখান তেকে শ্রীমঙ্গল কীভাবে যাবো? প্রত্যেকের একটাই জবাব, পরবর্তী ট্রেন কয়টায় আসবে? আসলে এই অঞ্চলের চলাচলকারী মানুষেরা এতোটাই অভ্যস্ত যে, এর বিকল্প সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই নেই।
ততক্ষণে রতন একটা গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হলো। শ্রীমঙ্গল যাবো আসবো। কিন্তু রতন যাই বলুক, আমার বারবার মনে হতে থাকলো এই গাড়ির চালক শ্রীমঙ্গলও যেতে রাজি নয়, কালেঙ্গা তো বহু দূর। রতন বারবার বলছিল, ড্রাইভার তার খালাতো ভাই। সে যাবেই। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে এক ঘণ্টা, ফিরতে এক ঘণ্টা। অতএব, সাড়ে ছয়টা-সাতটার আগে কালেঙ্গা রওয়ানা হওয়া যাবে না।
শ্রীমঙ্গল নেমে আমার স্ত্রীর কোন অসুবিধা হয়নি। সেখানে আমাদের প্রতিনিধি তাকে রিসিভ করেন। আমার স্ত্রী পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। ভাষা বলতে তার সম্বল কেবল ইংরেজি। কিন্তু ইংরেজি কিছুই বোঝে না, এ রকম দেশেও তিনি দিব্যি একা বা দলেবলে ঘুরে এসেছেন। ফলে শ্রীমঙ্গল নিয়ে আমার ধারণা তিনি খুব একটা অসহায় বোধ করেননি। তার অভিযোগ তুমি তো আমাকে ফেলেই নেমে গেলে। তোমাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত।
যাই হোক, সোয়া পাঁচটা নাগাদ আমি আর রতন শ্রীমঙ্গল পৌঁছলাম। স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ঐ অরাজি চালকের সঙ্গেই শায়েস্তাগঞ্জে ফিরে এলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। রতন জোড়াজুড়ি করছিল রাতটা যেন অন্তত শায়েস্তাগঞ্জ থেকে যাই। আমি বললাম, শায়েস্তাগঞ্জে থাকবো না, কালেঙ্গাই যাবো। শুনেছি রাস্তা দুর্গম। ডাকাতির ভয় আছে নাকি। রতন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। কিসের ডাকাত? ডাকাতের কোন ভয় নেই। তাহলে কালেঙ্গায় যাবো। শায়েস্তাগঞ্জ থাকবো না।
ইতিমধ্যে যা ঘটার তাই ঘটলো। অনিচ্ছুক গাড়ি চালক বললেন, ঐ পথে তিনি কিছুতেই গাড়ি নিয়ে যাবেন না। আমরা একটি সিএনজি ঠিক করলাম। সিএনজি চালক অনেক সাহসী। বললো, ডাকাত-ফাকাত বাদ দিন স্যার। প্রতিদিন যাচ্ছি, কখনও কিছু ঘটেনি। আল্লাহর নাম নিয়ে আমরা সিএনজিতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলাম, কতক্ষণ লাগবে? সে বলল, ঘণ্টা-সোয়া ঘণ্টা। তবে রাস্তা খুব খারাপ। এর মধ্যেই চলাচল করি আমরা।
সত্যি দুর্গম পথ। ফেরার সময় মনে হলো, যে পথে ফিরছি, সেটা অতোটা দুর্গম নয়। সিএনজি চলতে শুরু করল। খুব নির্জন পথ। কয়েক কিলোমিটারে অন্য কোন যানবাহনের দেখা মিললো না। গা ছমছম করে।
