অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ও দেশের বেশ কিছু জেলায় বন্যার কারণে পুরো দেশ বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে। দেশে বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নাই বললেই চলে। আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির রয়েছে বিগত ১০ বছর ধরেই। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ছাড়া আর অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিরোধীদল গুলো প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। দেশে এখন পুরোপুরি একদলীয় শাসন চলছে।
দেশে সব কিছু যখন স্থবির, মানুষ যখন প্রাণঘাতী করোনা থেকে বাচতে ছোটাছুটি করছে, ঠিক তখন কিছু গণমাধ্যম বিএনপি-জামায়াতের কথিত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে সামনে নিয়ে আসছে। গণমাধ্যমগুলোর ভাষায়-বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দিতে একমত হয়েছে। এমনকি খালেদা জিয়াও নাকি এখন জোট থেকে জামায়াতকে বাদদিতে চাচ্ছেন।
গণমাধ্যমগুলো বলছে-বিএনপি নাকি এখন আর জামায়াতের দায় নিতে চাচ্ছে না। জামায়াত নাকি এখন বিএনপির জন্য বোঝা হয়ে গেছে। জামায়াতের কারণে নাকি বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারছে না। জামায়াতকে সাথে রাখায় নাকি বিএনপিকেও যুদ্ধাপরাধীদের দল বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে-এদেশে জামায়াত এমন কি অপকর্ম করেছে যার দায় বিএনপিকে নিতে হচ্ছে? জামায়াত কি কর্মীবিহীন কোনো নাম সর্বস্ব রাজনৈতিক দল যে বিএনপির কাধে ভর করে চলতে হচ্ছে? জামায়াতের জন্য বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীর দল বলবে কেন? বিএনপিতে কি কথিত যুদ্ধাপরাধী নেই? সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আব্দুল আলিম কি জামায়াতের নেতা ছিলেন?
সে সব বিষয়ে আলোচনায় পরে যাওয়া যাবে। বিএনপি-জামায়াতের জোট গঠনের কারণটা কি ছিলো? তা নিয়ে একটু ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক।
১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে চারদলীয় জোট। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু অগণতান্ত্রিক, দেশ ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের শক্ত প্রতিবাদ করার লক্ষ্যে মূলত গঠিত হয় বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
রাজনৈতিক প্রক্ষাপট বলছে, এই জোট গঠনের চিন্তা আসছিল জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মাথা থেকে। অধ্যাপক গোলাম আযম বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বলেছিলেন পৃথক আন্দোলন ও নির্বাচন করে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হঠানো যাবে না। জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন ও নির্বাচন করতে পারলেই আওয়ামী লীগের পতন হবে। এছাড়া সম্ভব নয়। গোলাম আযমের এই পরামর্শেই খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলনে আগ্রহী হন।
কারণ হিসেবে অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর কোনো স্বার্থ ছাড়াই সরকার গঠনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল। আর ৯৬ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে জামায়াতের সমর্থন চেয়েছিল। কিন্তু, জামায়াত আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়নি। এসব কারণে জামায়াতের উপর খালেদা জিয়ার আস্থা ছিল যে জামায়াত নেতারা বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না।
পরে জোটবদ্ধ আন্দোলন ও পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিপুল আসনে জয় লাভ করে।
এরপর ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ভাঙার কাজে হাত দেয়। বিশেষ করে জামায়াতকে বিএনপি থেকে আলাদা করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করতে সরকার প্রথমেই নিপীড়ন চালায় জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের ওপর। এমনকি বিএনপিকে না ছাড়ার কারণেই যুদ্ধাপরাধের মামলা দিয়ে শীর্ষ নেতাদেরকে ফাঁসি দিয়েছে এবং মামলা দিয়ে জামায়াত শিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করেছে। সেই নির্যাতন এখনও অব্যাহত আছে।
অপরদিকে বিএনপির ভেতর থেকেও একটি অংশকে সরকার কাজে লাগিয়েছে। বিএনপি নেতা জেনারেল মাহবুবু রহমান, ড. আব্দুল মঈন খান, শামসুজ্জামান দুদু, জয়নাল আবদীন ফারুক, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যেই জামায়াতের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় কথা বলেছেন। জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা না গেলে সভা-সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে হয় এমন কথাও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে বলেছেন তারা।
অথচ, ২০১৩ সালে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা যখন কর্মসূচি দিলেই আত্মগোপনে চলে যেতো, তখন হরতাল সফল করতে ছাত্রশিবির নেতাদের সাথে গোপনে বৈঠক করেছেন এমন তথ্যও আছে।
তারপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর ২০১৫ সালের টানা অবরোধ আন্দোলনের পর বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে থাকে জামায়াতকে বাদ দেয়ার জন্য। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী সদ্য মৃত্যুবরণকারী প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রকাশ্যেই বিএনপিকে বলে আসছেন জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দিতে।
যদিও তখন খালেদা জিয়া তাদের এসব কথাকে পাত্তা দেননি। এখন শোনা যাচ্ছে-খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানও জামায়াতকে বাদ দিতে চাচ্ছেন।
বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের মতো বিএনপির একটি অংশও মনে করছে-জোট থেকে বাদ দিলেই জামায়াতের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে। বিষয়টি আসলে এ রকম?
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির মধ্যে যারা সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামতে চান না তারাই মূলত জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দিতে চাচ্ছেন। কারণ, জামায়াত সব সময়ই সরকার বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে ছিল। বিএনপির এ অংশটির কারণে সরকার বিরোধী কোনো সফল হয়নি। তারা নিজেরাই শুধু আত্মগোপনে যাননি, কর্মীদেরকে মাঠে নামতে দেননি। তারা বিএনপির ভেতর সরকারের এজেন্ট হিসেবেই পরিচিত। তারা শুধু সরকারের দালালীই করেনি। জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেয়ার জন্যও তারা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করেছে।
যারা মনে করছে যে জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দিলে দলটি শেষ হয়ে যাবে, তাদের সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বরং বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকার কারণেই জামায়াতের বেশি ক্ষতি হয়েছে। বিগত ১১ বছরে জামায়াত শুধু তাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হারায়নি, দলটি অসংখ্যা নেতাকর্মী আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী ও তাদের পেটুয়া পুলিশ-র্যাব বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে জামায়াত শেষ হয়ে যায়নি। সরকার যত নির্যাতন চালিয়েছে জামায়াতের শক্তি তত বেড়েছে। জামায়াত নেতাকর্মীরা তত সংগঠিত হয়েছে। জামায়াত নেতাকর্মীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জেবিত। যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সক্ষমতা রাখে জামায়াত। কথিত ২০ দলীয় জোট থেকে বাদ দিলেই জামায়াত নি:শ্বেস হয়ে যাবে না কিংবা ভেসে যাবে না।