অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বর্তমান সরকার ভিন্নমত দমন নতুন কিছু নয়। ভোট ডাকাতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন কৌশলে বিরোধীদের দমন করে আসছে তারা। রাজপথে পুলিশ দ্বারা হামলার পাশাপাশি গেল বারো বছরে গুম, হত্যা, বন্দুকযুদ্ধ, পুলিশী নির্যাতনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভিন্নমত দমন করে আসছে ক্ষমতাসীনরা।
এবার ভিন্নমত দমনে করতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা অ্যাকটিভিস্ট ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি করে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা বন্ধ করার জন্য চাপ দিচ্ছে সরকার। এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
সম্প্রতি ফ্রান্সে অবস্থানরত ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যের বগুড়া জেলার বাড়িতে দুজন পুলিশ সদস্য তার বৃদ্ধ মা এবং মামাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বলে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন মি. ভট্টাচার্য।
মি. ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে তার লেখার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সেইসঙ্গে সরকারের সমালোচনা করে আসছেন। তার এই লেখালেখির জেরেই পরিবারকে এমন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে বলে তিনি ধারণা করছেন।
এভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাড়িতে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করাকে ভিন্নমত দমনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনেদের এক ধরণের পরোক্ষ চাপ বলে মনে করছেন মি. ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, “আমার ব্যাপারে কিছু জানার থাকলে তারা আমার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করবে। আমার বাসায় গিয়ে পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা তো এক ধরণের পরোক্ষ হুমকি। আমি খুবই উদ্বিগ্ন। আসলে এগুলো হল আমার লেখালেখি বন্ধ করতে চাপ সৃষ্টির কৌশল। যেন আমি লেখালেখি থেকে বিরত থাকি।
এর আগে জুলাই মাসে ব্লগার আসাদ নূরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পাশাপাশি তার বরগুনার বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। তার বাবা মাসহ পরিবারের ৬জন সদস্যকে দুদিন আটক রাখারও অভিযোগ রয়েছে।
এপ্রিলে সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক তাসনিম খলিল অভিযোগ করেছিলেন যে তার লেখালেখির কারণে বাংলাদেশের সিলেট জেলায় তার মায়ের বাড়িতে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ভয়ভীতি দেখিয়েছে।
দেশের মানবাধিকারকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন চলমান হয়রানি বন্ধ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চারটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। তারা হল: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এবং রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস।
যারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করেন এবং এ কারণে যাদেরকে হুমকির মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে তাদের ওপর এমন চাপ প্রয়োগের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এই সংস্থাগুলো।
এছাড়া ক্ষমতাসীন সরকার ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে দেশটির ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করছে বলেও উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাগুলো। তারা বলছে এই আইনের আওতায় তারা নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখাসহ মানুষকে গুম করে দিচ্ছে।
এমন অবস্থায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি হয়রানির এই অভিযোগগুলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। না হলে গণতান্ত্রিক দেশটিতে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হবে বলে তিনি মনে করেন।
মি. খান বলেন, “যারা যৌক্তিকভাবে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করেছেন তাদেরকে আইন প্রয়োগ করে বা না করে হেনস্তার ঘটনা সামনে এসেছে। ফটোগ্রাফার শহীদুল আলমের মতো অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, লেখক, সাংবাদিককে হেনস্থা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মত প্রকাশে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে।”
এই হুমকি ও হয়রানির অভিযোগগুলো স্বাধীনভাবে তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তিনি। না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটবে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
গত জুনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতি জানায় যে ডিজিটাল নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশের অবাধ তথ্য প্রবাহ ও স্বাধীন মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার হুমকির মুখে পড়েছে।
ভিন্ন মতপ্রকাশের জেরে সারাদেশে হামলা, মামলা, হুমকি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের ঘটনাগুলো উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে গভীর উদ্বেগ জানায় সংস্থাটি।
দেখা গেছে, বাংলাদেশে ভিন্নমত দেখা দিলে গুম করে ফেলার এক নিষ্ঠুর সংস্কৃতি চালু হয়েছে ক্ষমতসীন সরকার ভোট ডাকাতির পর ক্ষমতায় আসার পর। গুমের এই বিভীষিকা বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে। গত ১৪ বছরে ৬০৪ জন মানুষ বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায় ২০০৯ সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ১৮ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ২৬ জন, ২০১৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৬৬ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৮৬ জন, ২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত ৫৫ জন। এছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে গুম হয়েছেন প্রায় শতাধিক মনুষ গুম হয়েছেন।
এর মধ্যে র্যাব ১৫২ জনকে, পুলিশ, ৫১ জনকে, ডিবি পুলিশ ১৫৫ জনকে, র্যাব-ডিবি পুলিশ যৌথভাবে ১২ জনকে, অন্যান্য সংস্থা ৯৮ জনকে এবং বাকীদের বিষয়টা নির্দিষ্ট করা যায়নি। এছাড়া রাজপথ, বন্দুকযুদ্ধসহ বিভিন্ন ভাবে ভিন্নমত দমনের নামে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে ক্ষমতাসীনরা।