শাহমুন নাকীব
গতকাল ছিল বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে অন্যতম কালো দিন। এই রচিত হল আরও একটি লজ্জাজনক ইতিহাস। পত্রিকা অফিসে হামলা এবং সম্পাদককে লাঞ্চিত করার ঘটনা এ নিয়ে দ্বিতীয় বারের ঘটনা ঘটল।
প্রথমবার হামলার ঘটনা ঘটেছিল, ‘আমার দেশ পত্রিকা’-য়। তারপর লাঞ্চিত করা হয় উক্ত পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। তার গাড়িতে হামলা করে ভাঙ্গচুর করা হয়। আমার দেশ পত্রিকায় হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিল স্বয়ং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই। আর সম্পাদককে লাঞ্চিত করে দেশের কৃতি সন্তান ছাত্রলীগ!
আর গতকাল দৈনিক সংগ্রামের অফিসে হামলাসহ সম্পাদককে লাঞ্চিত করে, ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি নাম সর্বস্ব সংগঠন। অতীতে যে সংগঠনের তেমন কোনো কার্যক্রমই চোখে পড়েনি।
দৈনিক সংগ্রাম অফিসে হামলার কারণ?
গত ১২ তারিখ ছিল একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে দন্ডিত জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ নেতা শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার শাহাদাত বার্ষিকী! মূলত, একটি ত্রুটিপূর্ণ বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হয়; আর এই রায় আসে মূলত শাহাবাগ থেকে।
মূল আলোচনায় ফিরে আসি। গত ১২ তারিখ দৈনিক সংগ্রাম শিরোনাম করে, ‘আজ শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার শাহাদাত বার্ষিকী’! কেবল এই শিরোনাম করার কারণে সাংবাদিক অঞ্জয় দত্ত নাম্মি বেশ কয়েকজন শাহাবাগি সাংবাদিক ও ব্লগার এই শিরোনাম নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু করে। এক সময় তারা এই শিরোনামকে কেন্দ্র ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার ধান্দা করে।
তারপর তারা ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি নাম সর্বস্ব দলের ব্যানারে দৈনিক সংগ্রাম অফিসের সম্মুখে একদল ভাড়াটে সন্ত্রাসীকে প্রেরণ করে। সন্ত্রাসীরা বরাবরই ধ্বংসে বিশ্বাস করে। ফলে তারা নিজেদের স্বভাবসুলভ কাজটাই করল। এক পর্যায়ে তারা দৈনিক সংগ্রাম অফিসে প্রবেশ করে ভাঙ্গচুর শুরু করে। পত্রিকা অফিসের কম্পিউটার, টেলিভিশন, চেয়ার, টেবিলসহ যা কিছু ছিল সবই প্রায় ভাঙ্গচুর করেছে। এরপর তারা চড়াও হয় দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক বর্ষীয়ান সাংবাদিক আবুল আসাদের উপর।
এসময় তারা এই বয়োবৃদ্ধ সাংবাদিককে শারীরিকভাবে লাঞ্চিতও করে। এরপর তারা সম্পাদক আবুল আসাদকে টেনে হিচড়ে অফিসের বাহিরে নিয়ে আসে এবং জোর পূর্বক মিডিয়ার সামনে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। এরপর ট্রিপিক্যাল বাংলা সিনেমার মত ঘটনার শেষে হাজির হয় আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা পুলিশ বন্ধু। তারা এসে সম্পাদক আবুল আসাদ সাহেবকে থানায় নিয়ে যায় এবং আজ জানতে পারলাম তার নামে আইসিটি আইনে মামলা করা হয়েছে। সেই মামলায় তাকে ৩ দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।
‘শহীদ’ শব্দ ব্যবহার করে দৈনিক সংগ্রাম কি ফৌজদারি অপরাধ করেছে?
‘শহীদ’ শব্দ ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশে আজ অবধি কোনো আইন জারি করা হয়নি। যদিও শহীদ শব্দটি মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তারপরও ইদানিংকালে বাম-রাম, হিন্দু-বৌদ্ধ প্রায় সকলেই নিজেদের নিহত বীরদের ‘শহীদ’ বলে সম্বোধন করে।
দৈনিক সংগ্রাম একটি নিবন্ধিত পত্রিকা। দেশ স্বাধীনের পূর্ব থেকেই এই পত্রিকার কার্যক্রম চলে আসছে। সেইসাথে এ কথা কারোরই অজানা নয়, এই পত্রিকা মূলত জামায়াত ইসলামের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে। যেমনটা আগে জাসদের মুখপাত্র হিসেবে ভূমিকা রাখত গণকন্ঠ, আওয়ামী লীগের মুখপাত্র পত্রিকা জনকণ্ঠ-অনেকটা তেমনই!
শহীদ শব্দ ব্যবহারে যেহেতু আইনত কোনো বাধা নেই, তাই দলের মুখপাত্র পত্রিকা হিসেবে দৈনিক সংগ্রাম জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার নামের আগে শহীদ বলে সম্বোধন করতেই পারে। এতে দোষের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
পত্রিকা অফিসে হামলার যৌক্তিকতা আছে কি?
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে, দেশের নাগরিকদের যেকোনো বিষয়ে আপত্তি জানানোর সুযোগ রয়েছে। এমনকি পত্রিকায় প্রকাশিত যেকোনো সংবাদের বিরুদ্ধেও আপত্তি জানাতে পারবে। তবে এই আপত্তি অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় এবং আইনের প্রতি সম্মান জানিয়েই করতে হবে। কিন্তু ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের’ ব্যানারে আন্দোলকারীরা নিজেদের সন্ত্রাসী বলে পরিচিত করতেই অধিক স্বাচ্ছন্দবোধ করলেন। যার দরুন তারা এরুপ একটি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। আরও সহজ করে বললে, তারা ফৌজদারি অপরাধ করেছে। তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। এই অপরাধের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু হীরক রাণীর দেশে এই সন্ত্রাসীদের আদৌ শাস্তি হবে কি?
পরিশেষে, সাংবাদিক সমাজের উদ্দেশ্যে দুটি কথা বলব। আজ যে সকল সাংবাদিকরা সম্পাদক আবুল আসাদের লাঞ্চিত করার ঘটনায় মজা মারছেন, মনে রাখুন একদিন আপনাদেরকেও এইরূপ পরিস্থিতির স্বীকার হতে হবে। প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই ঘটনারও বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে- এ কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।
ব্লগ থেকে সংগৃহিত