আমরা গিয়ে যে রিসোর্টে উঠি তার মালিক আবদুর রহমান ওরফে লাসু মিয়া। তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা নিরাপদে রিসোর্টে পৌঁছলাম। রতনও হাফ ছেড়ে বাঁচলো। লাসু মিয়ার রিসোর্ট কালেঙ্গার মূল ভূখ- থেকে অনেকখানি নিচে। সেখানে নামার অভিজ্ঞতা দুর্দান্ত। আমার স্ত্রী কিছুতেই নিচে নামবেন না। তার ধারণা তিনি এই পথে কিছুতেই নিচে নামতে পারবেন না। পাহাড়ি ঢালু পথ সোজা নিচে নেমে গেছে। আমরা তিন-চারজন মিলে তাকে ধরলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নামতে নামতে তিনি অভিসম্পাত দিতে থাকলেন। আমরা বিনাবাক্য ব্যয়ে তাকে ধরে লাসু মিয়ার রিসোর্টের উঠানে নামলাম। যে ঘরে থাকবো সে ঘরটি খোলা ছিল। এঁটেল মাটির নিকাল উঠান। মাটির ঘর। কিন্তু এমনভাবে রঙ করা হয়েছে যেনো মনে হয় এটি কোন দালান। হাই কমোড, গোসলের ঝর্না, গরম পানিÑ সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। লাসু মিয়া অতিথির যে কোন প্রয়োজনে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যান উপরে, নেমে আসেন নিচে। এক খিলি পান খাবো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাজির। গ্লিসারিন দরকার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হাজির করবেন, লাসু মিয়া। নিকানো উঠানে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটলো, কী সুন্দর জায়গা।
আমরা দু’দিন কালেঙ্গায় ছিলাম। আবদুর রহমানের আতিথেয়তা ভোলার নয়।
সেখান থেকে গেলাম কমলগঞ্জে। হাজার হাজার পর্যটক, থাকবার জায়গা নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির ঘণ্টা তিনেক পর পাওয়া গেল এজিও হিড বাংলাদেশ । পাওয়া গেল একটা রুম। সেই হাজার শুকরিয়া। সেখানে ঘুরে বেড়ালাম, বিভিন্ন পর্যটন স্পট। সে অভিজ্ঞতার কথা বলা যাবে হয়তো আর একদিন। এবার ফেরার পালা।
আমার সহকর্মী আহাদ সদাতৎপর প্রতি মুহূর্তে আমাদের কেয়ার করেছে। থাকলাম তিন রাত। ঢাকায় ফিরতে হবে। ওরাই ট্রেনের টিকিট কেটে দিল। যে ট্রেনে ব্যবস্থা করলো, সেটি থামিয়ে আমাদের তুলে দেয়া নিশ্চিত করলো ঐ জয়ন্তিকা ট্রেন। আহাদের ভাই সোহেল রানা, সে আর ফাইম। সে জানালো, ধীরেসুস্থে উঠেন। আমি সিগনাল দিলে ট্রেন ছাড়বে? তার আগে নয়। ট্রেন ছাড়লো। পথে এক-দুইটি স্টেশনে ঘোষণা করা হলো, সামনের স্টেশন কোন্টি।
এরপর দু’একবার আজানের ধ্বনি শুনলাম। কিন্তু সামনে কোন স্টেশন তা আর ঘোষণা করা হলো না। আবারও ভয় পেতে থাকলাম। ট্রেন এয়ারপোর্ট স্টেশন ছেড়ে যাবে নাতো? আর ঘোষণা শুনি না। গার্ডকে বারবার জিজ্ঞেস করি সামনের স্টেশনের নাম কী? তারা বলেন। বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেন এসে গেল। একেওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এটা বিমানবন্দর স্টেশন। কিন্তু মাইকে কোন ঘোষণা হচ্ছিল না। আমরা এক প্রবীণ যাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, সামনের স্টেশন কী বিমানবন্দর? তিনি বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু কোন ঘোষণা যে দিলো না। তিনি বললেন, ঘোষণা কি আর বারবার দেয়? ওয়ান টাইম বাংলাদেশ। ট্রেন থামলো। বিনা ঘোষণায়ই আমরা এয়ারপোর্ট স্টেশনে নেমে গেলাম।
Discussion about this post